থিয়ানচিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ চৌ হেংয়ের গল্প
2021-07-26 18:03:38

সম্প্রতি চীনের সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ভিডিওতে ৯২ বছর বয়সের চীনা শিক্ষাবিদ চৌ হেংকে দেখা যাচ্ছে সাইকেল চালিয়ে বাসায় যাচ্ছেন। নেটিজেনদের অনেকই জনাব চৌ’র বয়স জেনে অবাক হয়েছেন। তাঁর শরীর-স্বাস্থ্য এখনও অনেক ভালো। দেখলে বয়স আন্দাজ করা সত্যিই মুশকিল।

অধ্যাপক চৌ চীনের সুবিখ্যাত তরল বলবিজ্ঞানের পণ্ডিত, যিনি চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একাডেমির একজন সিনিয়র শিক্ষাবিদ। যদিও তার বয়স হয়েছে, তবে তাঁর মানসিক অবস্থা যুবকের মতোই প্রাণচঞ্চল।

নিজের জীবন সম্পর্কে চৌ বলেন, ‘আমার বয়স ৯০ বছরেরও বেশি। দীর্ঘায়ু পেয়েছি বলা যায়। আমার সারা জীবন অন্য অনেকের তুলনায় ভালো কেটেছে।’ গত বছর হাসপাতালে ভর্তি হবার সময় তিনি এমন কথা লিখেছিলেন। ১৯২৯ সালে তিনি চীনের শাংহাইতে জন্মগ্রহণ করেন। তার ৮ বছর বয়সে জাপানি আগ্রাসন-বিরোধী প্রতিরোধযুদ্ধ ঘটে। তখন তিনি পরিবারের সাথে চিয়াংসি প্রদেশের নানছাং শহরে স্থানান্তরিত হন। পরে কানচৌ শহর, কুইচৌ প্রদেশের তুশান, ছোংছিংসহ বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করেন তিনি ও তার পরিবার। ঘন ঘন বাসস্থানের পরিবর্তন হলেও, তিনি পিতামাতার আদর-যত্নেই বড় হয়ে ওঠেন।

চৌ হেংয়ের পিতা মাধ্যমিক স্কুলের গণিত শিক্ষক। তাঁর মা বিয়ের পর থেকেই গৃহিণী হিসেবেই রয়ে গেছেন। তবে, চিন্তা-চেতনায় তিনি উন্মুক্ত। তাই তিনি শুধু জনাব চৌ-কে নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া করিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং তাকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতেও রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। প্রতিবার নতুন শহরে এসে বাসস্থান ঠিক করার পরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজই ছিল চৌ’র জন্য স্থানীয় সেরা স্কুল খুঁজে বের করা এবং সেখানে তাকে ভর্তি করানো।

থিয়ানচিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ চৌ হেংয়ের গল্প_fororder_zh1

ছোটবেলার জীবনের কথা স্মরণ করে চৌ বলেন, কানচৌ শহরে তাঁর পরিবার সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছে। তখন তিনি দু’জন বোনের সাথে নিয়মিত একটি বইয়ের দোকানে যেতেন। সে দোকানের মালিকের কাছ থেকে বই ধার নিতেন। তিন ভাইবোন ধার-নেওয়া বইয়ের যত্ন নিতেন। ফেরত দেওয়ার সময় বইগুলো থাকতো অক্ষত। তাই দোকানের মালিক তাদেরকে বই ধার দিতে কার্পণ্য করতেন না। এভাবে তাদের বই পড়ার অভ্যাস ছিল ছোটবেলা থেকেই।

