টোকিও অলিম্পিক গেমসে চীনা খেলোয়াড়দের চমত্কার পারফর্মেন্স
2021-08-13 18:22:25

টোকিও অলিম্পিক গেমসে চীনা খেলোয়াড়দের চমত্কার পারফর্মেন্স

টোকিও অলিম্পিক গেমসে চীনা খেলোয়াড়দের চমত্কার পারফর্মেন্স_fororder_jian1

পুরুষদের একশ’ মিটার দৌড়ের সেমিফাইনাল শুরু হওয়ার মুহূর্তে, চীনা খেলোয়াড় সু বিং থিয়ান নিজের বুড়ো আঙ্গুল এবং তর্জনী দিয়ে ‘এক সেন্টিমিটার’ দূরত্ব তৈরি করে দেখান। প্রতিযোগিতা শেষে তিনি বলেন, এটা করার কারণ হল, নিজেকে আরো ‘অল্প কিছু’ ভালো করার কথা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।

৯.৮৩ সেকেন্ডের সেমিফাইনালে সু বিং থিয়ান প্রথম! এটা এশিয়ারও একটি নতুন রেকর্ড। তিনি হলেন এশিয়ার একশ’ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় ৯.৯ সেকেন্ডের কম সময়ে বিজয়ী খেলোয়াড়।

আসলে সু বিং থিয়ান শুধু ‘অল্প কিছু’ ভালো করেন নি, তিনি বরং বড় একটি অগ্রগতি অর্জন করেছেন। টোকিও অলিম্পিক গেমসে চীনা ক্রীড়া প্রতিনিধি দলের শ্রেষ্ঠ পার্ফমেন্সে ঠিক এমন।

মাত্র এক মাস আগে, যখন চীনা ক্রীড়া প্রতিনিধিদল গঠিত হয়, তখন তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, অলিম্পিক গেমসে ভালো ফলাফল করবেন।

৩২তম অলিম্পিক গেমসে চীনা ক্রীড়া প্রতিনিধিদল ৩৮টি স্বর্ণপদক, ৩২টি রৌপ্যপদক এবং ১৮টি ব্রোঞ্জপদক জয় করে শ্রেষ্ঠ সাফল্য অর্জন করেছে। এতে চীনের ক্রীড়া ও সভ্যতার সাফল্য প্রতিফলিত হয়। চীনা খেলোয়াড়রা দেশ ও জনগণের জন্য গর্ব অর্জন করেছেন।

 

পাঁচ বছরের কঠোর চর্চা, করোনাভাইরাসের মহামারির প্রাদুর্ভাব কাটিয়ে চীনা খেলোয়াড়রা অলিম্পিক গেমসের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। খেলার মাঠের বাইরে, চীনা খেলোয়াড়দের আস্থা এবং সহজ-সরল রসবোধ লোকজনের ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে। সারা বিশ্ব আরও উন্মুক্ত ও সহনশীল চীন দেখতে পেয়েছে। আর কয়েক মাস পর বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিতব্য শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের আকাঙ্ক্ষায় আছে।

 

ইয়াং ছিয়ান জয়ী হয়েছেন

টোকিও অলিম্পিক গেমসে চীনা খেলোয়াড়দের চমত্কার পারফর্মেন্স_fororder_jian3

তিনি ২০০০ সালের গ্রীষ্মকালে জন্মগ্রহণ করেন। অল্প বয়সী এই চীনা মেয়ে ৩২তম টোকিও অলিম্পিক গেমসে চীনা ক্রীড়া দলের জন্য প্রথম স্বর্ণপদক জয় করেন। আর এটিও টোকিও অলিম্পিক গেমসের প্রথম স্বর্ণপদক। তিনি হলেন ১০ মিটার নারী এয়ার রাইফেল প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়ন।

তাঁর প্রথম কোচ ইয়ু লি হুয়া বলেন, ছোটবেলা থেকেই মেয়েটির মনে দৃঢ় সংকল্প ছিল। কখনই আতঙ্কিত হয় না।

 

