‘খড়ের জুতো সম্পাদক’ চৌ ইয়ুং খাই-এর গল্প
2021-07-30 15:12:40

‘খড়ের জুতো সম্পাদক’ চৌ ইয়ুং খাই-এর গল্প_fororder_zhou

 

নয়া চীন প্রতিষ্ঠার আগে তিনি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে চীনের সিছুয়ান প্রদেশের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকায় কমিউনিস্ট পার্টির জন্য সংগ্রাম করেছেন। নয়া চীন প্রতিষ্ঠার পর তিনি জনকল্যাণে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন, আঞ্চলিক উন্নয়নে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি হলেন জনগণের প্রিয় ‘খড়ের জুতোর সম্পাদক’। অবসরের পর তিনি জনসাধারণকে নিয়ে বৃক্ষরোপণের কাজ শুরু করেন এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকা গড়ে তোলেন। জনগণ তাঁকে ডাকেন ‘বিপ্লবী বৃদ্ধ চৌ’।

 

সম্প্রতি চীনের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার শততম বার্ষিকীতে তাকে সিপিসি’র সর্বোচ্চ পদক ‘পয়লা জুলাই’ পদক প্রদান করা হয়। ৯৩ বছর বয়সী ‘খড়ের জুতোর সম্পাদক’ চৌ ইয়ুং খাই এই পদক অর্জন করেন। তিনি বলেন, সিছুয়ানের জনগণের জন্য আমি এই সাফল্য পেয়েছি। আমি জনগণকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেবা করবো।

আজকের অনুষ্ঠানে আপনাদেরকে এই সাধারণ বৃদ্ধের জীবন কাহিনী জানাবো।

 

মাথা কাটার হুমকিকেও ভয় পান নি সিপিসি’র সদস্য

চৌ ইয়ুং খাই ১৯২৮ সালে চীনের সিছুয়ান প্রদেশের একটি কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় তাঁর মা মারা যায়। তাঁর দাদা ও বাবা জমিদারের কাজ করে জীবনযাপন করতেন। তখন মানুষ মানুষকে শোষণ করতো, মানুষকে নির্যাতন করতো। চৌ ইয়ুং খাই এসব দেখেছেন।

কিশোর চৌ ইয়ুং খাই সবসময় লং মার্চের সময় লাল ফৌজের কথা স্মরণ করেন। কারণ লাল ফৌজ কখনই জনগণকে নির্যাতন করে না।

 

১৯৪৩ সালে চৌ ইয়ুং খাই হুয়া ছেং প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলের বেশিরভাগ শিক্ষক সিপিসি’র সদস্য। তাঁরা সবসময় শিশুদের বিপ্লবের কথা ও তাত্পর্য তুলে ধরতেন। ১৯৪৫ সালে চৌ ইয়ুং খাইয়ের বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। এক রাতে তাঁর শিক্ষক ওয়াং ফু আন তাঁকে বলেন: তুমি সিপিসিকে খুঁজতে চাও? তুমি কি মৃত্যুকে ভয় পাও? তুমি কি সিপিসি’র সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে?

তখন স্কুলে বিরোধী দলের গুপ্তচর ছিল। তারা সিপিসি’র সদস্যদের গ্রেফতার করতো এবং যে কোনো সময় তাদেরকে হত্যা করতো। তবে চৌ ইয়ুং খাই দ্বিধা না করে উত্তর দেন যে, আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না, আমি কখনও সিপিসি’র সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবো না।

সেই গভীর রাতে চৌ ইয়ুং খাই আনুষ্ঠানিকভাবে সিপিসি’র সদস্য হন। ১৯৪৮ সালে চৌ ইয়ুং খাই সিপিসি’র তা জেলার শাখা সম্পাদক ছিলেন, শত্রুর কঠোর প্রতিরোধের মধ্যেও তিনি সংগ্রাম বন্ধ করেন নি।

 

