সম্প্রতি চীনের হ্যনান প্রদেশে ভয়াবহ ঝড়বৃষ্টি হয়। এতে স্থানীয় ১৫০টিরও বেশি জেলার ১৬০২ উপজেলার ১ কোটি ৩৬ লাখ ৬৪ হাজারেরও বেশি লোক দুর্যোগকবলিত হয়েছে এবং ২৮ জুলাই পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ৭৩ জনে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে: এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আমরা কী কী পদক্ষেপ নিতে পারি এবং ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে দিতেই বা কি করতে পারি? আজকের অনুষ্ঠানে এ বিষয় নিয়ে একটু আলোচনা করবো।
গত ২০ জুলাই হ্যনান প্রদেশের রাজধানী চেংচৌতে ভয়াবহ ঝড়বৃষ্টি হয়। যদিও বর্তমানে শহরের অধিকাংশ স্থান থেকে পানি নেমে গেছে, তবে আশেপাশের গ্রামগুলোর বন্যা পরিস্থিতি এখনও খারাপ। সেসব গ্রামে উদ্ধারকাজ চলছে। আরেকটি দুঃখজনক ব্যাপার হল, আবহাওয়ার পূর্বাভাস কেন্দ্রের সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ষষ্ঠ টাইফুনের কারণে হ্যনান প্রদেশের পূর্বাঞ্চলে নতুন দফা ঝড়বৃষ্টি হবে।
এবারের ঝড়বৃষ্টি কতোটা গুরুতর ছিল? আসলে, এমন ঝড়বৃষ্টি আগেও হয়েছে। ১৯৭৫ সালে হ্যনান প্রদেশের চুমাতিয়ান শহরে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। সেবারের বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আরো বেশি ছিল। তবে, ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস অনেক কঠিন ব্যাপার। এ কারণে প্রতিরোধক ব্যবস্থা যথাযথভাবে চালু করাও সহজ ব্যাপার নয়।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ১৭ থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত চেংচৌ শহরের ঝড়বৃষ্টির মোট পরিমাণ গত এক বছরের বৃষ্টিপাতের সমান ছিল। ২০ জুলাই বিকেল ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত এক ঘন্টায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২০১.৯ মিলিমিটার ছিল, যা চীনের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ঝড়বৃষ্টির কারণ অতি জটিল। স্থানীয় ভোগৌলিক অবস্থা, টাইফুন, গ্রীষ্মকালের বজ্রঝড়সহ নানান কারণে ঝড়বৃষ্টি হতে পারে। তাই সারা বিশ্বের জন্য ঝড়বৃষ্টির নির্দিষ্ট সময় সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়া ও তা প্রতিরোধ করা অনেক কঠিন ব্যাপার।
আমরা তো জানি ১৯৭৫ সালে হ্যনান প্রদেশের চুমাতিয়ান শহরে ভয়াবহ ঝড়বৃষ্টি হয়। ২০১২ সালের ২১ জুলাই রাজধানী বেইজিংয়ে ভয়াবহ ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল। এ সম্পর্কে চীনের হুয়াংহ্য জলাসেচ বিজ্ঞান প্রযুক্তি গবেষণাগারের উপ-মহাপ্রকৌশলী লি ইয়োং বলেন, এমন শহরের পশ্চিম দিকে আর্ক পর্বত থাকায় ঝড়বৃষ্টি বেশি হতে পারে।
এবারের ঝড়বৃষ্টিতে জনাব লি ইয়োং’র বাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁর বাসা চেংচৌ শহরে অবস্থিত। আবাসিক এলাকার পার্কিং বেসমেন্ট বন্যাকবলিত হওয়ার কারণে তাঁর গাড়িও ডুবে গেছে। ১৯৮৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত গত ৩৭ বছর ধরে হুয়াংহ্য নদী নিয়ে গবেষণা করছেন লি। গত কয়েক দশক গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের পর তিনি হুয়াংহ্য নদী এবং চেংচৌ শহরের বন্যা প্রতিরোধক কাজের অভিজ্ঞতা লেখেন। হাজার হাজার বছর ধরে হুয়াংহ্য নদী মধ্যচীনের বাসিন্দাদের জন্য ছিল হুমকিস্বরূপ। যদিও হুয়াংহ্য নদীর বন্যা-প্রতিরোধকব্যবস্থা প্রাচীনকালের তুলনায় অনেক বদলেছে এবং এবারের ঝড়বৃষ্টির দুর্যোগে হুয়াংহ্য’র প্রভাবও সামান্য ছিল, তবে চেংচৌ শহর হুয়াংহ্য নদীর নিম্নমুখী এলাকায় অবস্থিত বলে হুয়াংহ্য নদীর প্রভাব সুগভীর ছিল।
