স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কোটি টিকার ম্যাজিক ফিগার: প্রয়োজন বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত
2021-08-01 19:51:01

গত কয়েক দিন ধরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের একটি ঘোষণার কথা বারবার আসছে গণমাধ্যমে। সেটি হচ্ছে ৭ আগস্ট শুরু হতে যাওয়া গণটিকা কর্মসূচিতে সপ্তাহে এক কোটি টিকা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে স্বাস্থ্যবিভাগের। ইউনিয়ন পর্যায়ে শুরু হতে যাওয়া এ টিকা কর্মসূচির সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে বলেও জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সবশেষ রোববার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে এ কথা পুনর্ব্যক্ত করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। 
করোনা মহামারি থেকে মুক্তি পেতে টিকাই এ পর্যন্ত শেষ এবং সর্বোত্তম ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য হচ্ছে সারাবিশ্বে। সে হিসেবে আমাদের দেশে গণটিকা কার্যক্রম ব্যাপকভাবে চালানোর বিকল্প নেই। এ হিসেবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সপ্তাহে কোটি টিকা দেয়ার ঘোষণা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সপ্তাহে আদৌ এক কোটি টিকা দেয়া সম্ভব কি-না এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। 
এখানে দুটি বিষয় বিবেচ্য: 
এক.এ পরিমাণ টিকা বাংলাদেশের হাতে আছে কি-না? 
দুই. সারাদেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকা দেয়ার অবকাঠামো এবং পর্যাপ্ত জনবল আছে কিনা?
টিকা কর্মসূচিতে বাংলাদেশের ভালো অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে হয়তো বলা যায় সপ্তাহে এক কোটি টিকা দেওয়া হয়তো সম্ভব। কিন্তু করোনা টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদশের অগ্রগতি মোটেই ভালো নয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেই বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে করোনা টিকা কর্মসূচিতে। 
উন্নয়শীল বিশ্বে টিকাদান পর্যবেক্ষণে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্স এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশে দিনে গড় টিকাদানের হার শূণ্য দশমিক ১১ শতাংশ। শ্রীলঙ্কায় এ হার এক দশমিক ১৯ শতাংশ, নেপালে শূণ্য দশমিক ৩৩ শতাংশ, ভারতে শূণ্য দশমিক ৩১ ও পাকিস্তানে শূণ্য দশমিক ১৯ শতাংশ। অর্থাৎ ওই সব দেশের চেয়ে টিকাদানে পিছিয়ে বাংলাদেশ। অবশ্য মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে বাংলাদেশ।
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,বাংলাদেশ বর্তমানে যে হারে টিকা দিচ্ছে সে হিসেবে এ বছরের শেষ নাগাদ অর্থাৎ আগামী ছয় মাসে দেশের ১৯ দশমিক ৬৪ ভাগ মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব হবে। 
এ ছাড়া টিকা প্রাপ্তিরও একটা বিষয় রয়েছে। দেশের ৪০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে লাগবে ১৩ কোটি ১৮ লাখ ডোজ আর ৬০ শতাংশকে টিকা দিতে চাইলে লাগবে প্রায় ২০ কোটি ডোজ টিকা। স্বাস্থ্যমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, বাংলাদেশ এরই মধ্যে ২১ কোটি ডোজ টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে। কিন্তু এ টিকা যথাসময়ে হাতে এসে পৌঁছবে এর নিশ্চয়তা কতটুকু। এর আগে চুক্তি করেও ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অক্সফোর্ডের টিকা সরবরাহ না করায় দেশে গণটিকা কর্মসূচি বন্ধ হয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় তো পাবেই!
এবার হাতে নগদ টিকার একটু হিসাব কষা যাক। ভারত সরকারের উপহার ও সেরাম থেকে পাওয়া গেছে ১ কোটি তিন লাখ। চীন থেকে উপহার ও কেনা বাবদ পাওয়া গেছে ৮১ লাখ ডোজ, কোভ্যাক্সের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের মডার্নার ৫৫ লাখ ডোজ, জাপানের অ্যাস্ট্রাজেনেকার ১০ লাখ ডোজ ও ফাইজারের ১ লাখ ডোজ টিকা পৌঁছেছে দেশে। ২৫ জুলাই পর্যন্ত দেশে ১ কোটি ১৮ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এ হিসেবে হাতে আছে ১ কোটি ৩২ লাখ টিকা। এ সব টিকা দিয়েই বর্তমানে দেশে গণটিকা কার্যক্রম চলছে। 
এখন কথা হচ্ছে আরও টিকা হাতে না আসার আগে সপ্তাহে হুড়মুড় করে এক কোটি টিকা যদি দিয়েও ফেলা যায় কাজটি যথযথ হবে কিনা?
কোটির ম্যাজিক ফিগারে পৌঁছানোর জন্য টিকার বয়সসীমা ১৮তে নামিয়ে আনা হচ্ছে। এতে করে দেখা যাবে তরুণেরা বেশি কর টিকা নেবে। আর বয়স্ক ও ঝুঁকিপূর্ণরা পিছিয়ে পড়বে। 
এখানে আরেকটি বিষয় গুরুত্ব পেতে পারতো সরকারের কাছে। করোনার গত ১৬ মাসে দেখা গেছে লকডাউনের সময় আমাদের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি পোশাকশিল্প শ্রমিকদের অশেষ দুর্ভোগের চিত্র। লকডাউনের মধ্যে এবারও তাদের ডেকে আনা হয়েছে কাজে। দেশের দূরদূরান্ত থেকে শতশত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে, স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে তাদের রাজধানীতে কিংবা অন্য শহরে পৌঁছার কষ্টকর চেষ্টা সবাইকে ব্যথিত করে। 
টিকার বয়সসীমা ৩০-এ নামানোকেই অনেক বিশেষজ্ঞ তড়িঘড়ি বলছেন। সেক্ষেত্রে একে এখনি ১৮তে নামিয়ে আনার কোনো মানে হয় না। যেহেতু পোশাকশিল্পসহ রপ্তানিমুখী শিল্প শ্রমিকদের লাকডাউনে বারবার কাজে ডেকে আনতে হচ্ছে- অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৪০ লাখ পোশাক শ্রমিককে টিকা দেয়ার কথা ভাবতে পারে সরকার। এতে করে নিজেদের সুরক্ষার পাশাপাশি তাদের মাধ্যমে করোনা বিস্তারের ঝুঁকিও অনেকটা কমে আসে। 
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।