৪৪তম বিশ্ব ঐতিহ্য সম্মেলন ১৬ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত চীনের ফুচিয়েন প্রদেশের ফুচৌ শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছে। চীন ১৯৮৫ সালে ‘বিশ্বের সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা কনভেনশন’-এ যোগ দিয়েছে। বর্তমানে ছুয়ান চৌ-সহ চীনের মোট ৫৫টি বিশ্ব ঐতিহ্য রয়েছে। চীন হলো অসংখ্য বিশ্ব ঐতিহ্যের অধিকারী দেশ। চীন বিশ্ব ঐতিহ্য খাতের বৈশ্বিক প্রশাসনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। চীন চারবার বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছে, বিশ্ব ঐতিহ্য খাতে বৈশ্বিক প্রশাসনে অবদান রেখেছে। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ খাতে ইউনেস্কোর ‘আফ্রিকা অগ্রাধিকার’ কৌশল বাস্তবায়নে সমর্থন দিয়েছে এবং আফ্রিকাকে ঐতিহ্য রক্ষায় সহায়তা দিয়েছে চীন। চীনও কম্বোডিয়া, কেনিয়া, নেপালসহ বিভিন্ন দেশকে ঐতিহ্য রক্ষা ও পুনরুদ্ধারে সমর্থন জানায়।
বন্ধুত্বপূর্ণ ইতিহাসের সাক্ষ্য আবিষ্কার:
২০১০ সালে চীন ও কেনিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে কেনিয়ার ভূমি ও পানির নীচে যৌথ প্রত্নতত্ত্ব অনুসন্ধান প্রকল্প শুরু করে। যা চীনের জাতীয় যাদুঘর, বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ আর্কিওলজি অ্যান্ড কালচারাল সায়েন্স ও কেনিয়ার জাতীয় যাদুঘর যৌথভাবে সম্পন্ন করেছে। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রকল্পের তহবিল জোগান দিয়েছে। চীনের প্রত্নতাত্ত্বিক দল প্রথমবারের মত বিদেশে মাটি ও পানির নীচে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন অভিযান চালিয়েছে। বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ আর্কিওলজি অ্যান্ড কালচারাল সায়েন্স-এর অধ্যাপক ছিন তাসুয়ের নেতৃত্বে দুই দেশের বিশেষজ্ঞরা তিন বছরের চেষ্টায় কেনিয়ার মালিন্দি ও লামু দ্বীপপুঞ্জের ভূমি ও পানির নীচে হারিয়ে যাওয়া সাংস্কৃতিক পুরাকীর্তি, সাইট, ধ্বংসাবশেষের উপর পদ্ধতিগত পরীক্ষা, খনন ও গবেষণা করেছেন এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য খুঁজে পেয়েছেন। এটি প্রাচীন চীনা ও আফ্রিকান সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিনিময়ের ইতিহাসের সন্দেহকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে; যেমন, প্রাচীন পূর্ব-আফ্রিকার মালিন্দি রাজ্য এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে চেং হ্য’র পূর্ব আফ্রিকার ল্যান্ডিং পয়েন্ট ইত্যাদি।
মিং রাজবংশের ইয়ং ল্য খ্রিস্টাব্দ ১৪১৪ সালে, ঝেং হ্য সুচৌয়ের লিউচিয়া বন্দর থেকে একটি জাহাজ বহর নিয়ে চতুর্থবার সমুদ্রযাত্রা করেন। জানা গেছে, এবারের সমুদ্রযাত্রায় ঝেং হ্য’র জাহাজ দল ‘মালিন রাষ্ট্র’-এ পৌঁছেছে, যা এখন কেনিয়ার মালিন্দি শহর। চীন ও কেনিয়া সরকারের যৌথ প্রত্নতাত্ত্বিক প্রকল্পের মালিন্দির মানব্রুই অঞ্চল হলো প্রত্নতত্ত্ব খননের প্রধান স্থান। প্রত্নতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক পুরাকীর্তি রক্ষায় সহযোগিতা করার বিষয়ে কেনিয়ার নাইরোবি জাতীয় যাদুঘরের পরিচালক মুজালান্দো কিবেনজা বলেন, “আমাদের চীনের সাথে অনেক সহযোগিতা চলছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো কেনিয়ার লামু ও মালিন্দি অঞ্চলে চীন ও কেনিয়ার যৌথ প্রত্নতত্ত্ব গবেষণা। আমরা পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে