সেই পর্বত, সেই গহীন রাত, সেই বিজয়ীদের গল্প
2021-08-04 13:54:45

সেই পর্বত, সেই গহীন রাত, সেই বিজয়ীদের  গল্প

সেই পর্বত, সেই গহীন রাত, সেই বিজয়ীদের  গল্প_fororder_zhu5

আজকের গল্প, বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত ছুমোলোংমা শৃঙ্গ বা মাউন্ট এভারেস্টের উত্তর ঢালের ‘দ্বিতীয় সিঁড়ি’ থেকে শুরু করবো। ১৯৬০ সালের ২৪ মে, বিকাল চারটা। তখন চীনের পর্বতারোহী দলের চারজন পর্বতারোহী- ওয়াং ফু চৌ, কুং বু, ছুই ইন হুয়া এবং লিউ লিয়ান মান ছুমোলোংমা শৃঙ্গের চূড়ায় উঠার চেষ্টা করছিলেন। তাঁরা একটি খাড়া উঁচু পর্বতের নিচে কয়েক ঘণ্টা ধরে আটকে রয়েছেন। চারজন খাড়া উঁচু এক ছোট ঢালে সাত মাত্রার প্রচণ্ড বাতাসে প্রতিকুল অবস্থার সঙ্গে কঠিন লড়াই করছিলেন।

 

এর আগের প্রায় চার ঘণ্টা তাঁরা চারজন বার বার চোখের সামনের এই ‘দ্বিতীয় সিঁড়ি’ নামে ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলের এই খাড়া ঢাল অতিক্রম করার চেষ্টা করেন, তবে বার বার চেষ্টার পরও ব্যর্থ হন। এই ঢালের উচ্চতা ৫ মিটার, হাতে ধরে বা পা রেখে উপরে ওঠার কোনো জায়গা নেই। একেবারে স্লাইডের মতো মসৃণ। আর ওই অঞ্চলটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৬০০ মিটার উঁচুতে। সেখানে প্রতিটি ধাপ হাঁটাও অনেক কষ্টকর। আর তাঁদের  সবাই খুব ভারি পোশাক ও সরঞ্জাম বহন করছেন। তাই এই ঢাল পার হওয়া আকাশে ওঠার মত কঠিন ব্যাপার।

সেই পর্বত, সেই গহীন রাত, সেই বিজয়ীদের  গল্প_fororder_zhu2

পর্বতারোহী দলের প্রধান ওয়াং সবাইকে জিজ্ঞেস করেন: সবাই শুনুন, আকাশ অন্ধকার হয়ে যাবে, আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলেছে যে, আগামীকাল আবহাওয়া আরও খারাপ হবে। তাই আজই হল আমাদের ছুমোলোংমা শৃঙ্গের চূড়ায় ওঠার চূড়ান্ত দিন। তোমরা বলো, কী করবো আমরা?

ছুই বলেন: আমি ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাওয়ার কোনো প্রস্তুতি নেই নি।

তিব্বতি সদস্য কুংবু বলেন: উপরে উঠলে অথবা নিচে নামলে একই রকম বিপদে পড়বো, তাই মৃত্যু হলেও আমি চূড়াতে উঠবো।

সদস্য লিউ বলেন: এখন সবচেয়ে জরুরি ব্যাপার হল- এই ঢাল পার হওয়া। আমাদের পদ্ধতি পরিবর্তন করা উচিত।

লিউ আগে দমকলকর্মী ছিলেন, তিনি একটি প্রস্তাব দেন। সবাই মিলে একটি মানব-মই তৈরি করা। তিনি সবচেয়ে নিচে, তার ওপরে একজন, এভাবে একজন উপরে উঠে যাবে। সবাই ওঠার পর নিচের জন আবার উপরে উঠবে।

 

কিন্তু দলের প্রধান ওয়াং এর বিরোধিতা করেন: আমাদের জুতায় লোহার পেরেক বসানো, তোমার কাঁধ এতে আহত হবে।