১৯৪৬ সালে জাপানি আগ্রাসন-বিরোধী যুদ্ধে জয়ী হবার পর, বেইইয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থিয়ানচিন বিশ্ববিদ্যালয় হয় এবং এর শিক্ষাকার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়। তখন চৌ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাসায়নিক শিল্প বিভাগে ভর্তি হন এবং পরে জলসেচ বিভাগে পড়াশোনা শুরু করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তখন বয়স খুবই কম, জ্ঞানও ছিল সীমাবদ্ধ। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের জলসেচ বিভাগ আর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের রেঙ্কিং সবচেয়ে ভালো ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট মাও ই শেং এবং লি শু থিয়ান ছিলেন চীনের সুবিখ্যাত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। তাঁরা চীনের জলসেচ প্রকল্প পরিষদও গঠন করেন। এ বিভাগের অনেক শিক্ষার্থী চীনের হুয়াংহ্য নদী ও হাইহ্য নদীশাসনের কাজে অংশ নিয়েছেন। তাই রাসায়নিক শিল্প বিভাগ থেকে জলসেচ বিভাগে চলে আসি।’

১৯৫০ সালে তিনি ক্লাসের সেরা শিক্ষার্থী হিসেবে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। দু’বছর শিক্ষকতার সময় তিনি তিনটি বিষয়ের ক্লাস নিতেন। তখন বলবিজ্ঞানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় তার। পরে তিনি বলবিজ্ঞান গবেষণাগারে কাজ করা শুরু করেন। ২৩ বছর বয়সে তিনি প্রথমবারের শ্রেণীকক্ষে তাত্ত্বিক বলবিজ্ঞান পড়ান।

নিজের জীবনের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তারকারী দু’জনের কথা স্মরণ করে চৌ বলেন, ‘বিজ্ঞানী ছিয়ান স্যুয়ে সেন ও প্রযুক্তিবিদ ছাও রেন চিয়ে আমাকে বিজ্ঞান-গবেষণায় অনেক অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।’

১৯৫৫ সালে অধ্যাপক ছিয়ান স্যুয়ে সেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনেক কষ্ট স্বীকার করে চীনে ফিরে আসেন। তখন চীনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বলবিজ্ঞান গবেষণায় আগ্রহ অনেক বেড়েছে। ১৯৫৬ সালের প্রথমার্ধে অধ্যাপক ছিয়ান বেইজিংয়ে ধারাবাহিক সেমিনার আয়োজন করেন। সেসব সেমিনারে তিনি নিজের থিসিস ও বইয়ের সঙ্গে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেন এবং ‘ইঞ্জিনিয়ারিং সাইবারনেটিক্স’ বিষয়টি তুলে ধরেন। জনাব চৌ এবং থিয়ানচিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও দু’জন শিক্ষক প্রতি সপ্তাহের বুধবার ভোর ৬টায় বাসা থেকে রেলস্টেশনে যেতেন এবং প্রায় ৩ ঘন্টার ট্রেন জার্নিশেষে বেইজিংয়ে পৌঁছাতেন; আর ক্লাস শেষ করে পরের দিন আবার থিয়ানচিনে ফিরে যেতেন। পুরো সেমিস্টার তাঁরা ক্লাস করেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য চৌ একাই সব ক্লাসে উপস্থিত থাকার রেকর্ড গড়েন। অধ্যাপক ছিয়ানের ক্লাস অতি চমত্কার, যাত্রাপথের কষ্ট তিনি তার ক্লাসে এসে ভুলে যেতেন।

অধ্যাপক ছিয়ানের উত্সাহে জনাব চৌ নিজের গবেষণার বিষয়ও ঠিক করেন এবং নিজের থিসিস অধ্যাপক ছিয়ানকে পাঠান। যুবক চৌ’র গবেষণা-কাজ ছিয়ানের ব্যাপক স্বীকৃতি ও প্রশংসা পায়। এটা ছিল চৌ-এর জন্য অনেক আনন্দদায়ক ব্যাপার। তিনি প্রতি সপ্তাহের বুধবার বেইজিংয়ে এসে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একাডেমির সংশ্লিষ্ট বিভাগের অধ্যাপক ছিয়ানের সহায়তায় সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণাকাজ করতে থাকেন।

