‘দুটি ক্ষেপণাস্ত্র একটি উপগ্রহ’: চীনা বিজ্ঞানী ওয়াং সি জি’র শততম জন্মবার্ষিকী
2021-08-03 16:13:41

সম্প্রতি চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একাডেমির শিক্ষাবিদ, চীনের মহাশূন্য বিজ্ঞান প্রযুক্তি গ্রুপের পঞ্চম একাডেমিক উপদেষ্টা জনাব ওয়াং সি জি তাঁর শততম জন্মবার্ষিকী পালন করেন। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সমান বয়সের সিনিয়র শিক্ষাবিদ তিনি। তিনি চীনের মহাকাশ প্রযুক্তির উন্নয়ন ও মানবজাতির কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি চীনের মহাকাশ প্রযুক্তির প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তাদের অন্যতম এবং ‘দুটি ক্ষেপণাস্ত্র, এক উপগ্রহ’ পদক বিজয়ীদের অন্যতম। আজকের আসরে আমরা শত বছরের চীনা বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ওয়াং সি জি’র গল্প তুলে ধরবো।

২০২১ সালের ২৬ জুলাই শিক্ষাবিদ ওয়াং সি জি’র শততম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়। তাঁর ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীরা একসাথে ওয়াংকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান।

‘দুটি ক্ষেপণাস্ত্র একটি উপগ্রহ’: চীনা বিজ্ঞানী ওয়াং সি জি’র শততম জন্মবার্ষিকী_fororder_wxj

৬০ বছর আগে শিক্ষাবিদ ওয়াংসহ বিশেষজ্ঞদের যৌথ প্রয়াসে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রথম রকেট টি-৭এম সাফল্যের সঙ্গে মহাকাশে উত্ক্ষেপণ করা হয়। ১৯৫৮ সালে শিক্ষাবিদ ওয়াং সি জি চীনা কমিউনিস্ট পার্টিরতে যোগ দেন এবং নিজের বুদ্ধি ও মেধা দিয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। যখন তিনি অধ্যাপক হিসেবে পূর্ব জার্মানিতে কাজ করার সুযোগ পান, ঠিক তখনই সরকারের পক্ষ থেকে তাকে শাংহাই যান্ত্রিক ও বৈদ্যুতিক ডিজাইন ইনস্টিটিউটে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

ওয়াং তখন শান্তভাবে বলেন, ‘সিপিসির সদস্য হিসেবে আমি বিনাশর্তে সরকারের নির্দেশ মেনে নিলাম।’ ১৯৫৮ সালের নভেম্বর মাসে তিনি শাংহাই যান্ত্রিক ও বৈদ্যুতিক ডিজাইন ইনস্টিডিউটের মহাপ্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন থেকে চীনের শক্তিশালী উন্নয়ন ও জাতীয় পুনরুত্থানে অবদান রাখাকে নিজের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।

আসলে জনাব ওয়াং’র কর্মস্থল চীনের গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণা সংস্থাগুলোর অন্যতম। এর কার্যালয় শাংহাইয়ের ব্যবসায়ী এলাকার কাছে অবস্থিত। অনেকেই জানেন না, এ প্রতিষ্ঠানের আসল কাজ কী। কয়েক দশক আগে কম্পিউটার ছিল পুরোপুরি ম্যানুয়েল। একটি ক্ষেপণাস্ত্রসংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত হিসাব করতে কয়েক জনকে দিন-রাত কয়েক মাস ধরে কাজ করতে হতো; হিসাবের কাগজপত্রে টেবিল ভরে যেতো। এমন পরিস্থিতিতে চীনের প্রথম সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ডিজাইন ও নির্মাণের তরল রকেট টি-৭এম মহাশূন্যে ওড়ানো হয়। রকেটটির পাল্লা ছিল ৮০০০ মিটার। তখন থেকে প্রায় ১০ বছর ধরে গবেষণা কাজের পর বিজ্ঞানী ওয়াং সি জি লংমার্চ-১ পরিবাহী রকেট ডিজাইন করেন। আসলে, সে গবেষণার বিষয়ের সাথে তাঁর পরিচিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অনেক পার্থক্য ছিল। তাকে তখন নতুন করে অনেককিছু শিখতে হয়েছে, বুঝতে হয়েছে। দেশের উন্নয়নের চাহিদা মেটাতেই তিনি তা করেছিলেন।

১৯৭০ সালের ২৪ এপ্রিল রাত ৯টা ৩৫ মিনিটে লংমার্চ-১ রকেট চীনের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘তুংফাংহুং’ নিয়ে মহাশূন্যে নিক্ষেপিত হয়। ১৫ মিনিট পর সাফল্যের সঙ্গে উপগ্রহটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে প্রবেশ করে। এর মাধ্যমে চীন স্বাধীনভাবে উপগ্রহ তৈরি ও নিক্ষেপ করার যোগ্যতাসম্পন্ন বিশ্বের পঞ্চম দেশে পরিণত হয়।

১৯৯৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে চীনের সেরা ও শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের মধ্যে পদক বিতরণ করা হয়। তখন চীনের রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র গবেষণার গোপনীয় বিষয় সবার সামনে তুলে ধরা হয় এবং চীনারা বিজ্ঞানী ওয়াং’র মতো অনেক সেরা বিজ্ঞানীর সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পায়।

১৯২১ সালে ইয়ুননান প্রদেশের রাজধানী খুনমিং শহরে জন্মগ্রহণ করেন ওয়াং সি জি এবং সাউথওয়েস্ট ইউনাইডেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। যুবকাল থেকেই তিনি গবেষণার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন।