চৌ ইয়ুং খাই তখন সিপিসি’র সদস্য বাড়ানোর জন্য অনেক কাজ করেছিলেন। তখন বিরোধী দল কুও মিন তাং পার্টির কঠোর অবরোধের জন্য তারা গোপনে সংগ্রাম করতেন। ১৯৪৯ সালের শেষ নাগাদ চৌ ইয়ুং খাই-এর চেষ্টায় ১৩০০ জনেরও বেশি মানুষ স্থানীয় সিপিসি’র শাখায় যোগ দেয়। বিপ্লবের জন্য তাঁর স্ত্রী উ ইং মিং সিপিসিতে যোগ দেন। তিনি সবসময় গোপন তথ্য প্রচারের জন্য প্রাণের ঝুঁকি নিতেন।

 

তখন চৌ ইয়ুং খাই-এর প্রথম সন্তান জন্ম নেয়। একবার স্ত্রী উ ইং মিং শিশুকে নিয়ে শত্রুর চেক পোস্ট পার হয়ে যাচ্ছিলেন, তখন শিশু কাঁদতে শুরু করে। তিনি তাত্ক্ষণিকভাবে শিশুর মুখ চাপা দেন, শিশুর তখন ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। সেবার কাজ শেষ করার পর চৌ ইয়ুং খাই শিশুর নিরাপত্তার কথা ভেবে বলেন- সন্তানকে ‘চৌ পিং’ নাম দিবো, এর অর্থ নিরাপদ।

 

মুক্তির আগে সিপিসি সশস্ত্র বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নেয়। বিদ্রোহের জন্য অস্ত্র- বিশেষ করে বন্দুক প্রয়োজন। তাঁরা বন্দুক সংগ্রহ করতে ছেংতুং শহরে যান। তখন প্রতি ৫ জন সাধারণ মানুষের মধ্যে একজন গুপ্তচর ছিল। একজন সিপিসি সদস্য পেলে পুরো পরিবারকে হত্যা করা হতো। আর ছেংতুং শহরে যাওয়ার পথে অনেক চেক পোস্ট ছিল। চৌ ইয়ুং খাই বলেন, আমরা বন্দুকগুলো ওয়েক্সে লুকিয়ে রাখি। ওয়েক্স বিক্রির ভান করি। এভাবে নিরাপদে বন্দুকগুলো আমাদের জেলায় নিয়ে আসি। এর ফলে সশস্ত্র বিদ্রোহ করতে পেরেছিলাম।

 

নয়া চীন প্রতিষ্ঠার পর চৌ ইয়ুং খাই বা জুং জেলার সিপিসি’র শাখা সম্পাদক এবং তা জেলার সিপিসি’র শাখার সম্পাদক ছিলেন। সবাই তাঁকে সম্মান করে ‘খড়ের জুতো সম্পাদক’ হিসেবে ডাকতো।

বা জুং এলাকা তা বা পর্বতের গভীরে অবস্থিত। সারা বছরই খরা লেগে থাকতো। নয়া চীন প্রতিষ্ঠার আগে সেখানে একটি গাড়িও ছিল না, কোনো জলসেচ প্রকল্পও ছিল না। স্থানীয় জনগণ সবসময় বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করত। নয়া চীন প্রতিষ্ঠার পর চীন সরকার সেখানে অনেক প্রকল্প শুরু করে। চৌ ইয়ুং খাই স্থানীয় জলাধার নির্মাণের কাজ শুরু করে দেন। স্থানীয় ৩০ হাজারেরও বেশি কৃষককে নিয়ে দিন-রাত ধরে এই কাজ করেন তিনি। তিনি ১০ কিলোমিটার পথ হেঁটে প্রকল্প এলাকায় যেতেন, জনসাধারণের সঙ্গে কঠোর কাজ করেন। রাতেও তিনি বিশ্রাম নিতে পারতেন না। পরের দিনের কাজ বিন্যাসের জন্য ব্যস্ত থাকতেন।

