টোকিও অলিম্পিক গেমস এখন চলছে। খেলোয়াড়রা নিজের দক্ষতা প্রমাণ এবং নিজের দেশ ও জাতির মর্যাদা অর্জনের জন্য খেলার মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা অলিম্পিক গেমস-সংশ্লিষ্ট একটি প্রামাণ্যচিত্রের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। এ প্রামাণ্যচিত্রের প্রধান চরিত্রও একজন খেলোয়াড়, ২১ বছর আগে সিডনি অলিম্পিক গেমসের সময় ১০০ কোটি দর্শকের সামনে সাঁতার প্রতিযোগিতায় তিনি শেষ হন! তবে তার নাম অলিম্পিকের ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি করে। তিনি হলেন এরিক মুসাবানি, তাকে ঘিরে নির্মিত এ প্রামাণ্যচিত্রের নাম হলো ‘the eel’।
এরিক মুসাবানি, নিরক্ষীয় গিনির মানুষ। নিরক্ষীয়য় গিনির আয়তন মাত্র ২৮ হাজার বর্গকিলোমিটার।
অলিম্পিক স্টেডিয়ামে পা রাখার পর থেকেই এরিকের কৌতূহল শুরু হয়। যখন এরিক সুইমিং কেন্দ্রে প্রবেশ করছিলেন, তখন তিনি অবাক হয়ে যান। কারণ, তার জীবনে তিনি এই প্রথমবারের মতো প্রতিযোগিতার স্ট্যান্ডার্ড সুইমিং পুল দেখতে পেয়েছেন। তারপর তিনি প্রতিযোগীদের প্রশিক্ষণের দৃশ্য দেখে বুঝতে পারেন যে, সাঁতার বিষয়ে তিনি একদম অজ্ঞ!
তিনি ভাবছিলেন, অনেক কষ্ট করে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছেছেন। তাই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। তবে স্টেডিয়ামের নিরাপত্তা রক্ষীরা তাকে থামালেন। ‘একটু দাঁড়ান, আপনি এখানে কি করছেন?’ নিরাপত্তা রক্ষী তাকে জিজ্ঞাস করলেন। কারণ এরিক পেশাদার সাঁতারের পোশাক পরেন নি। তিনি টি-শার্ট ও ট্রাউজার্স পরেছেন।
তারপর দক্ষিণ আফ্রিকার একজন দয়ালু কোচ এরিককে সাঁতারের প্যান্ট ও গগলস দেন। সাঁতারের প্যান্টের সাইজ একটু বড় হলেও এরিক তা পরে প্রশিক্ষণ করতে পারবেন।
আনুষ্ঠানিক প্রতিযোগিতার দিন আসল। যখন এরিক সাঁতারের জন্য এলেন, তখন সারা স্টেডিয়ামে হাসির রোল পড়ে গেল। কারণ অন্য প্রতিযোগীরা সর্বাধুনিক আকর্ষণীয় সাঁতারের পোশাক পরেছেন। আর তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার কোচের দেওয়া সেই বড় প্যান্ট পরে এসেছেন।
আরো খারাপ বিষয় হলো, নিরক্ষীয় গিনি’র ক্রীড়া ব্যুরোর কর্মকর্তা তাকে জানালেন যে, তিনি পুরুষদের ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইলের প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছেন। তিনি পানিতে বেশিক্ষণ থাকতে পারেন না। একটানা শ্বাস ধরে রেখে ৫০ মিটার সাঁতার শেষ করতে পারেন। কিন্তু প্রতিযোগিতার আগ মুহূর্তে তিনি জানতে পারেন যে, ৫০ মিটার নয়- তাকে ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল প্রতিযোগিতায় লড়তে হবে। যেহেতু নিরক্ষীয় গিনি প্রথমবারের মতো অলিম্পিকের সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে, তাই এই ভুল হয়েছে।
দারুণ হতাশায় এরিক টেকঅফ প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালেন। বন্দুকের আওয়াজ হলো; এরিকের সঙ্গে অন্য দু’জন প্রতিযোগী উত্তেজিত হয়ে বন্দুকের শব্দের আগেই সুইমিং পুলে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাই তারা অযোগ্য বলে গণ্য হন। এরপর স্টেডিয়ামের ১৭ হাজার দর্শকের দৃষ্টি এরিকের ওপর পড়ে।
পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর দর্শকেরা দেখতে পারেন যে, এই প্রতিযোগী অন্যদের চেয়ে একটু ভিন্ন রকম। তার সাঁতারের ধরণও অসংযত; এমনকি তিনি ঠিকমত শ্বাস নিতে পারছেন না, তাই তার মাথা সবসময়ই পানির ওপরে রাখছেন। প্রথম ৫০ মিটার তিনি সুষ্ঠুভাবে শেষ করেন, তবে শেষ ৫০ মিটার তিনি করবেন? এখন পর্যন্ত তিনি কখনও ১০০ মিটার সাঁতার কাটেন নি। স্টেডিয়ামের ভাষ্যকার দর্শকদের বিষয়টি বুঝিয়ে দেন। সবাই যেন মুহূর্তে মুগ্ধ হয়ে যায়। দর্শকেরা আর হাসছেন না, তারা দাঁড়িয়ে এরিককে উত্সাহ দেওয়া শুরু করেন।
আস্তে আস্তে, ২০ মিটার, ১৫ মিটার, ১০ মিটার, ৫ মিটার— এভাবে বাকি ৫০ মিটারও সাঁতরে যান এরিক।
এটি হলো এরিকের জীবনে প্রথমবারের মতো ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল সাঁতার। কেউ কল্পনা করতে পারেন নি যে, জীবনের প্রথম ১০০ মিটার সাঁতার কেউ একজন অলিম্পিক স্টেডিয়ামে এসে সম্পন্ন করতে পারে!