গত ২৪ জুলাই থেকে ৭ অগাস্ট পর্যন্ত, ১৫ দিনের প্রতিযোগিতায় চীনা খেলোয়াড়রা প্রায় প্রতিদিন স্বর্ণপদক জিতেছেন।

অলিম্পিক গেমস শেষ হওয়ার দু’দিন আগে, চীনা প্রতিনিধি দল স্বর্ণপদকের তালিকায় শীর্ষস্থানে উঠে যান। এটাও বিদেশে অলিম্পিক গেমসে চীনা ক্রীড়া দলের শ্রেষ্ঠ সাফল্য।

ডাইভিং, ভারোত্তোলন, টেবিল টেনিস, শুটিং, জিমন্যাস্টিকস, ব্যাডমিন্টন এই ছয়টি ইভেন্টে চীনা ক্রীড়া দল বেশ দক্ষ। টোকিও অলিম্পিক গেমসে এই ছয়টি ইভেন্টে চীনা খেলোয়াড়রা ২৭টি স্বর্ণপদক জিতেছেন।

আর চীনের ডাইভিং, ভারোত্তোলন ও টেবিল টেনিস- এই তিনটি দলকে ‘স্বপ্নের দল’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই তিনটি ইভেন্টের প্রায় সব ক্যাটাগরিতে চীনারা স্বর্ণপদক পেয়েছেন, শুধু একটি ছাড়া।

রিও অলিম্পিক গেমসে চীনের শুটিং ও জিমন্যাস্টিকস ভালো ফলাফল করে নি, এবারের টোকিও অলিম্পিক গেমসে এই দুই দল পৃথক পৃথকভাবে ৪টি ও ৩টি স্বর্ণপদক পেয়েছে।

 

চীনের শুটিং দল ১১টি পদক পেয়েছে, যা অলিম্পিক গেমসে চীনা শুটিং দলের সর্বোচ্চ রেকর্ড। চীনের রাষ্ট্রীয় ক্রীড়া ব্যুরোর শুটিং খেলা পরিচালনা কেন্দ্রের মহাপরিচালক লিয়াং ছুন বলেন, চীনে এমন একটি কথা প্রচলিত রয়েছে- ‘প্রাচীনকাল থেকেই ছোটদের মধ্যে বীর পাওয়া যায়’। আমরা তরুণ তরুণীদের ভালোভাবে প্রশিক্ষিত করবো; কারণ তারা চীনের ভবিষ্যত্।

 

জিমন্যাস্টিকস প্রতিযোগিতার শেষ দিনে, চৌ জিং ইউয়ান পুরুষদের প্যারালেল বারস প্রতিযোগিতার স্বর্ণপদক পান। আর কুয়ান ছেন ছেন ও থাং ছিয়ান জিং নারীদের ব্যালেন্স বিম প্রতিযোগিতায় রৌপ্যপদক পান। তবে পাঁচ বছর আগে, তখন রিও অলিম্পিক গেমসে চীনা জিমন্যাস্টিকস দল কোনো পদক জয় করতে পারে নি। তখন দলটি ভীষণ চাপের মধ্যে ছিল। চীনা জিমন্যাস্টিকস দল পরিচালনা কেন্দ্রের মহাপরিচালক মিউ চুং ই বলেন, বিশেষ করে করোনাভাইরাসের মহামারি শুরু হলে জিমন্যাস্টিকস দলের প্রধান এবং শক্তিশালী সদস্যরা দীর্ঘ সময় ধরে কোয়ারেন্টিনে ছিলেন, চর্চার মাঠে যেতে পারতেন না। তাই প্রত্যেক খেলোয়াড় অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাই এবারের টোকিও অলিম্পিক গেমসে এত ভালো ফল অর্জন করা সহজ ব্যাপার ছিল না।

 

চীনা খেলোয়াড়রা কেন এবার টোকিও অলিম্পিক গেমসে এত ভালো সুফল পেতে পারেন?