আসলে দীর্ঘকাল ধরে চীনারা দেখে আসছে চেংচৌ শহরে খরা বেশি। অনেকে তাই এ বছর চেংচৌ’কে বন্যাকবলিত হতে দেখে অবাক হয়েছেন। শহরবাসীরা সংবাদদাতাদের বলেন, চেংচৌ শহরে পানির অভাব, সহজে খরার সম্মুখীন হতে হয়, তাই ঝড়বৃষ্টি কারণে শহরবাসীদের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি তাদের জন্য অবিশ্বাস্য ও আশ্চর্যজনক ব্যাপার।
চেংচৌ শহরের ডিজাইন ও নির্মাণকাজের সময় অনেক কৃত্রিম হ্রদ তৈরি করা হয়। হ্রদ বা পুকুর বন্যার পানি ধরে রেখে বন্যার প্রকোপ কমাতে সাহায্য করে। তবে অনেক কৃত্রিম হ্রদ ও পুকুর নির্মাণ করা হলেও, শহরে প্রাকৃতিক জলব্যবস্থা বিধ্বস্ত হয়েছে, ভালো পরিকল্পনার অভাবে বৃষ্টিতে শহরে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। চেংচৌ শহর হ্যনান প্রদেশের রাজধানী। শহর উন্নয়নের কারণে এর আওতা দিন দিন বাড়ছে। জলসেচ, বিদ্যুত্সহ অনেক অবকাঠামো ব্যবস্থাপনা রয়েছে এখানে। একটি ব্যবস্থাপনা অকার্যকর হলে অন্যান্য ব্যবস্থাপনাও দুর্বল হয়ে যায়। যেমন, বিদ্যুত্, পানি, টেলিযোগাযোগ, প্রাকৃতিক গ্যাস ও হিটিং ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। একটা বন্ধ হলে একটি সুপার শহরও অচল হয়ে পড়ে। সেই জন্য এবার চেংচৌ শহরের সাবওয়ে ৫ নম্বর লাইন, চিংকুয়াং টানেল ও ভূগর্ভস্থ প্লাজায় বন্যার দুর্যোগ দেখা দেয়। ভবিষ্যতে শহরের নির্মাণ ও ডিজাইনে বন্যা প্রতিরোধক ধারণা ও সচেতনতা থাকতে হবে।
এবারের বন্যার দুর্যোগের পর দেখা গেছে যে, হ্যনান প্রদেশের গ্রামাঞ্চলে বন্যা প্রতিরোধক দক্ষতা জোরদার করতে হবে। দুর্যোগের পর আত্মরক্ষার সামর্থ্য দুর্বল। ২৩ জুলাই স্থানীয় সংবাদদাতা কষ্ট করে সিনসিয়াং জেলায় পৌঁছান। সেখানের বন্যা চেংচৌ শহরের চেয়ে একটু দেরীতে আসে। ২২ জুলাই ঝড়বৃষ্টির প্রকোপ উত্তর দিকে চলে যায়। তখন স্থানীয় বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। কারণ, স্থানীয় এলাকা দিয়ে দুটি নদী অতিক্রম করেছে। গ্রামের উজানে, থাইহাং পাহাড়ের কাছে কয়েকটি জলাধার নির্মিত হয়েছে। উজানের জলাধারের পানি কমিয়ে দিয়ে পানি ছেড়ে দেওয়া হয়, তাতে সিনসিয়াং জেলার বন্যা পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। গ্রামে গ্রামবাসীদের সংখ্যা বেশি। কম সময়ের মধ্যে তারা স্থানান্তরিত হতে পারেনি। তাই গ্রামে হাজার হাজার গ্রামবাসী আটকা পড়ে। স্থানীয় উদ্ধারকাজ ব্যাপক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়।
২৩ জুলাই স্থানীয় সংবাদদাতা কুং’ই শহরে প্রবেশ করেন এবং আশেপাশের গ্রাম ও জেলায় যান। কুং’ই শহর লোয়স মালভূমির পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। স্থানীয় গ্রামবাসীরা পাহাড়-লাগোয়া বাসস্থানে থাকতে অভ্যস্ত। ঝড়বৃষ্টির পর ভূমিধস ও কাদামাটির সৃষ্টি হয়। আর স্থানীয় ধরনের বাসস্থানের জন্য এগুলো মারাত্মক। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পাহাড় থেকে নিম্ন স্থানে স্থানান্তরিত হন এবং নদীর কাছে নতুন বাড়িঘর নির্মাণ করেন। ফলে তাদের ক্ষয়ক্ষতি আরো গুরুতর। কুং’ই শহরের মধ্যে মিহ্য জেলার বন্যা পরিস্থিতি সবচেয়ে গুরুতর। সেখানে বাইরে যাওয়ার পথ মাত্র একটি। এ পথে কেবল সাইকেল চালানো যায়। জেলার ২৩টি বড়-ছোট সেতুর মধ্যে ১৯টি ভেঙ্গে পড়েছে। ফলে বিভিন্ন গ্রামের মধ্যে যাতায়তব্যবস্থাও বন্ধ হয়ে গেছে। উদ্ধারকারীরা সহজভাবে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে পারছেন না। সাথে সাথে স্থানীয় বিদ্যুত্, পানি ও টেলিযোগাযোগও বন্ধ হয়ে যায়। ২০ জুলাই বিকেলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে এসওওস জানায় স্থানীয়রা। পরের দিন উদ্ধারকারীরা গ্রামগুলোতে পৌঁছায়।