১ মিনিট ৫২.৭২ সেকেন্ড! তিনিই তাঁর গ্রুপের প্রথম, কারণ তার গ্রুপে মাত্র তিনি একাই ছিলেন। এটি হলো অলিম্পিকের ইতিহাসে পুরুষদের ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইলের সবচেয়ে ধীর গতির রেকর্ড। ২০০ মিটারের বিশ্বরেকর্ডের চেয়েও যা ৭ সেকেন্ড কম। এটি নিরক্ষীয় গিনির সবচে ভালো ফলাফল। তবে, এই ফলাফল দিয়ে ফাইনাল প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারেন নি এরিক।
প্রতিযোগিতার পর সাংবাদিকরা এরিকের কাছে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের অনুভূতি জানতে চান। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি কখনই এত বড় সুইমিং পুল দেখি নি। আমি সত্যিই ভয় পেয়েছি।’
এরিকের গল্প খুব দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। জনগণ তাকে ‘দ্য ইল’ বলে ডাকেন। এরিক খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন স্পনসর তার জন্য হাজির হয় এবং সংবাদদাতারা চলে আসেন। ক্যামেরার সামনে তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন, এথেন্স অলিম্পিক, আমার জন্য অপেক্ষা করো।
অবশ্য, তখনও তিনি বুঝতে পারেন নি যে, সিডনি অলিম্পিক হলো তার প্রথম ও শেষ অলিম্পিক।
আসলে এরিকের সিডনির যাত্রা ছিল আকস্মিক ঘটনা। সে বছর আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি একটি দারিদ্র্যবিমোচনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরিকল্পনার উদ্দেশ্য হলো ক্রীড়া খাতের অনুন্নত দেশগুলোর খেলোয়াড়দের অলিম্পিকে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া।
সারা বিশ্বের সবচে অনুন্নত দেশ হিসেবে নিরক্ষীয় গিনি অলিম্পিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়। তখন মাত্র ২০ বছর বয়সী এরিক রেডিওতে এই খবর শুনে নিজের নাম তালিকাভুক্ত করেন।
তিনি ভাবছিলেন, ‘অলিম্পিকের মাধ্যমে কমপক্ষে আমি বিদেশে যেতে পারবো। আমি বিদেশ দেখতে চাই।’
সে বছর মাত্র সাত লাখ মানুষের আফ্রিকার সেই দেশে একটিও স্ট্যান্ডার্ড সুইমিং পুল ছিলো না। কেউ সত্যিকারভাবে সাঁতার কাটতে পারত না। তাই একমাত্র তিনিই তার নাম অন্তর্ভুক্ত করেন।
তারপর আরেকটি জরুরি সমস্যার সমাধান করতে হয়। তিনি সাঁতার কাটতে পারতেন না, প্রশিক্ষণের জায়গা ছিলো না, তার কোনো কোচও ছিলো না। সিডনি অলিম্পিক উদ্বোধনের আর মাত্র কয়েক মাস সময় বাকি ছিলো!