ডুবে যাওয়ার প্রাচীন চীনা জাহাজগুলি উদ্ধার করার চেষ্টা করেছি, যা ৬০০ বছরেরও বেশি সময় আগে চীন-কেনিয়া বিনিময়ের ইতিহাস ধারণ করে। চীনের যাদুঘর ও স্মারক ব্যবস্থাপনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আছে। চীন কেনিয়াকে প্রচুর সহায়তাও দিয়েছে। আমাদের বেশ কিছু যাদুঘরের কর্মচারী আছে তারা প্রশিক্ষণের জন্য চীনে গিয়েছেন, চীনের প্রচুর গবেষণা রয়েছে এবং আমাদের প্রচুর প্রাসঙ্গিক উন্নত সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে চীন। আমরা উপাদান বিশ্লেষণসহ বিভিন্ন ফ্রন্টলাইন প্রযুক্তি সম্পর্কে জানার জন্য কর্মীদের চীনে পাঠিয়েছি। আমাদের সহযোগিতার রাস্তা আরও এগিয়ে যাবে।”
ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলিকে তাদের পূর্বের গৌরবে ফিরিয়ে আনা:
কম্বোডিয়ার অ্যাংকর মনুমেন্টস (Angkor Monuments) ১৯৯২ সালে বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৯৩ সালে কম্বোডিয়া সরকার ও ইউনেস্কোর যৌথ উদ্যোগে ‘অ্যাংকর মনুমেন্টস সংরক্ষণ’ প্রকল্প শুরু হয়। এতে দশটিরও বেশি দেশ থেকে ধারাবাহিক তহবিল ও প্রযুক্তিগত সহায়তা এসেছে। অ্যাংকর মনুমেন্টস সংরক্ষণ পদক্ষেপ প্রথম দফার আন্তর্জাতিক উদ্যোগের মধ্যে একটি। চীন গত শতাব্দীর ৯০ দশক থেকে অ্যাংকর মনুমেন্টস সংরক্ষণ পদক্ষেপে অংশ নেয় এবং কম্বোডিয়ায় ধসে পড়া ও ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির ও প্রাচীন ভবন মেরামতে সাহায্য করে। এখন পর্যন্ত দু’টি মন্দির মেরামতে প্রকল্প শেষ হয়েছে।
ছাউসে তেভোদা মন্দির ১১ শতাব্দীর শেষ থেকে ১২ শতাব্দীর প্রথমার্ধে নির্মিত হয়। এটি একটি হিন্দু মন্দির। মন্দিরের প্রধান ভবন প্রায় ২৫০০ বর্গমিটার। এটি কম্বোডিয়ার স্থাপত্য ও আর্টসের দুর্দান্ত প্রতিনিধিত্বকারী স্থাপনা। ১৯৯৮ সালে চীনের জাতীয় পুরাকীর্তি ব্যুরো আনুষ্ঠানিকভাবে চীনের পুরাকীর্তি গবেষণালয়কে (বর্তমানে চীনা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গবেষণালয়) অ্যাংকর মনুমেন্টসের ছাউসে তেভোদা মন্দির রক্ষা ও পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব দেয় এবং চীন কম্বোডিয়ার অ্যাংকর মনুমেন্টসের রক্ষাকারী দল প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি হলো চীনের সাংস্কৃতিক পুরাকীর্তি রক্ষা দলের বিদেশে গিয়ে সাংস্কৃতিক পুরাকীর্তি রক্ষার জন্য চীন সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম বৈদেশিক সহায়তা প্রকল্প। প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে আট বছর লেগেছে। কর্মদল কম্বোডিয়া ও ইউনেস্কোর সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলির উচ্চ পর্যায়ে প্রশংসিত হয়েছে। চীনের প্রত্নতাত্ত্বিক দলের সদস্য স্যু ইয়েন অ্যাংকর মনুমেন্টস সংক্ষরণে অসামান্য অবদানের জন্য কম্বোডিয়া রাজ্যের নাইটস উপাধি পেয়েছেন।
২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে, কম্বোডিয়ায় চীনের বিশ্ব ঐতিহ্য সংরক্ষণ সহায়তা প্রকল্পের তৃতীয় দফার কাজ শুরু হয়। এটি প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ পুনরুদ্ধার প্রকল্প। রাজকীয় প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ হলো অ্যাংকর মনুমেন্টসের মূল অংশ। চীনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গবেষণালয় প্রতিনিধিত্বকারী চীনা দল প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঝুঁকি মূল্যায়নের কাজ করার জন্য প্রাসাদে যায় এবং ১১ বছর সময় দিয়ে অ্যাংকর রাজবংশের গৌরব পুনরুদ্ধারের কাজ করে।