উদ্ধারকাজ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিংশ শতাব্দীতে চীনাদের বহুবার দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হয়েছে। যেমন, ২০০৩ সালের সার্স এবং ২০২০ সালের কোভিড-১৯ মহামারী, ২০০৮ সালে সিছুয়ান প্রদেশের ওয়েনছুয়ান জেলার ভয়াবহ ভূমিকম্প আর বন্যা, অগ্নিকাণ্ড, কাদামাটি ও ভূমিধস ইত্যাদি। অতীতকালে আমরা শুধু সরকারি উদ্ধারকারী দলের অপেক্ষায় থাকতাম। গত ২০ বছর ধরে বেসরকারি উদ্ধারকারী দলও দিন দিন বাড়ছে।
এবার হ্যনান প্রদেশের ঝড়বৃষ্টিতে বেসরকারি উদ্ধারকারী দলের ভুমিকা ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, বিভিন্ন জেলা ও গ্রামের বিদ্যুত্ ও ইন্টারনেট বন্ধ থাকার সময়, কেন্দ্রীয় সরকার থেকে জেলা পর্যায়ের সরকার পর্যন্ত উদ্ধারব্যবস্থা স্বাভাবিকভাবে কাজ করছিল না। তখন লোকেরা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এসওএস জানায় এবং আটকে পড়া ব্যক্তিদের তথ্য শেয়ার করে। লোকেরা উইচ্যাট, ভিবোসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সর্বশেষ তথ্য আপডেট করে। তখন বিভিন্ন জেলা থেকে বেসরকারি উদ্ধারকারী দল ও স্বেচ্ছাসেবকরা কাছাকাছি দুর্গত এলাকায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়।
এবার ঝড়বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় ৭৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এমন দুঃখজনক ঘটনা ভবিষ্যতে এড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে এবং দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করতে হবে। এ সম্পর্কে চীনের জলসেচ ও জল বিদ্যুত্ গবেষণাগারের দুর্যোগ প্রতিরোধক কেন্দ্রের অধ্যাপক লি না বলেন, গত কয়েক দশকে বন্যার ঝুঁকি নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। সহজ কথায় বলা যায়, একটি শহরের আবহাওয়া, ভৌগোলিক অবস্থা, ঐতিহ্যিক দুর্যোগের তথ্যসহ বিভিন্ন উপাদান বিশ্লেষণ করা এবং সেই শহরে কোন সময় কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটতে পারে, তা বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। এবং সেই অনুসারে শহরে বন্যা-প্রতিরোধক এলাকা নির্মাণ করতে হবে। চীন বিশাল একটি দেশ। এ কাজ সম্পন্ন করা অনেক কঠিন ব্যাপার। এ পর্যন্ত মাত্র ৫ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকায় এমন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তবে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে জানা গেছে, বন্যার ঝুঁকি নিয়ে তৈরি ম্যাপ কার্যকর ভুমিকা পালন করতে সক্ষম নয়। তাই ঝড়বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য আরো কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। একটি বাসযোগ্য শহর নির্মাণ করতে চাইলে, শহরের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা ও সহনশীলতার ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। শুধু বন্যা প্রতিরোধ করা নয়,বরং অগ্নিকাণ্ডসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ বিবেচনা করতে হবে। বর্তমানে শহরের আওতা অনেক বেড়েছে, শহরবাসীদের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে, তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রত্যেকের সচেতন থাকতে হবে।
সুপ্রিয় বন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা এখানে শেষ হয়ে এলো। আমাদের অনুষ্ঠান যারা মিস করেছেন, তারা আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন। ওয়েবসাইট ঠিকানা www.bengali.cri.cn,ফেসবুকে CRIbangla মাধ্যমে চীন ও বিশ্ব সম্পর্কে আরও অনেককিছু জানতে পারেন। তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন, আগামী সপ্তাহে আবার কথা হবে,যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)