রাষ্ট্রীয় খেলোয়াড় দলের কোচদের চোখে, দেশের নিশ্চয়তা, বিভিন্ন ক্ষেত্রের ভালো প্রস্তুতি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিশনের চেয়ারম্যান টমাস বাখ মূল্যায়ন করে বলেন, বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় চীনা খেলোয়াড় খুব ভালো পার্ফমেন্স করেছেন, অবশ্য, চীনের অলিম্পিক কমিশন খেলোয়াড়দের প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রে ভালো কাজ করেছে।

চীনের ব্যাডমিন্টন সমিতির চেয়ারম্যান চাং চুন বলেন, অলিম্পিক গেমস এক বছর দেরিতে শুরু হয়েছে। আমাদের দেশ আমাদেরকে খুব শক্তিশালী সমর্থন দিয়েছে, আমরা ক্রীড়া কেন্দ্রে স্বাভাবিকভাবে প্রশিক্ষণ ও চর্চা করতে পারি, ভালো শারীরিক অবস্থা বজায় রাখতে পারি, অন্য দল আমাদের মত এত ভালো অবস্থায় চর্চা করতে পারে নি।

টোকিও অলিম্পিক গেমসে চীনা খেলোয়াড়দের চমত্কার পারফর্মেন্স_fororder_jian2

সুফল পাওয়ার পিছনে মহামারি প্রতিরোধ এবং অ্যান্টি-ডোপিং এই দুই ক্ষেত্রে চীনা ক্রীড়া দলও ভালো করেছে।

হয়ত অনেকেই লক্ষ্য করে নি যে, চীনের ভারোত্তোলন দল প্রতিযোগিতার সময় মাঠে রাখা অ্যান্টি-স্লিপ পাউডার ব্যবহার করে নি কখনওই। ভারোত্তোলন দল জানায়, এটি হল দলের নির্ধারিত মহামারি প্রতিরোধ ব্যবস্থার অন্যতম একটি বিষয়। চীনের ভারোত্তোলন সমিতির চেয়ারম্যান চৌ চিন ছিয়াং জানান, প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের এক মাস আগে চীনা ক্রীড়া দল ৩ হাজারেরও বেশি অক্ষরের ‘অলিম্পিক গেমসের জন্য মহামারি প্রতিরোধ, যোগাযোগ এবং আকস্মিক অবস্থা মোকাবিলার কর্ম প্রস্তাব’ প্রণয়ন করে। এতে প্রতিযোগিতার সময় মহামারি প্রতিরোধের প্রতিটি বিস্তারিত বিষয় বিবেচনা করা হয়।

জয় বা পরাজয়- যাই হোক না কেন, চীনা খেলোয়াড়রা টোকিও অলিম্পিক গেমসে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন।

 

২ অগাস্ট হলো টোকিও অলিম্পিক গেমসে চীনের নারী ভলিবল দলের শেষ প্রতিযোগিতা। দলের কোচ লাং পিং সবাইকে বলেন, আপনাদের অনেকেই বয়সে অনেক তরুণ। ৩ বছর পর আবার প্যারিস অলিম্পিক গেমসে যাবেন, আজই আমরা এই প্রতিযোগিতাকে পুনরায় যাত্রা শুরু করার মতো বিবেচনা করবো।

অনেকেই কল্পনা করতে পারে নি, চীনের ভলিবল দল গ্রুপ প্রতিযোগিতায় ব্যর্থ হবে। তবে কেউ এই নারী ভলিবল দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে না।

 

২০১৯ সালে ভলিবল বিশ্বকাপ অর্জনের পর চীনের নারী ভলিবল দল মহামারির সময় প্রায় দেড় বছরের রুদ্ধদ্বার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে। লাং পিং  বলেন, বাইরে গিয়ে উচ্চ মানের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে নি, তা আসলে দলের জন্য একটি খারাপ ব্যাপার। মহামারির প্রাদুর্ভাব হল তাঁর কোচ হিসেবে নয় বছর কাজ করার অভিজ্ঞতার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

 

মহামারির সময় চীনা ভলিবলদলসহ চীনের বিভিন্ন ক্রীড়া দল বাইরে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে নি, শুধু নিজে নিজে প্রশিক্ষণ ও চর্চা করেছে। লাং পিং বলেছিলেন, অলিম্পিক গেমসের জন্য প্রত্যেকেই সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। এটিই সবচেয়ে মূল্যবান ব্যাপার।