কয়েক বছর পর, চৌ খেয়াল করেন যে, শুধু কাগজ-পত্রে  গবেষণা করা সমাজের উন্নয়নে বেশি অবদান রাখতে সক্ষম নয়। প্রযুক্তির চাহিদা মেটানোর কথা বিবেচনা করতে হবে; মৌলিক বিজ্ঞানের তত্ত্ব দিয়ে বাস্তব সমস্যার সমাধান করতে হবে।  প্রযুক্তিবিদ ছাও রেন চিয়ে চৌকে এমন কথা বলেন।

গত শতাব্দীর ৭০-এর দশকে জনাব চৌ এবং তার কয়েকজন সহকর্মী চিয়াংসি প্রদেশের চিউচিয়াং শহরের একটি নটিক্যাল যন্ত্র কারখানায় গিয়ে তাদের প্রযুক্তির সমস্যা সমাধানে চেষ্টা করেন। তখন ৪০ বছর বয়সের প্রযুক্তিবিদ ছাও রেন চিয়ে এ যন্ত্র ডিজাইন ও তৈরির কাজ করেন। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রে নটিক্যাল যন্ত্র নিয়ে গবেষণা হতো। কিন্তু সেসবের বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি। চীনে তৈরি নটিক্যাল যন্ত্রে সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যাবে, তা তখন কেউ জানতো না।

এ সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেন জনাব চৌ ও প্রযুক্তিবিদ ছাও। তারা প্রতিদিন মনোযোগ দিয়ে সমাধানের পদ্ধতি খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকেন। যদিও প্রযুক্তিবিদ ও পণ্ডিতের কাজের তুলনা চলে না, তবে ছাও’র দক্ষতা চৌকে মুগ্ধ করে। এ সম্পর্কে চৌ বলেন, ‘টানা কয়েকদিন আমি ছাও’র পাশে দাঁড়িয়ে এ যন্ত্রের ব্যবহার দেখি। তখন খেয়াল করি যে, মাত্র ২ মাইক্রন উচ্চতার এ জিনিস হাতেই তৈরি হয়। প্রযুক্তিবিদ ছাও’র হাতের কাজও অতি চমত্কার।’

প্রযুক্তিবিদ ছাও এবং গবেষক চৌ’র যৌথ প্রয়াসে নতুন প্যারামিটার হিসাব করে নতুন ডিজাইনের যন্ত্র তৈরি করা সম্ভব হয়। ফলে দুই বছর পর তাঁরা সফলভাবে নতুন ধরনের নটিক্যাল যন্ত্র সৃষ্টি করেন এবং সংশ্লিষ্ট গবেষণার তত্ত্ব ও অভিজ্ঞতাও লিপিবদ্ধ করে একটি বই রচনা করেন। এ বইয়ের প্রকাশনা সম্পর্কে চৌ বলেন, ‘যদি প্রযুক্তিবিদ ছাওয়ের কাজ এমন চমত্কার না হতো, তাহলে নতুন প্যারামিটারের ভিত্তিতে নতুন নমুনা-যন্ত্র তৈরি করা সম্ভব হতো না।’ তখন থেকেই প্রযুক্তি ও তত্ত্বের সংমিশ্রণের কার্যকর পদ্ধতিও খুঁজে পান তিনি।

১৯৮০ সালে ৫০ বছর বয়সী অধ্যাপক চৌ থিয়ানচিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বলবিজ্ঞান বিভাগের গবেষণাগারের উপ-পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান এবং ৩ বছর পর পরিচালক হন। তাঁর ক্লাস শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেক জনপ্রিয়। ১৯৮৩ সালে তিনি থিয়ানচিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স একাডেমি গঠনের চেষ্টা করেন। যদিও শিক্ষার্থীরা তাঁকে সেরা শিক্ষক হিসেবে আখ্যায়িত করে, তবে তিনি কখনও নিজের প্রশংসা করেন না। শিক্ষার্থীদের যে-কোনো সফলতাকেই তিনি তার নিজের সফলতা বলে মনে করেন।