‘খড়ের জুতো সম্পাদক’ চৌ ইয়ুং খাই-এর গল্প_fororder_zhou2

নির্মাণ স্থলে চৌ ইয়ুং খাই কৃষক শ্রমিকের মতো সব কাজই করতেন, কাজ শেষে সারা শরীর ধুলোয় আচ্ছন্ন হয়ে যেতো। শুধু তাঁর দু‌ই চোখ দেখা যেত। অনেকেই বুঝতো না যে এই মানুষটি তাদের জেলার সম্পাদক।

১৯৬০ সালে সেই জলাধার নির্মাণের কাজ শেষ হয়। এর গভীরতা ৪৬ মিটার। আগের খরা কবলিত অঞ্চল এখন সবুজ স্বর্গে পরিণত হয়েছে। এই সুন্দর জলাধারটি ২০০৩ সালে বা জুং শহরের পানীয় জলের উত্স হিসেবে নির্ধারিত হয়। ২০১৫ সালে তা দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের দর্শনীয় জলসেচ এলাকা হিসেবে মর্যাদা পায়।

 

জলাধারের নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর একটি পাথরের ফলক লাগিয়ে নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণকারী এবং অবদানকারীদের নাম লিখে রাখা হয়। তিনি এই ফলকে নিজের নাম দেওয়ার বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, জলাধার জনগণের জন্য তৈরি হয়েছে। এর সব কৃতিত্ব জনগণের।

চৌ ইয়ুং খাই সবসময় মানুষের কথা চিন্তা করেছেন। গ্রাম পরিদর্শনের সময় যদি রাস্তায় কোনো প্রাণীর মল পড়ে থাকতে দেখা যায়, তিনি তা উঠিয়ে জমিতে দিতেন; যাতে জমি আরো উর্বর হয়।
 

গত শতাব্দীর ৯০ দশকের শুরুতে, তিনি প্রথমবারের মতো হুয়া ও পাহাড় পরিদর্শন করেন। তখন সেই পাহাড়ে কোনো সড়ক ছিল না, বিদ্যুতের ব্যবস্থাও ছিল না। তিনি খুব কষ্ট করে খাড়া ও উঁচু পাহাড়ে ওঠেন। এভাবে  সারা দিন চেষ্টার পর তিনি পাহাড়-পর্বতের মধ্যে অবস্থিতি সিয়াং চিয়া পিং গ্রামে পৌঁছাতে সক্ষম হন। তখন গ্রামের লোকজন রাতে কেরোসিনের বাতি ব্যবহার করত। একবার একটি ছোট মেয়ে কেরোসিনের বাতি থেকে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে মারা যায়। চৌ ইয়ুং খাই এই ঘটনা শুনে খুব মর্মাহত হন। তিনি নিজের টাকা দিয়ে একটি জলবিদ্যুত্ জেনারেটর কিনে স্থানীয় লোকজনকে দেন। তখন পাহাড়-পর্বতের গ্রামে প্রথমবারের মতো বৈদ্যুতিক বাতির আলো দেখা যায়।

 

তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, মূল থেকে দরিদ্রতা দূর করতে হবে। তিনি বার বার বিভিন্ন সরকারি বিভাগে যান, আবেদন করেন, গ্রামবাসীদের বিভিন্ন নির্মাণকাজে অংশগ্রহণে উত্সাহ দেন। এভাবে হুয়া ও পাহাড় থেকে বাইরে যাওয়ার একটি ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক নির্মাণ করা হয়। গ্রামে বিদ্যুত্ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। স্থিতিশীলভাবে বিদ্যুত্ সরবরাহ শুরু হলে গ্রামের বয়স্করা নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।

 

তিনি নিজের টাকা দিয়ে ভেষজ ওষুধের বীজ কিনে গ্রামবাসীদের দেন, তাদেরকে গ্রামে ভেষজ ওষুধ চাষে সাহায্য করেন। এখন স্থানীয় লোকজন ভেষজ ওষুধ চাষের মাধ্যমে দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে।

 