 

চীনা ক্রীড়াদল তরুণ একটি দল। ৪৩১জন খেলোয়াড়ের গড়পড়তা বয়স ২৫.৪ বছর। তাদের মধ্যে ২৯৩জন প্রথমবারের মত অলিম্পিক গেমসে অংশ নিয়েছে। যা মোট খেলোয়াড়ের ৭০ শতাংশ।

এই গ্রীষ্মকালে চীনা খেলোয়াড়রা ছিলেন চীনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষ। তাঁদের শ্রেষ্ঠ অর্জন, তাঁদের ব্যক্তিগত চরিত্র ইত্যাদি লোকজনের প্রশংসা পেয়েছে।

 

এবার অলিম্পিক গেমসের প্রথম স্বর্ণপদক অর্জনকারী চীনা মেয়ে ইয়াং ছিয়ান প্রতিযোগিতার সময় খুব মনোযোগী ও গুরুগম্ভীর ছিলেন। কিন্তু প্রতিযোগিতা মাঠের বাইরে সে যেন পাশের বাড়ির হাসিখুশি মেয়ের মতো। তিনি নেটিজেনের সঙ্গে নিজের নখ সুন্দর করার টিপসও শেয়ার করেন। একদিকে প্রতিযোগিতায় সুফল অর্জন করতে পারা, অন্যদিকে জীবনকে ভালোবাসা চরিত্র-- এমন চ্যাম্পিয়ন সবার কাছে প্রিয়।

টোকিও অলিম্পিক গেমসে চীনা খেলোয়াড়দের চমত্কার পারফর্মেন্স_fororder_jian5

চীনের নারী ভারোত্তোলন দলের খেলোয়াড় লি ওয়েন ওয়েন-এর মেঝেতে শুয়ে থাকার একটি ভিডিও জনপ্রিয় হয়েছে। একজন ভারোত্তোলন খেলোয়াড় হিসেবে, তাঁর ওজন সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি। আর সবাই জানে যে, টোকিও অলিম্পিক গেমসে খেলোয়াড়দের বিছানা কাগজের তৈরি, তাই নিজের ভারি ওজনের কারণে কাগজের বিছানা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় তিনি মেঝেতে শুয়ে থাকেন। অনলাইনে অনেকেই তাঁর প্রতি আন্তরিকতা দেখিয়েছেন।

 

তিনি স্বর্ণপদক পাওয়ার পর টিভি ও স্ক্রিনের সামনে সবার জন্য হাত দিয়ে ‘হৃদয়’ আকার দেখান; আর মাঠের বাইরে তিনিও সাধারণ মেয়ের মত পুতুল ও সুন্দর পোশাক পছন্দ করেন। তিনি বলেন, প্রতিটি মোটা মেয়েও স্বপ্ন দেখে।

 

এখন টোকিও অলিম্পিক গেমস শেষ হয়েছে, অলিম্পিক গেমসের ‘বেইজিং সময়’ শুরু হয়েছে।

গত ২১ জুলাই, টোকিওতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অলিম্পিক গেমস কমিশনের সম্মেলনে, বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিক গেমস কমিশন প্রস্তুতিমূলক কাজ অবহিত করেছেন এবং বিশ্বের জন্য একটি সহজ, নিরাপদ ও চমত্কার অলিম্পিক গেমসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

 

১৩ বছর আগে ৮ অগাস্ট বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিক গেমস উদ্বোধন করা হয়।

সেদিন থেকে প্রতি বছরের ৮ অগাস্ট চীনের ‘শরীরচর্চা দিবস’ হিসেবে নির্ধারিত হয়। এটা হল চীনকে দেওয়া বেইজিং অলিম্পিক গেমসের সবচেয়ে মূল্যবান উপহার।

আর মাত্র ৬ মাসের মধ্যে চীনের দরজা সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়দের জন্য খুলে দেওয়া হবে। আশা করি, এবারও দুর্দান্ত একটি অলিম্পিক গেমসে দেখবে বিশ্ববাসী।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)