রাজধানী কাবুল ও প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর আফগান তালিবান গত সপ্তাহে প্রথম সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে। এতে তালিবানের বিভিন্ন বক্তব্য জানা গেছে। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক সমাজও নানামুখী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এদিকে, সাবেক প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠন নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। আফগানিস্তানে এখন তালিবানরাই অন্যান্য গোত্রকে নিয়ে সরকার গঠনের পথে এগুচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তালিবানরা যদি তাদের প্রতিশ্রুতি রাখতে পারে তাহলে বিশ্বশক্তিগুলো খুব দ্রুত এ সরকারকে মেনে নেবে। বিস্তারিত শুনুন আজকের সংবাদ পর্যালোচনায়।
যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া আফগান যুদ্ধ দুই দশক গড়িয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ এ সময়ে দেশটিতে শান্তির দেখা মেলেনি। বরং মার্কিন দাবি অনুযায়ী ধ্বংস হয়ে যাওয়া তালিবানরাই ফের ক্ষমতা দখল করলো। হাজার কোটি ডলার খরচ করে, দেশি বিদেশি হাজারো সেনার প্রাণের বিনিময়ে যে যুদ্ধ সংঘটিত হলো তার ফলাফল কী? এক বাক্যে সে জবাব কেউ দিতে পারছে না।
তবে, আফগান তালিবান জানিয়েছে- আপাতত যুদ্ধ শেষ।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটসন ইনস্টিটিউটের সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ২০ বছরব্যাপী ‘সন্ত্রাসদমন’ যুদ্ধে দেশটির খরচ হয়েছে দুই লাখ ২৬ হাজার কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ১ কোটি ৯০ লাখ কোটি টাকারও বেশি।
ক্ষমতা গ্রহণের পর গত ১৭ অগাস্ট প্রথম সংবাদ সম্মেলন করে আফগান তালিবানরা। এতদিন পর্দার আড়ালে থাকা তালিবান নেতা জবিউল্লাহ মুজাহিদকে প্রথম দেখা গেল। তিনি দেশ ও বিশ্বের উদ্বেগে সাড়া দিয়ে তালিবানের প্রতিশ্রুতিগুলো উল্লেখ করেন। তার বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, তালিবান এখন বৈশ্বিক দাবিকে গুরুত্ব দেয় এবং তার প্রতি সম্মান জানাতে চায়। একে অনেকেই ইতিবাচকভাবে দেখছেন।
সংবাদ সম্মেলনে মুজাহিদ দাবি করনে, বর্তমান তালিবান সম্পূর্ণ ভিন্ন তালিবান। অভিজ্ঞতা, পরিপক্কতা ও দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে বিশ বছর আগের তালিবানের সাথে বর্তমান তালিবানের বিশাল তফাত রয়েছে। এটা বিবর্তনের ফসল। তিনি নারীদের ঘরের বাইরে কাজ করা ও পড়াশোনার অধিকারের প্রতি সম্মতি দেন। তিনি আন্তর্জাতিক সমাজকে আশ্বস্ত করে বলেন- নারীদের প্রতি কোন বৈষম্য করা হবে না।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি শান্তির বার্তা দেন। সেই সঙ্গে জানান বিশ বছর সংগ্রামের পর তারা দেশকে মুক্ত করেছেন এবং বিদেশিদের বহিষ্কার করেছেন। গোটা জাতির জন্য এটা গর্বের মুহূর্ত। আফগানিস্তান যাতে একটা যুদ্ধ ক্ষেত্র বা সংঘাতের দেশ না হয় সেটা তারা নিশ্চিত করবেন। তালিবানরা সবার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে এবং শত্রুতা অবসানের আহ্বান জানায়।
পাশাপাশি, তালিবান যোদ্ধা, জনগণ, সব পক্ষ, সব উপদল, সবার অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সরকার গঠনের কথা নিশ্চিত করেছে তারা। এসময় গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথাও উল্লেখ করেন তালিবান। বেসরকারি মিডিয়া স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে। তবে, মিডিয়ায় ইসলামি মূল্যবোধের পরিপন্থী কিছু প্রচার করা যাবে না বলে জানায় তালিবান।
যারা দেশত্যাগে উদ্দত হয়েছেন তাদেরকে নিশ্চিন্তে দেশে বাস করা, নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করা এবং নিশ্চিন্তে জীবনযাপনের প্রতিশ্রুতি দেন মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ।
এই অবস্থায় বিশ্বশক্তিগুলো তালিবানের ইস্যুতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানায়। ইতোমধ্যে তালিবান প্রতিনিধিদল চীন সফর করে এবং চীন জানিয়েছে আফগানিস্তানের সঙ্গে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক’ সম্পর্ক আরো গভীর করতে প্রস্তুত। রাশিয়া বলেছে, কাবুল থেকে কূটনীতিকদের সরিয়ে আনার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান মন্তব্য করেছেন, আফগানিস্তানের জনগণ অবশেষে ‘দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙেছে।’ চীনা গণমাধ্যমগুলোতে আফগানিস্তানে আমেরিকার সুস্পষ্ট পরাজয়, জোরপূর্বক ভিন্ন দেশের শাসনপদ্ধতি চাপিয়ে দেওয়ার কুফল এবং আফগানিদের নিজেদের জীবন গঠনের অধিকারের মতো বিষয়গুলো গুরুত্ব পাচ্ছে।
রুশ গণমাধ্যমে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে আফগানিস্তানের পরিবর্তনের নানা দিক বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। রুশ পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকার কনস্টান্টিন কোশাচেভ বলেছেন, রাশিয়া ও তার মিত্রদের জন্য যে ঝুঁকি বাড়বে, সেটা মোটেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আরেকটি রুশ সংবাদপত্র কোমারসান্ট বলছে, কাবুলের পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হলেও সেখানে রুশ দূতাবাস দেখে বেশ শান্ত বলেই মনে হচ্ছে। দূতাবাস বলছে, অন্যান্য পশ্চিমা দেশের মতো তারা তাদের কূটনীতিক ও কর্মীদের উদ্ধার করে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন দেখছে না।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আফগানিস্তানে তালিবানের বিজয় সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তা বেশ আলোচিত হচ্ছে। তিনি সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে বক্তৃতায় বলেন, আফগানরা ‘দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙেছে।’ ১৯৯৬ সালে পাকিস্তান তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
মোহাম্মদ তৌহিদ; বার্তা সম্পাদক, সিএমজি বাংলা বিভাগ, বেইজিং।