লিউ বলেন: এমন জরুরি মুহূর্তে আহত হওয়া কোনো বিষয় না। আমি কেয়ার করি না।

তবে, ছুই নিজের জুতো খুলতে শুরু করেন। জুতো থাকলে লিউ-এর কাঁধে চাপ লেগে আহত হয়ে যাবে।

এদিকে লিউ এর বিরোধিতা করেন। এমন ঠান্ডায় জুতো না পরলে পা জমাট বেঁধে যাবে। কিন্তু ছুই সে কথায় কান দেন না; তিনি মোজাও খুলে ফেলেছেন। তারপর লিউ-এর কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়ান।

 

লিউ পিঠে পাহাড়ে ভর দিয়ে অনেক কষ্ট করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তারপর ছুই পাথরের দেয়ালে পেরেক লাগানো শুরু করেন, যাতে অন্যরা আরো সহজে পেরেক লাগিয়ে পাহাড়ে উঠতে পারে। এ কাজ সাধারণ অবস্থায় কয়েক মিনিটের কাজ; কিন্তু এমন উঁচু পাহাড়ে ও প্রচণ্ড ঠান্ডায় ছুই-এর এক ঘণ্টা সময় লেগে যায়! যখন কাজ শেষ হয়; তখন বিকাল ৫টা।

 

পেরেক গাঁথার পর ছুই সহজেই ‘দ্বিতীয় সিঁড়ি’তে উঠে যান। তারপর ওয়াং এবং কুংবু পৃথক পৃথকভাবে লিউ-এর কাঁধে ভর দিয়ে উপরে উঠতে পারেন। তবে লম্বা সময় ধরে পরিশ্রম করে লিউ-এর সব শক্তি যেন শেষ হয়ে যায়। যখন তিন সঙ্গী উঠে যান, তখন লিউ আর সহ্য করতে না পেরে মাটিতে পড়ে যান।

তিন সঙ্গী দড়ি দিয়ে বেঁধে লিউকে টেনে উপরে তুলে নেন।

সেই পর্বত, সেই গহীন রাত, সেই বিজয়ীদের  গল্প_fororder_zhu3

এখন চার জনের চোখের সামনে আবারও একটি ঢাল, ঢালের উপরে হল তুষারমৌলি পর্বত। স্থানটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৬০০ মিটার উঁচুতে। আর পর্বতের চূড়া থেকে মাত্র দুইশ’ মিটার দূরত্বে। এই দুইশ’ মিটার পুরো পর্বতের তুলনায় খুব কম, কিন্তু তা আসলে ৫০ তলা ভবনের সমান, খুব কঠিন অংশ।

 

এখন চারজন পর্বতারোহীর প্রত্যেকের শুধু দুই সিলিন্ডার অক্সিজেন আছে। চারজন আবার সামনে যেতে শুরু করেন। লিউ সবার সামনে। চারজন ১৯৬০ সালের ২৪ মে-এর শেষ সূর্যালোকে এক ধাপ এক ধাপ করে এগিয়ে চলছেন। সন্ধ্যা ৭টায় সূর্যাস্ত হয়েছে, আকাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। সামনে যাওয়া আরো কঠিন হয়ে পড়েছে।

 

এমন সময় সবচেয়ে সামনের লিউ হঠাত্ পড়ে যান। তিনজন কাছে গিয়ে দেখেন, লিউ-এর চোখ বন্ধ, মুখ অস্বাভাবিক সাদা, ঠোঁট বেগুনি রং ধারণ করেছে। সঙ্গীদের চেষ্টায় লিউ আবার চোখ খুলে তাকান, তিনি দুর্বল কণ্ঠে বলেন: আমি আর এগিয়ে যেতে পারবো না, তোমরা আমাকে ছাড়া সামনে এগিয়ে যাও।