চীনের প্রথম উপগ্রহের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে তিনি এ উপগ্রহের গবেষণাকাজে বিপুল অবদান রাখেন। অনেক কষ্ট ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তিনি উপগ্রহের প্রযুক্তি আয়ত্ত করেন এবং চীনও এ প্রযুক্তি অর্জনকারী বিশ্বের তৃতীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয়। যদিও গত শতাব্দীর ৭০-এর দশকে চীনের অর্থনীতি দুর্বল আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিও অনুন্নত ছিল, তথাপি সেসময় পরিশ্রম ও সাধনার মাধ্যমে অনেক সাফল্য অর্জন করেন অধ্যাপক ওয়াং।

এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমরা যখন উপগ্রহ নিয়ে গবেষণা করি, তখন ওয়্যারলেস প্রযুক্তি আর ডিজিটাল প্রযুক্তি ছিল না। তখন উপগ্রহ নিক্ষেপের ফলাফল দেখতে রকেটের ভূমিতে ফেরত আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। তাই, এ কাজে সফলতার জন্য আমাদের অনেক চেষ্টা করতে হয়েছে।”

সহকর্মীদের চোখে অধ্যাপক ওয়াং একটু জেদী টাইপের মানুষ। তবে এ চরিত্রের পিছনে তাঁর দায়িত্বশীল মনোভাব আর গবেষণাকাজে সিরিয়াসনেস কাজ করেছে। সবসময় বলেন, “মহাকাশ নিয়ে কাজ করতে চাইলে বিজ্ঞানসম্মত শৃঙ্খলা ও বাস্তবতা অনুসরণ করতে হবে। ডিজাইন বা গবেষণায় ভুল করলে আমাদের রাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের দেশ মানে কী? দেশ মানে কোটি কোটি চীনা মানুষ।”

এমন চিন্তাভাবনা ও বিশ্বাসে বলিয়ান শিক্ষাবিদ ওয়াং সি জি মহাশূন্য সম্পদ, মহাকাশ প্রযুক্তিব্যবস্থা, ও মহাকাশ অবকাঠামো ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন নতুন ধারণা উত্থাপন করেন এবং চীনের মহাকাশপর্যবেক্ষণসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রকল্পের ডিজাইনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন।

২০০৬ সাল থেকে তিনি চীনের মহাকাশ সৌর বিদ্যুত্কেন্দ্র নির্মাণে মনোযোগ দেন। ৯৫ বছর বয়সে তিনি ‘ইন্টারনেট প্লাস মহাশূন্য অভিযান’ শীর্ষক থিসিস লেখেন এবং চীনের মহাকাশ-গবেষণার ভবিষ্যতের নীলনকশা আঁকেন।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করার পাশাপাশি তিনি ‘প্রকল্প ডিজাইন’ ও ‘মহাকাশ প্রযুক্তি’সহ ১০টিরও বেশি বই রচনা করেন; ‘মহাশূন্যের সম্পদ’ ও ‘চীনের মহাশূন্য অবকাঠামো নির্মাণ’সহ ৪০টিরও বেশি থিসিস লেখেন। এসব থেকে যুব গবেষকরা নতুন অনেক কিছু শিখেছে ও নিজেদের গবেষণায় সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। চীনের মহাকাশ-গবেষণার মান উন্নয়ন এবং মহাকাশযান ডিজাইনারদের প্রশিক্ষণে নিজের অবদান রাখতে চেয়েছেন তিনি বরাবরই।

২০২০ সালে চীন সাফল্যের সঙ্গে ছাংএ্য-৫, থিয়ানওয়েন-১, আর পেইতৌ-৩ মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ মহাকাশ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। ২০২১ সালের প্রথমার্ধে থিয়ানহ্য স্পেস স্টেশন আর শেনচৌ-১২ মানববাহী নভোযানসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যের পিছনে শিক্ষাবিদ ওয়াংসহ অনেক গবেষকের প্রচেষ্টাও পরিশ্রম জড়িত। বর্তমানে চীন স্পেস স্টেশন নির্মাণসহ অনেক জটিল মহাকাশ-গবেষণায় সাফল্য অর্জন করছে। শিক্ষাবিদ ওয়াং দলীয় গবেষকদের নিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে দেশের সাফল্যে নিজেদের অবদান রাখেন।

ওয়াং’র আশেপাশে অনেক যুব-গবেষক রয়েছেন। ওয়াং’র চরিত্র ও অবদান তাদের চোখে প্রশংসার যোগ্য। এ সম্পর্কে যুব-গবেষক ওয়ে চিউ চ্য বলেন, “শিক্ষাবিদ ওয়াংয়ের যুবকালে চীনের আর্থিক অবস্থা অনেক দুর্বল ছিল। অথচ তিনি যুবকাল থেকেই দেশের পুনরুত্থান ও উন্নয়নে নিজের অবদান রাখা শুরু করেন। মহাকাশ নিয়ে গবেষণা শুরুর পর তিনি মনোযোগ দিয়ে নিজের কাজ করে গেছেন। এমন দেশপ্রেমিকের আবেগ ও অনুপ্রেরণা আমাদের ব্যাপক উত্সাহিত করেছে। নতুন যুগে আমরাও জনাব ওয়াংয়ের মতো মহাকাশ-গবেষণার কাজে নিজেদের অবদান রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাবো।”

সুপ্রিয় বন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা এখানে শেষ হয়ে এলো। আমাদের অনুষ্ঠান যারা মিস করেছেন, তারা আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন। ওয়েবসাইট ঠিকানা www.bengali.cri.cn,ফেসবুকে CRIbangla মাধ্যমে চীন ও বিশ্ব সম্পর্কে আরও অনেককিছু জানতে পারেন। তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন, আগামী সপ্তাহে আবার কথা হবে,যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)