আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ও দ্রুত বদলে যাওয়া আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট
2021-08-07 17:02:45

আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সেনা প্রত্যাহার শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই দেশটিতে সরকার ও তালিবানের মধ্যে তীব্র লড়াই শুরু হয়েছে। বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যম নানা সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য প্রকাশ করছে। বলাই বাহুল্য এসব বেশিরভাগ তথ্যই যাচাই বাছাই করার সুযোগ নেই। সাম্প্রতিক এক খবরে জানা গেছে, হেলমান্দ ও জোজ্জন প্রদেশের রাজধানী দখলের কাছাকাছি চলে এসেছে তালিবান যোদ্ধারা। এদিকে সম্প্রতি তালিবানের একটি শীর্ষ প্রতিনিধিদল চীন সফর করে গেল। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে পরস্পরের কিছু প্রতিশ্রুতির কথা উঠে এসেছে। ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চীন তালিবান বৈঠকের গুরুত্ব কতটুকো? তা বিশ্লেষণের চেষ্টা করবো।

 

মূলত, ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার পর আফগান প্রতিবেশী দেশগুলো তৎপর হয়ে ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যেকে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট হয়েছে। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, তালিবান মিলিশিয়া ও আফগান সরকারি সেনাদের লড়াই তীব্র আকার ধারণ করেছে। হেলমান্দ ও জোজ্জন প্রদেশের রাজধানী অনেকটাই তালিবানের কব্জায় চলে এসেছে। শুক্রবার বার্তাসংস্থা রয়টার্স এ খবর জানায়।

জোজ্জন প্রদেশ কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রাদেশিক রাজধানী শেবারগানের উপকণ্ঠে ভয়ঙ্কর আক্রমণ চালিয়েছে তালিবানরা। জোজ্জনের ১০টি জেলার নয়টিই তালিবানের দখলে। এদিকে হেলমান্দ প্রদেশেও চলছে ব্যাপক লড়াই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সেনা চলে যেতে দেরি হতে পারে; কিন্তু, বিদেশি সমর্থনপুষ্ট আফগান সরকারের পতনে খুব একটা দেরি হবে না। গত জুনে মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও বলা হয়, মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ছয় মাসের মধ্যেই কাবুলে সরকার পতন নিশ্চিত করবে তালিবানরা। আফগানিস্তানের শাসনক্ষমতা তালিবানের হাতে গেলে দেশটির অবস্থা কেমন হবে এবং আশেপাশের দেশসহ বিশ্ব রাজনীতিতে কী প্রভাব পড়বে তা নিয়ে নানামুখী আলাপ-আলোচনা চলছে।

 

এই যখন অবস্থা, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী মার্কিন বাহিনী কেন তালিবানদের প্রতিরোধে ব্যর্থ হলো? দুর্বল সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে তালিবানরা কীভাবে বছরের পর বছর মার্কিন সেনাদের মোকাবিলা করলো? যদি আফগানিস্তানে তালিবানদের জনসমর্থন না থাকে তাহলে কেন যুগের পর যুগ ধরে তালিবানরা আফগানিস্তানে টিকে রয়েছে? পৃথিবীর কোনো শক্তিই জনগণের সমর্থন ছাড়া কোনো দেশে টিকে থাকতে পারে না। তাহলে গোটা বিশ্ব আফগানিস্তান ও তালিবান সম্পর্কে যা জেনেছে তা কতটুকো সত্য? সময়ই হয়তো এসব স্বাভাবিক প্রশ্নের জবাব দেবে।

 

এদিকে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কাতারের দোহায় তালিবানদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দফায় দফায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে আমরা দেখেছি। ইরানের তত্ত্বাবধানে তেহরানেও তালিবান ও আফগান পক্ষের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।

গত জুলাই মাসের শেষে তালিবান নেতারা চীন কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও বৈঠক করলো।