তিনজন লিউকে একটি নিরাপদ ও তুলনামূলক কম ঠাণ্ডা স্থানে নিয়ে যান। তাঁকে ভালোমতো রাখেন। তারপর তিনজন আবার সামনে এগিয়ে যেতে শুরু করেন।

 

সেদিন রাতের আকাশ ছিল পরিষ্কার, লিউ শুয়ে শুয়ে নিজের ছোটবেলার কথা স্মরণ করেন। ছোটবেলায় তাঁর বাবা মারা যান। ১৩ বছর বয়সে লিউ জমিদারের জন্য কাজ করতেন। তখন তিনি ভাবতেন, যদি নিজেই ভালোভাবে পরিশ্রম করি, তাহলে জীবন নিশ্চয় ভালো হয়ে উঠবে। তবে তিনি বছরের ৩৬৫ দিন পশুর মতো পরিশ্রম করতেন। কিন্তু তিনি ও তাঁর মা জমিদারের নির্যাতন থেকে বের হতে পারেন নি। ১৯৪৯ সালে নয়া চীন প্রতিষ্ঠার পরই লিউ-এর পরিবার অবশেষে দরিদ্রতা ও ক্ষুধামুক্ত হয়।

সেই পর্বত, সেই গহীন রাত, সেই বিজয়ীদের  গল্প_fororder_zhu4

১৯৫১ সালে ১৮ বছর বয়সী লিউ হেই লুং চিয়াং প্রদেশের হারবিনের একটি কারখানায় কাজ করতেন। ১৯৫৪ সালে তিনি দমকল প্রশিক্ষণ ক্লাসে অংশগ্রহণ করেন এবং কারখানার দমকলকর্মী হিসেবে কাজে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তাঁর শারীরিক অবস্থা খুব ভালো ছিল। সে সময় তাকে চীনের পর্বতারোহী দলের সদস্য হিসেবে নির্বাচন করা হয়।

১৯৫৬ সালের এপ্রিল মাস পরবর্তী এক বছরে লিউ বহুবার বিভিন্ন উঁচু উঁচু পাহাড় ও পর্বত জয় করেছেন।

এত বছরের কষ্টকর জীবনের কথা স্মরণ করে লিউ মনে করেন, এবার হয়তো তিনি এই পর্বতে মারা যাবেন; তাই তিনি তাঁর অন্তিম চিঠি লিখতে শুরু করেন: দেশ আমাকে যে কর্তব্য দিয়েছে, আমি তা সম্পন্ন করতে পারি নি। আমার প্রিয় সঙ্গীরা, তোমরা তিনজন তা সম্পন্ন করবে। আমার কাছে আরো কিছু অক্সিজেন আছে, তোমরা তিনজন কাজ শেষ করার পর তা ব্যবহার করো।

লেখা শেষ করে লিউ অক্সিজেনের বোতল বন্ধ করে চোখ বন্ধ করেন।

 

অন্যদিকে, বাকি তিনজন ৯ ঘণ্টা চেষ্টার পর অবশেষে ‘বিশ্বের চূড়া’য় গিয়ে দাঁড়ান।

তিনজন ব্যাগ থেকে পাঁচতারা খচিত লাল পতাকা বের করেন। তারপর ওয়াং একটি ‘ডায়েরি’ নিয়ে সেখানে লিখেন: ওয়াংফুচৌসহ তারা তিনজন ছুমোলোংমা শৃঙ্গ জয় করেছেন। ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন ১৯৬০ সালের ২৫ মে; আর ঘড়িতে ভোর ৪টা ২০ মিনিট।

 

তিনজন বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু স্থানে ১৫ মিনিট থাকেন। তারপর নামতে শুরু করেন। নামার পথে ছুই ক্যামেরা দিয়ে কিছু ভিডিও করেন। এ কারণে তিনি গ্লভস্‌ পরেন নি। তাই প্রচণ্ড ঠান্ডায় তার দুই পায়ের দশটি আঙুল এবং ডান হাতের এক আঙুল জমে নষ্ট হয়ে যায়।