কম্বোডিয়ার অ্যাংকর মনুমেন্টস রক্ষা ও ব্যবস্থাপনা সংস্থার মুখপাত্র লোং কোসাল (Long Kosa) এক সাক্ষাত্কারে বলেন, অ্যাংকর মনুমেন্টস মেরামত কাজে সহায়তা হলো বিশ্ব ঐতিহ্য রক্ষায় চীনের অবদান। কম্বোডিয়া চীনা প্রত্নতাত্ত্বিক দলের প্রযুক্তি, ধারণা, মনোভাবের দারুণ প্রশংসা করে। অ্যাংকর মনুমেন্টস রক্ষার কাজে কেবল পুরাকীর্তি মেরামতে চীনের বড় অবদানই নয়, চীনও কম্বোডিয়ার অনেক পুরাকীর্তি মেরামতে বিশেষজ্ঞ সহায়তা দিয়েছে। যা প্রাচীন মন্দির রক্ষায় নতুন ধারণা, নতুন প্রযুক্তিগত সুবিধা এনে দিয়েছে।
সাংস্কৃতিক বিনিময়ের কিংবদন্তি লিখতে থাকা:
নেপালের নয়তলা মন্দির নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর দরবার স্কয়ারে অবস্থিত। এ মন্দিরের ৪০০ বছরেরও বেশি সময়ের ইতিহাস আছে। এটি হলো ‘কাঠমান্ডু উপত্যকা’ বিশ্ব সাংস্কৃতিক হেরিটেজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নয়তলা মন্দির হলো নেপালের প্রাচীনতম রাজকীয় প্রাসাদ। এর সামগ্রিক নির্মাণ এলাকার আয়তন ৫৬০০ বর্গমিটার। এর মূল ভবনের নয়তলা টাওয়ারের উচ্চতা ৩১ মিটারেরও বেশি। ২০১৫ সালে নেপালে ৮.১ মাত্রার ভূমিকম্পে নয়তলা মন্দিরটি গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কিছু অংশ ভেঙে পড়ে।
২০১৭ সালের অগাস্ট মাসে চীন সরকার নেপালের দরবার স্কয়ারের নয়তলা মন্দির মেরামতে সহায়তা প্রকল্প শুরু করে। এটি হলো নেপালকে চীন সরকারের বিনামূল্য সহায়তা দেন। এটি নেপালে চীনের প্রথম বড় আকারের পুরাকীর্তি মেরামত সাহায্য প্রকল্প। বর্তমানে নয়তলা মন্দির প্রকল্পের নির্মাণ ও মেরামত কাজের অংশটি মূলত শেষ হয়েছে।
প্রকল্পটির নির্বাহী পক্ষ চীনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গবেষণালয়ের উপ-পরিচালক স্যু ইয়েন বলেন, এই প্রকল্প মূলত ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা ছিল। বর্তমানে প্রকল্পের নির্মাণ ও মেরামতের মূল কাজ শেষ হয়েছে। তবে মহামারীর কারণে পরবর্তী অভ্যন্তরীণ প্রদর্শনী এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিরোধ প্রকল্প সাময়িকভাবে থামে এবং মহামারির পর তা অব্যাহত থাকবে। ভবিষ্যতে প্রকল্পের অগ্রগতি মহামারি নিয়ন্ত্রণের ওপর নির্ভর করে। স্যু ইয়েন চীন ও নেপালের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ভালো স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, “ইউয়ান রাজবংশে নেপালের মিস্ত্রী আনিকো বেইজিংয়ের বাইথা মন্দিরসহ কয়েকটি বিখ্যাত মন্দির তৈরি কাজে অংশ নিয়েছিলেন। চীন একটি সাংস্কৃতিক পুরাকীর্তি বড় দেশ। আজ চীনের সাংস্কৃতিক পুরাকীর্তি কর্মীরা কয়েক দশক ধরে সাংস্কৃতিক পুরাকীর্তি রক্ষার কাজে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে এবং এই অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে নেপালকে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত সাংস্কৃতিক পুরাকীর্তি মেরামতে সাহায্য করেছে এবং ভাল ফলাফল অর্জন করেছে।”
নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবি ভান্ডারি বলেছেন, নয়তলা মন্দির প্রকল্প প্রাচীন নেপালের ধর্মীয় শিল্পকে আধুনিকতার সঙ্গে যুক্ত করেছে এবং সাংস্কৃতিক পুরাকীর্তি প্রতিরক্ষামূলক পুনরুদ্ধারের ধারণা উন্নত করেছে।