আজহার লিমন, ঢাকা: বিদায়ী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে রফতানিখাতে। ২০১৯-২০ অর্থ বছরের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে পণ্য রফতানি হয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি। এই সময়ে প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক খাতের সঙ্গে সঙ্গে ভালো করেছে পাটজাত ও চামড়াজাত পণ্য। তবে কি মহামারি পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশের রফতানি খাত? বিশ্লেষকরা বলছেন, তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে ভিয়েতনামের দ্বিতীয় অবস্থানে চলে আসা, মহামারি পরিস্থিতিতেও কারাখানা চালু রাখাসহ রফতানি খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে সামনের দিনগুলোতেও।
বাংলাদেশের রফতানি বাজারে চামড়াখাত ৫ শতাংশের বেশি ভূমিকা না রাখলেও মহামারির এ বাস্তবতায় নতুন অর্থবছরে ভালো প্রবৃদ্ধি করেছে। নতুন অর্থবছরের প্রথম মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি প্রায় ৯ কোটি ডলারের চামড়া রফতানি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। বিদায়ী অর্থবছরেও চামড়াখাতের প্রবৃদ্ধি তার আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১৮ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমানের কাছে জানতে চেয়েছিলাম এই প্রবৃদ্ধির পেছনের কারণ কী?
তিনি বলেন, “বস্তুত গেল কয়েক মাস ধরে আমরা কিছু রফতানি আদেশ পাচ্ছিলাম। প্রধানত চায়না থেকেই আমাদের রফতানির আদেশগুলো আসতেছিলো। তবে এসব আদেশর অধিকাংশেই ছিলো লো গ্রেডের লেদার। এছাড়া ইউরোপ, তাইয়ান ও ভিয়েতনামেরও কিছু অর্ডার আসছিলো। এটা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। যার কারণে আমাদের কিছু বেশি রপ্তানি হয়েছে।”
মো. মিজানুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান, ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন
প্রবৃদ্ধির এ ধারা কি অব্যাহত থাকবে?
“হ্যা। এটাই ইনশাআল্লাহ অব্যাহত থাকবে। আসলে বিভিন্ন কারণে অতীতে আমাদের সমস্যা হচ্ছিলো। ট্যানারী শিফলিং কিংবা অনেকগুলো বায়ার আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, আমাদের স্ট্যান্ডার্ডটা ঠিক করা। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের দুর্বলতার জায়গাগুলো আমরা আস্তে আস্তে কাটিয়ে উঠছি এবং আশা করছি কন্টিনিউ এরকম একটা সাপোর্ট আমরা বায়ারদের কাছে থেকে পেতে থাকবে।”
বাংলাদেশের রফতানির উন্নয়ন ব্যুরোর হিসেবও বলছে, মহামারির দ্বিতীয় বছরে প্রথম বছরের তুলনায় ভালো প্রবৃদ্ধি করেছে পণ্য রফতানি খাত। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে যেখানে ৩৩ দশমিক ছয় সাত বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করতে পেরেছে বাংলাদেশ সেখানে ২০২০-২১ বিদায়ী অর্থবছরে রফতানির পরিমাণ ৩৮ দশমিক সাত পাচ শতাংশ। কিন্তু দেশীয় প্রবৃদ্ধির এই বিপরীতে আছে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার খবর। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সবশেষ হিসেবে দেখা গেছে, তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশকে একধাপ পেছনে ফেলে দ্বিতীয় অবস্থানের দখল নিয়েছে ভিয়েতনাম। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএয়ের পরিচালক আসিফ ইব্রাহিমের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এমন অবস্থায় কতটা চ্যালেঞ্জ রয়েছে সামনে?
আসিফ ইব্রাহিম, ডিরেক্টর, বিজিএমইএ
তিনি বলেন, “বড় দাগে দেখুন আমাদের অনেক জায়গায় কাজ করতে হবে। ১ নম্বর হচ্ছে আমাদের পণ্য বহুমুখিকরণের দিকে যেতে হবে। আমরা এখনও অতি মাত্রায় কটনের তৈরি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের মানুষের তৈরি আশের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। আমাদের ওভেন সেক্টরে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ আরও অনেক বাড়াতে হবে। যদি আমরা আমাদের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ আমরা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তাহলে আমাদের কাচামাল আমদানি নির্ভরতা কমবে। সুতরাং আমাদের টোটাল ভ্যালু চেইনের জন্য আমরা যদি একটি ব্যবস্থা নেই, তাহলে আবার আমরা ঘুরে দাড়াতে পারবো।”
এটা ঠিক রফতানি হিসেবের সার্বিক হিসেবেও অনুপাতে পিছিয়ে পড়েছে পোশকখাত। মহামারি পূববর্তী সময়ে রফতানির প্রায় ৮৪ শতাংশ জুড়ে যেখানে তৈরি পোশাকখাত ছিলো, সেখানে তা ৮১ শতাংশে নেমে এসেছে। একই সময়ে রফতানিতে এক বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছুয়েছে হোম টেক্সাটাইল। ভালো করছে পাট ও চামড়াজাত পণ্য। এটা কি বাংলাদেশের বাজারে ক্রেতা চাহিদা পরিবর্তনের লক্ষণ নাকি পণ্য বহুমুখিকরণের ফলাফল? বলছেন, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডি-র গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম।
ড. গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি
তিনি বলেন, “দেখুন পাট, পাট জাতীয়, চামড়া, চামড়া জাতীয় পণ্যের যে বিরাট বাজার রয়েছে তার তুলনায় আমরা যেটি রফতানি করছি সেটি প্রত্যাশার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। সুতরাং বিপুল বাজারের বিপুল বাজারের পটেলশিয়াল ধরে রাখতে হলে যে কাঠামোতে শিল্পগুলো চলছে সে কাঠামোরই পরিবর্তন দরকার।”
:পোশাকখাতের চ্যালেঞ্জ নিয়ে কী বলবেন?
“ব্রান্ড বায়ারের পক্ষ থেকে যে আগ্রহটা রয়েছে বাংলাদেশে সে আগ্রহটাও ধরে রাখার বিষয় রয়েছে বাংলাদেশের। কেন না দীর্ঘ সময় ধরে কারাখানাগুলো বন্ধ রাখলে আর্থিক দিক থেকেই সেটাকে সংস্থান করার সামর্থ বা কাঠামো নেই সরকারের হাতে।”
: সেক্ষেত্রে টিকাদান কার্যক্রম কত গুরুত্বপূর্ণ?
“আমরা যেটি দেখছি ঈদের আগেই ১২ হাজার শ্রমিককে টিকা দেওয়া হয়েছিলো, ৩ টি পোশাক কারাখানায়। এখন আবার নতুন করে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে পোশাক শ্রমিকদের ভিতরে। আমি অবশ্যই মনে করি টিকাদানের ব্যাপারটি এক্ষেত্রে কার্যকর। এবং সরকারের টিকা দেওয়ার যে প্রাধিকার আছে তাতে পোশাক শ্রমিকরা অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।”
এই গবেষক বলছেন, বিশ্ববাজারে অবস্থান ধরে রাখতে বন্দর ও কারাখানা ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, পণ্য আদেশ ও যোগান সহজিকরণ সর্বোপরি দরকার বিদেশি বিনিয়োগ। আর ব্যবসায়ীরাও বলছেন, সাময়িক নেতিবাচক সূচক থাকলেও ঠিকই মহামারি উত্তরণের পথ বের করে নিতে পারবেন তারা।