অনেক চেষ্টার পর তিনি একটি হোটেল খুঁজে পেলেন। সেই হোটেলের খুব ছোট একটি সুইমিং পুল আছে এবং এর দৈর্ঘ্য মাত্র ২০ মিটার। সুইমিং পুলের কর্মকর্তারা প্রতিদিনের ভোর ৫টা থেকে ৬টা পর্যন্ত সেখানে এক ঘণ্টা সাঁতার কাটার অনুমতি দেন।
কারণ এই পুলটি শুধু হোটেলের অতিথির জন্য খোলা থাকে।
সেই পুলের কর্মকর্তাই তার প্রথম শিক্ষক হয়ে ওঠেন।
তবে প্রতিদিন মাত্র এক ঘণ্টা প্রশিক্ষণ যথেষ্ট ছিলো না। কোনো উপায় না থাকায় তিনি প্রতিদিন হোটেল থেকে চলে যাওয়ার পর নদীতে বা সাগরে সাঁতার প্রশিক্ষণ শুরু করেন।
নদীতীরের জেলেরা তাকে শেখান।
এভাবে ২০০০ সালে সিডনি অলিম্পিক উদ্বোধনের ৫ দিন আগে এরিক ৫০ পাউন্ড এবং সেকেন্ড হ্যান্ড দোকান থেকে কেনা সবচে ভালো সরঞ্জাম নিয়ে অলিম্পিকের জন্য যাত্রা শুরু করেন। সে বছর নিরক্ষীয় গিনি থেকে মোট চারজন খেলোয়াড় অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এরিক সেদেশের প্রতিনিধি দলের পক্ষে পতাকা বহন করেন।
এরিক আগে কখনও বড় শহর দেখেন নি। এরকম বিশাল স্টেডিয়ামও দেখেন নি। প্রথমবারের মতো বড় শহরে এসে এরিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
দেশে ফিরে যাওয়ার পর এবারের অলিম্পিক যাত্রা তার কাছে বিরাট এক স্বপ্নের মতো মনে হয়।
সিডনির অভিজ্ঞতার কারণে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি তাকে সাহায্য করেন। তিনি পেশাগত সুইমিং পুলের অধিকারী হন এবং কোচও পান।
চার বছর পর তিনি সাফল্যের সঙ্গে ১০০ মিটার ফ্রইস্টাইল সাঁতার ৫৭ সেকেন্ডে সম্পন্ন করেন।
এথেন্স অলিম্পিক গেমসে এরিকও নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে নিরক্ষীয় গিনির অলিম্পিক কমিটির একটি ভুলের কারণে তিনি এথেন্স অলিম্পিক গেমসে অংশ নিতে পারেন নি।
২০০৬ সালে জার্মানির ডুসেলডর্ফ সাঁতার প্রতিযোগিতায় তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। মাত্র ৫২.১৮ সেকেন্ডে তিনি ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল সাঁতার সম্পন্ন করেন। এই ফলাফল ১৯৬৮ সালের আগের সব চ্যাম্পিয়নের রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে যায়। তবে খেলোয়াড় হিসেবে এটিই ছিল তার শেষ প্রতিযোগিতা।
তারপর এরিক আবার নিরক্ষীয় গিনিতে ফিরে যান। একদিকে তিনি চাকরি করতেন, অন্যদিকে তিনি পার্টটাইম কাজ হিসেবে শিশুদেরকে সাঁতার শেখাতেন।
২০১২ সালে এরিক আরেকটি নতুন পরিচয় পান। তিনি হলেন নিরক্ষীয় গিনির জাতীয় সাঁতার দলের কোচ।
তার প্রচেষ্টা ও আহ্বানে নিরক্ষীয় গিনিতে দুটি স্ট্যান্ডার্ড সুইমিং পুল তৈরি হয়। তিনি বলেন, ‘যখন আমি অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিতাম, তখন প্রশিক্ষণের জন্য কোনো সুইমিং পুল ছিলো না। বর্তমানে তরুণ তরুণীরা সুইমিং পুলে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার সময় আমার মতো তারা আর ভয় পাবে না। তবে অলিম্পিকে পদক জয় করা আমাদের জন্য অসম্ভব। অবশ্য, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ না। সবচে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো: আফ্রিকার আরো বেশি শিশু সাঁতার শিখবে এবং সাঁতার কাটার অধিকার ও স্বাধীনতা লাভ করবে।’
চলতি বছর টোকিও অলিম্পিক গেমসে নিরক্ষীয় গিনি থেকে মোট পাঁচজন খেলোয়াড় এসেছে এবং তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন সাঁতারু।
সিডনি অলিম্পিক গেমসে অংশ নেওয়ার সেই ঐতিহাসিক ভিডিও এরিক তার বাসায় রেখেছেন। সময় পেলেই তিনি নিজের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত দেখেন। চোখ বন্ধ করলেই মাথায় সেই দৃশ্য ভেসে ওঠে। সুইমিং পুলে আফ্রিকার একজন কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ প্রায় ডুবে ডুবে সাঁতার কাটছে, জীবন বাঁচানোর মতো করে প্রতিযোগিতা সম্পন্ন করেছে!
এটি হলো এরিকের খুবই ছোট একটি পদক্ষেপ, তবে অসংখ্য আফ্রিকান শিশুর বিশ্ব দেখার বড় একটি পদক্ষেপ।
অলিম্পিকের জনক হিসেবে পরিচিত ব্যারোন পিয়েরে দে কুবার্তে বলেছিলেন, অলিম্পিক গেমসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিজয়ী হওয়া নয়, বরং অংশগ্রহণ করা।
যেমন, জীবনের সবচে প্রয়োজনীয় বিষয় বিজয়ও নয়, বরং কঠোর পরিশ্রম করা।
লিলি/তৌহিদ/শুয়েই