তালিবান নেতা মোল্লা আব্দুলগনি বারাদারের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের প্রতিনিধিদল থিয়েনচিন সফর করল। সফরে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তালিবান প্রতিনিধিদল। তার কিছুদিন আগেই চীনের সীমান্তবর্তী আফগান প্রদেশ বাদাকশানের গুরুত্বপূর্ণ জেলাগুলো কব্জা করে তালিবানরা। উল্লেখ্য যে, আফগানিস্তানের সঙ্গে চীনের ৯০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে।

 

এক বিবৃতিতে বলা হয়, চীন সরকার আফগানিস্তানের চলমান নিরাপত্তা পরিস্থিতির ব্যাপারে নিজের উদ্বেগের কথা জানাতে তালিবান প্রতিনিধিদলকে আমন্ত্রণ জানায়। এ সময় চীন প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তারা আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কখনো হস্তক্ষেপ করবে না বরং সংকট সমাধান এবং দেশটিতে শান্তি আনার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেন, “আফগানিস্তানে যেকোন অস্থিতিশীলতার প্রভাব প্রতিবেশী চীন ও পাকিস্তানে সরাসরি গিয়ে পড়বে। ফলে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করা অত্যন্ত প্রয়োজন।”

অন্যদিকে, আফগান প্রতিনিধিদল চীনকে এই প্রতিশ্রুতি দেয় যে, আফগানিস্তানের মাটি কাউকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। চীনের উইঘুর অঞ্চলের বিদ্রোহীদের তালিবানরা সহযোগিতা বা উৎসাহিত করবে না। আফগানিস্তানে নতুন চীনা বিনিয়োগকেও স্বাগত জানাবে তালিবানরা।

 

প্রশ্ন উঠতে পারে, আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা কেন দরকার? এর সহজ উত্তর, স্থিতিশীল আফগান পরিস্থিতি শুধু আফগানিস্তানের জন্যই নয়, বরং চীন, পাকিস্তান, ভারত, ইরান-সহ সব প্রতিবেশী দেশেরই সমান দাবি। সাগর তীরবর্তী গোয়াদার গভীর সমুদ্রবন্দর এবং সেখান থেকে চীন পর্যন্ত জ্বালানি পাইপলাইন বসানোসহ পাকিস্তানে ডজন ডজন অবকাঠামো প্রকল্পে চীনের প্রায় ৬০ বিলিয়ন (৬,০০০ কোটি) ডলার ব্যয়ের পরিকল্পনা রয়েছে। আফগানিস্তানের যে কোনো অস্থিতিশীলতার ধাক্কা চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর বা সিপেকের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।

চীন ইরানের সঙ্গে বন্দর আব্বাসের আধুনিকায়ন এবং সম্প্রসারণসহ সেদেশের বেশ কিছু অবকাঠামো ও জ্বালানি প্রকল্পে আগামী ২৫ বছর মেয়াদী ৪০০ বিলিয়ন (৪০,০০০ কোটি) ডলার বিনিয়োগ করার চুক্তি করেছে। অস্থিতিশীল আফগান পরিস্থিতি এক্ষেত্রেও বিরাট ঝুঁকি তৈরি করবে- যা বহু পক্ষের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।

ইতিহাস থেকে দেখা যায়, ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনা অভিযানের পর থেকে গত চার দশক দেশটিতে যুদ্ধ অব্যাহত ছিল। এতে সরাসরি ক্ষতির শিকার হয়েছে প্রতিবেশী পাকিস্তান ও ইরান। দেশ দুটিতে এখনও লাখ লাখ আফগান শরণার্থী রয়েছে; গোপনে সন্ত্রাসীরাও অনুপ্রবেশ করেছে। প্রতিবেশী ভারত আফগানিস্তানকে বরাবরই হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেছে।

এসব বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় স্থিতিশীল আফগান পরিস্থিতি সব পক্ষেরই কাম্য।

 

মোহাম্মদ তৌহিদ

বার্তা সম্পাদক; চীন আন্তর্জাতিক বেতার, বেইজিং।

৭ অগাস্ট ২০২১