১৯৯৪ সালে চৌ ইয়ুং খাই অবসর নেন। তবে, অবসরের পরও তিনি নানা কাজ করতে থাকেন। তিনি হুয়া ও পাহাড় রক্ষাকারী হিসেবে কাজ করে যান। দরিদ্রতার কারণে গ্রামবাসীরা সেখানকার গাছ কেটে বিক্রি করতো এবং বন্যপ্রাণী ধরতো। এতে প্রাকৃতিক পরিবেশের গুরুতর ক্ষতি হয়। কিছু স্থানে কোনো গাছপালা দেখা যেতো না। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, অবসর নিলেও সবুজায়নের কাজ করে যেতে হবে।

 

তিনি অন্য দু’জন অবসরপ্রাপ্ত মানুষকে নিয়ে দিনের বেলা পাহাড়ে টহল দেন, নদনদী অতিক্রম করেন, গ্রামবাসীদের প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের জ্ঞান দেন। রাতে তাঁরা পাহাড়ে শুয়ে থাকেন। পাহাড়ে রাতের আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা হয়। এ কারণে তাঁরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। আর চৌ ইয়ুং খাইয়ের বয়স তখন প্রায় ৭০! তাঁর পিত্তথলিতে অস্ত্রোপচার হয়েছিল। একবার তিনি পাহাড় থেকে পড়ে আহত হন ও অজ্ঞান হয়ে যান। কৃষকরা তাঁকে কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।

 

চৌ ইয়ুং খাই বলেন, কঠিন প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে আমি এই পাহাড়ে মরেও যেতে পারি। যদি আমি মারা যাই, তাহলে আমাকে গাছের নিচে কবর দিবেন। এটাই হল আমার সিদ্ধান্ত, কেউ আমাকে বাধা দেবেন না।

 

তিনি হাজার মু-এর বেশি বনভূমি রক্ষা করেছেন, নিজের হাতে ও নিজের পরিশ্রমে ‘দুর্নীতিমুক্ত’ নামে এক বনভূমি গড়ে তুলেছেন। তাঁর চেষ্টায় হুয়া ও পাহাড়ের রাষ্ট্রীয় প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকা প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর অর্থ, পরিশ্রমের পর এখন বনভূমি রক্ষার ধারণা স্থানীয় মানুষের সাধারণ চিন্তাধারায় পরিণত হয়েছে।

 

যখন চৌ ইয়ুং খাই পাহাড়ি অঞ্চলে দারিদ্র্যমুক্তির কাজ শুরু করেন, তখন সিয়াং চিয়া পিং গ্রামের উচ্চ বিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষক ছিল না। তিনি নিজের অর্থে হুয়া ও পাহাড়ের স্কুল পুনর্নির্মাণ করেন। তিনি স্থানীয় শিক্ষার্থীদের সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন; তাদেরকে পাহাড়ি অঞ্চল থেকে বের হয়ে বাইরের বিশ্ব দেখার ক্ষেত্রে সাহায্য করেন।

 

এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে চিয়াং নিং ছুং নামে এক ছাত্রীর গুরুতর চোখের সমস্যা ছিল। চৌ ইয়ুং খাই তাঁকে শহরের সবচেয়ে ভালো হাসপাতালে নিয়ে যান ও সবচেয়ে ভালো চিকিত্সকের মাধ্যমে চোখের চিকিত্সা করান। পরে চিয়াং নিং ছুং হুয়া ও পাহাড়ি অঞ্চল থেকে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হন। এখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থকে স্নাতক পাস করে আবারও পাহাড়ি এলাকায় ফিরে কাজ শুরু করেছেন।

 

চৌ ইয়ুং খাই ১৯৯৮ সাল থেকে স্থানীয় বিভিন্ন স্কুলে ‘সাম্যবাদ বৃত্তি’ দেওয়া শুরু করেন। এই পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ১০ বার বৃত্তি দেওয়া হয়েছে। এতে চার শতাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উপকৃত হয়েছে। তবে তিনি এখনও মাত্র ৫০ বর্গমিটারের ছোট ও পুরানো বাড়িতে থাকেন।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)