অগাস্ট ১৬: গতকাল (রোববার) আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হঠাত্ পরিবর্তন হয়েছে। সেদেশের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ আশরাফ ঘানি গোপনে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। এদিন আফগান তালিবান গোষ্ঠী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক বিবৃতিতে জানায়, তারা কাবুলে প্রবেশ করেছে। বর্তমানে তালিবান গোষ্ঠী আফগান প্রেসিডেন্ট ভবনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। একদিনের মধ্যে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আকাশ-পাতাল পরিবর্তন হয়েছে, যা একেবারেই অপ্রত্যাশিত।
৬ অগাস্ট থেকে আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া থেকে ১৫ অগাস্ট রাজধানীতে প্রবেশ করা পর্যন্ত, তালিবানের আশ্চর্যজনক দ্রুত গতি দেখা গেছে। সেই তুলনায় আফগান সরকারি বাহিনীও দ্রুত পেছনে সরে গেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা কোনো প্রতিরোধ করে নি, বরং আত্মসমর্পণ করেছে।
আফগান বাহিনীর মধ্যে দুর্নীতি ও মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ফলে রণাঙ্গনে আফগান সেনারা এত দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মার্কিন সরকারের বেশ কিছু রিপোর্টে দেখা যায়, আফগান বাহিনীতে দীর্ঘদিন ধরে মারাত্মক দুর্নীতি চলছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো বাহিনী তালিবানের ওপর প্রভাব বজায় রেখেছে। তবে ন্যাটো ও মার্কিন সেনা সরে যাওয়ার পর তালিবান যোদ্ধাদের শক্তি এক লাফে বেড়ে যায়। পর্বতাঞ্চলে যুদ্ধ বরাবরই তালিবানদের জন্য সুবিধাজনক। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সমর্থন ছাড়া আফগান সরকারি বাহিনী তাদের প্রতিপক্ষ নয় মোটেও।
আসলে আফগান সরকারি বাহিনীর পরাজয় ও আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির অবনতির জন্য যুক্তরাষ্ট্র দায়ী। ২০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র জোরপূর্বক যুদ্ধের মাধ্যমে তালিবান শাসন উৎখাত করে এবং আফগান সমাজকে বিভক্ত করে। ফলে ‘অগ্রহণযোগ্য’ পরিণতি ঘটেছে। ২০ বছর পর কৌশলগত কারণে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হলে আফগানিস্তান রাতারাতি করে অতীতে ফিরে যায়।
বর্তমানে আফগানিস্তানের পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি প্রসঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ পৃথক পৃথকভাবে সাড়া দিয়েছে।
গতকাল (রোববার) রাতে আফগান প্রেসিডেন্ট ঘানি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলেন, তিনি আফগানিস্তান থেকে চলে গেছেন। তার জন্য একটি খুব কঠিন সিদ্ধান্ত। রক্তপাত এড়াতে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিলেন।
ঘানি আরো বলেন, শক্তির মাধ্যমে তালিবান বিজয় অর্জন করলেও জনগণের মন জয় করতে পারবে না। ইতিহাস আমাদেরকে বলে, বল প্রয়োগ করে কেউ বৈধ হতে পারে না।
রোববার তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তায়িব এরদোয়ান বলেছেন, তুরস্ক আফগানিস্তান ও এতদাঞ্চলের স্থিতিশীলতা রক্ষায় সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে। ব্যাপক আফগান শরণার্থীর চাপ মোকাবিলায় পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে চায় তুরস্ক।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মাদ জাওয়াদ জারিফ আফগান পরিস্থিতি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলেছেন, সশস্ত্র বিপ্লব ও যুদ্ধ দিয়ে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয় না। আফগান নেতৃবৃন্দের সমন্বয় কমিটি প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত ইস্যুতে সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের বিবৃতিকে সমর্থন জানায় ইরান।
রোববার কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে আফগান সরকার ও তালিবানের মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা করার আহ্বান জানায়।
আফগানিস্তান-সংক্রান্ত বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তালিবান দেশের অধিকাংশ ভূখণ্ড দখল করলেও বহুজাতিক ও বহু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের একটি দেশ হিসেবে আফগানিস্তানের পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে দীর্ঘমেয়াদী বড় পরিবর্তন ঘটবে।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, আফগানিস্তানের তালিবান-বিরোধী শক্তিগুলো শহর থেকে পাহাড়ি অঞ্চলে সরে গেছে এবং তালিবানের বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ শুরু করেছে। আফগানিস্তানে ব্যাপক পাহাড়ি অঞ্চল এবং ব্যাপক অস্ত্রের কারণে সশস্ত্র শক্তি তৈরি হয়। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা অপসারণ করা হলেও সেদেশে শক্তিশালী গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক বজায় রয়েছে। তালিবান-বিরোধী গেরিলাদের ফের সমর্থন দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।
আন্তর্জাতিক সমাজ মনে করে, সামরিক পদ্ধতিতে আফগান সমস্যা সমাধান করা যাবে না। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষকে আলোচনার টেবিলে রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য বসতে হবে। তবে বর্তমানে তালিবান গোষ্ঠী বিরাট বিজয় অর্জন করলেও চলমান দোহা আলোচনার ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব ও মনোযোগ দেওয়া হয় নি। তাই কেউ কেউ মনে করছেন, ভবিষ্যতে তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ করলেও ফের গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা রয়েছে।
(লিলি/তৌহিদ/শুয়েই)