সেই পর্বত, সেই গহীন রাত, সেই বিজয়ীদের  গল্প_fororder_zhu1

যখন তাঁরা ‘দ্বিতীয় সিঁড়ি’তে ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন সূর্যোদয় হয়। হঠাত্ তাঁরা দেখেন যে, লিউ তাঁদেরকে হাতছানি দিয়ে ডাকছেন।

আসলে, লিউ নিজের অক্সিজেন বন্ধ করার পর অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। সমুদ্রপৃষ্ঠের ৮৭০০ মিটার উঁচুতে পুরো রাত ঘুমানোর পর ভোরে তিনি জেগে ওঠেন এবং দাঁড়াতে সক্ষম হন।

চার পর্বতারোহী আবারও মিলিত হন। লিউ নিজের অন্তিম চিঠি তাঁদেরকে দেখান, চারজন হাউ মাও করে কাঁদতে শুরু করেন।

 

১৯৬০ সালের ২৪ ও ২৫ মে, চীনের পর্বতারোহী দল এবারের পর্বত আরোহণের দায়িত্ব সম্পন্ন করেন। এটা হল মানবজাতির প্রথমবারের মতো উত্তর ঢাল দিয়ে ছুমোলোংমা পর্বত আরোহণের ঘটনা। এর আগে অনেক বিদেশি পর্বতারোহী দল ‘দ্বিতীয় সিঁড়ি’ পর্যন্ত গিয়ে আর উপরে উঠতে পারে নি। তবে চীনা পর্বতারোহী দল তা অতিক্রম করতে সক্ষম হন।

১৯৭৫ সালে চীনা পর্বতারোহী দল আবারও উত্তর ঢাল দিয়ে ছুমোলোংমা পর্বত বা মাউন্ট এভারেস্ট আরোহণ করে। ‘দ্বিতীয় সিঁড়ি’তে লোহার সিঁড়ি স্থাপন করা হয়। যাতে পরবর্তীতে মানুষ সহজে উঠতে পারে। এই সিঁড়িকে ‘চীনা সিঁড়ি’ নাম দিয়েছে সবাই।

এরপর ওয়াং সবসময় পর্বতারোহণের কাজ এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও নেতার কাজ করেন। তিনি একসময় চীনের পর্বতারোহী সমিতির চেয়ারম্যানও হন।

পরবর্তীতে, কুংবু তিব্বতের বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণের কাজে করতেন। তিনি তিব্বতের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সমিতির উপপ্রধান হয়েছেন।

পরে, ছুই ইন হুয়া বিভিন্ন স্থানে ক্রীড়া খাতে কাজ করেছেন, তিনি এক সময় চীনের পর্বতারোহী সমিতিতেও কাজ করেছিলেন।

 

অন্যদিকে, লিউ লিয়ান মাও ১৩ বছর ধরে পর্বতারোহণের কাজ করেছেন। তিনি তিব্বতের পর্বতারোহণ ক্যাম্প তৈরির কাজে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৬৩ সালে নয়া চীন প্রতিষ্ঠার ১৪ বছর পূর্তিতে, তিনি তখন চীনের প্রেসিডেন্ট মাও সে তুং-এর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান। তিনি একই সঙ্গে ১ অক্টোবর জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে অংশ নেন। ১৯৭৩ সালে অসুস্থ স্ত্রীর যত্ন নেওয়ার জন্য লিউ লিয়ান মান কাজ ছেড়ে দেন। ২০১৬ সালে লিউ লিয়ান মান চীনের হেই লুং চিয়াং প্রদেশের হারবিন শহরে মারা যান। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।

এক টিভি সাক্ষাত্কারে লিউ লিয়ান মান বলেন, আমার এ জীবনে সবচেয়ে অনুতাপের বিষয় হল, ছুমোলোংমা শৃঙ্গের চূড়ায় উঠতে না পারা।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)