গবেষণাকাজে অবশ্যই বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। প্রযুক্তিবিদ ছাওয়ের সহযোগিতায় অধ্যাপক চৌ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির তত্ত্ব ও অনুশীলনের সংমিশ্রণের ধারণায় অবিচল থাকেন। তাঁর মাথায় ছিল অধ্যাপক ছিয়ান স্যুয়ে সেনের প্রস্তাব। আর সেটি হচ্ছে: বলবিজ্ঞান উন্নয়নের জন্য প্রযুক্তির উন্নয়ন প্রয়োজন। চৌ মনে করেন, শুধু থিসিস লেখা সময় ও টাকার অপচয় মাত্র।

গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে অধ্যাপক চৌ’র গবেষণাকাজ মহাকাশ প্রযুক্তিতে সম্প্রসারিত হয়। তাঁর দলের গবেষণা-সাফল্য শুধু বলবিজ্ঞান মহলের স্বীকৃতি পেয়েছে তা নয়, বরং মহাকাশ বিভাগের মনোযোগও আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এ সম্পর্কে চৌ বলেন, ‘আমাদের গবেষণাকাজ ছিল দেশের জন্য সামান্য অগ্রগতি। কিন্তু দেশের উন্নয়নে তা যেটুকু ভুমিকা রেখেছে, আমরা তাতেই আনন্দিত।’

চৌ’র বাড়িতে একটি ছোট সাইকেল আছে। তিনি প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে অফিসে যান। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘গত বছরও শরীর ভালো ছিল। তখন প্রতিদিন হেঁটে অফিসে যেতাম। তবে এখন শরীর দুর্বল হয়ে গেছে। তাই প্রতিদিন কেবল একবার অফিস যাই এবং সাইকেলে যাই।’ যদিও তিনি মনে করেন, শরীরের অবস্থা আগের মতো ভালো নয়, তবে তিনি আসলে আগের মতো প্রাণচঞ্চলই আছেন। মাঝে মাঝে শিক্ষার্থীদের একটি বিষয় বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি টানা দুই ঘন্টা ক্লাস নেন। যে-কোনো পেশাগত বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করতে আগ্রহী তিনি।

২০১৭ সালে যুবক শিক্ষক ছেন চিয়ে অধ্যাপক চৌ’র গবেষনাদলে যোগ দেন। অধ্যাপক চৌ’র জীবন সম্পর্কে ছেন বলেন, ‘অধ্যাপক চৌ এখন তিনটি গবেষকদলের গবেষণাকাজের নির্দেশনা দেন। অফিসে তিনি বিভিন্ন নতুন বিষয় অনুসন্ধান করেন এবং জটিল গবেষণার ব্যাপার নিয়ে আমাদের সাথে আলাপ করেন।’ গবেষণার কাজ ছাড়া, তিনি ঘরের কাজেও দক্ষ। এ সম্পর্কে ছেন বলেন, ‘যদিও অধ্যাপক চৌ’র বয়স ৯০ বছরের বেশি, তিনি প্রতিদিন বাড়িঘর পরিষ্কার করেন এবং নিজেই রান্না করেন। যদিও একই কাপড় বহু বছর ধরে পরে তিনি অভ্যস্ত, তবে তা সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছিন্ন থাকে।’

গত কয়েক বছরে অধ্যাপক চৌ’র শারীরিক অবস্থা দুর্বল হয়েছে। কিন্তু তিনি আরো মনোযোগ দিয়ে, সময় নিয়ে গবেষণাকাজ করেন। যুবক শিক্ষক ছেন মনে করেন, অধ্যাপক চৌ আগের মতোই পরিশ্রমী আছেন। তিনি যেন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন।

সুপ্রিয় বন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা এখানে শেষ হয়ে এলো। আমাদের অনুষ্ঠান যারা মিস করেছেন, তারা আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন। ওয়েবসাইট ঠিকানা www.bengali.cri.cn,ফেসবুকে CRIbangla মাধ্যমে চীন ও বিশ্ব সম্পর্কে আরও অনেককিছু জানতে পারেন। তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন, আগামী সপ্তাহে আবার কথা হবে,যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)