সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম চীনে দ্বিতীয় বারের মতো করোনাভাইরাসের উত্স অনুসন্ধানের জন্য চীনকে সচ্ছতা, উন্মুক্ততা ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে আন্তর্জাতিক তদন্ত দলকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্বের বৃহত্তম স্বাস্থ্য-বিষয়ক সংস্থার মহাপরিচালক হিসেবে আধানমের এ ভাষণ অনেকের কাছে অযৌক্তিক মনে হয়েছে। কারণ গত মে মাসে স্বয়ং হু চীনে উত্স অনুসন্ধানের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাঁর এ ভাষণ ওই প্রতিবেদনের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। ফলে ভাষণটিকে অনেকে হাস্যকর বলে মনে করছে।
চীনে একটি প্রবাদ রয়েছে, জনগণের চোখে সবকিছু পরিস্কার। মহাপরিচালক আধানমের মনোভাবের আকস্মিক পরিবর্তনের দিকে অনেকের চোখে পড়েছে। তারা তাকে রাজনীতি নয়, বরং বিজ্ঞানের রাস্তায় ফিরে আসার আহ্বান জনায়।
গত ১৫ জুলাই, আটচল্লিশটি দেশ তাকে এই বার্তা পাঠান। বার্তায় বলা হয়, চীনের সাথে যৌথভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনকে রক্ষা করত হবে। বিশ্বব্যাপী করোনার উত্স অনুসন্ধান করা উচিত। এ পর্যন্ত আরও ৭টি দেশ তাকে বার্তা পাঠিয়ে করোনার উত্স অনুসন্ধানের রাজনীতিকরণের বিরোধিতা করেছে।
সবাই জানেন, এর আগে বিশ্বে করোনার উত্স অনুসন্ধানকাজ বেগবান করতে চীন সর্বপ্রথমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। হুর বিশেষজ্ঞরা চীনা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি যৌথ গবেষণা দল প্রতিষ্ঠা করে এবং চীনে গবেষণা চালিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ল্যাব থেকে করোনার বের হওয়া প্রায় অসম্ভব’।
বিশ্ববাসী এটিও জানেন, চীনের আগে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক স্থানে করোনা আক্রান্ত রোগীর উপস্থিতি সম্পর্কে পরবর্তীতে জানা গেছে। তাই সে সব স্থানেও অনুসন্ধান প্রয়োজন।
চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের উপ-মহাপরিচালক চেং ই সিন সম্প্রতি এক প্রেস ব্রিফিংয়ে আবারও জোর দিয়ে বলেন, চীন উন্মুক্ত, স্বচ্ছত, বিজ্ঞানসম্মত এবং সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ দলকে সহযোগিতা করেছে। বিশেষজ্ঞের সফরের সব চাহিদা মেটানো হয়েছে। তারা যেখানে যেতে চাইতেন, সেখানে যাওয়ার আয়োজন করেছিল সংশ্লিষ্ট বিভাগ। সে প্রতিবেদন বিজ্ঞানসম্মত এবং সময় ও ইতিহাসের নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেই।
চীনে নভেল করোনাভাইরাসের খবর প্রকাশিত হওয়ার আগেই বিশ্বের বেশ কয়েকটি স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল বলে বর্তমানে অধিক থেকে অধিকতর প্রমাণ পাওয়া গেছে। মার্কিন জাতীয় স্বাস্থ্য একাডেমী গত জুন মাসে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, নভেল করোনাভাইরাস ২০১৯ সালের ডিসেম্বরেই যুক্তরাষ্ট্র ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ব্রাজিলের একটি বর্জ্য পানিতে ভাইরাসটির জিনের উপাদান পাওয়া গেছে। ইতালির মিলানের ক্যান্সার গবেষণা কেন্দ্রের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা সম্ভবত ২০১৯ সালের অক্টোবরেই দেশটিতে ছড়িয়ে পড়ে। এসব প্রমাণ করে, করোনার উত্স হয়ত একটি নয়। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উচিত বিশ্বের নানা দেশ ও নানা স্থানে উত্স অনুসন্ধান করা।
চীনের রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের মহামারি সংক্রান্ত বিদ্যার সাবেক প্রধান বিজ্ঞানী চেং কুয়াং এর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সময় সূচীর ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী উত্স অনুসন্ধানের পরিকল্পনা করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ২০১৯ সালের ডিসেম্বেরে আগে যেসব স্থানে এই ভাইরাসে সংক্রমিত রক্ত সংগৃহীত হয়েছে, সেসব স্থানে তদন্ত করা প্রয়োজন।
চেং কুয়াং জোর দিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে উত্স অনুসন্ধানে প্রাধান্য দিতে হবে। কারণ সেখানে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের আগেই ভাইরাসের সন্ধান পাওয়া যায়।
তা ছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র বারবার ‘ল্যাব থেকে ভাইরাস বের হওয়া’র দাবি করছে। তাহলে মার্কিন ‘ফোর্ট ডেট্রিক” ল্যাবে তদন্ত প্রয়োজন। এ ল্যাবের নিরাপত্তা রেকর্ড খুবই খারাপ। মার্কিন গণমাধ্যমের সুত্রে জানা গেছে, এ ল্যাবে বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক ও সংক্রামক ভাইরাস রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নভেল করোনাভাইরাস। এ ল্যাব থেকে একসময় অ্যানথ্রাক্স ভাইরাস চুরি হয়েছে, যাতে বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়। বিশ মাস সময়ের মধ্যে সেখানে অসংখ্যবার প্রতিরোধ ব্যবস্থা ব্যাহত হয়। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা তৈরি হয়। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে, এ ল্যাবটি হঠাত্ বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ঠিক এর পরপরই, ল্যাবের পার্শ্ববর্তী এালাকায় অজানা ‘শ্বাসযন্ত্রের’ মারাত্মক রোগ ছড়িয়ে পড়ে, তাতে ২ কোটি ৮০ লাখ লোক আক্রান্ত এবং ৬০ হাজার মানুষ মারা যায়। তবে, যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে অস্বীকৃতি জানায়।
পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি সংস্থা বেশ কয়েকটি স্থান থেকে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণা করে। তাতে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসেই নভেল করোনাভাইরাস যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানানো হয়। এসব কিছুই যুক্তরাষ্ট্রকে সন্দেহের তালিকায় নিয়ে আসে। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই করোনার উত্স অনুসন্ধানের দাবি করে এবং এ বিষয়ে চীনকে অপমান করে আসছে। তবে, আন্তর্জাতিক সমাজের সন্দেহ ও দাবির মুখে ফোর্ট ডেট্রোক নিয়ে নীরবতা পালন করছে। তাতে সবার মনে প্রশ্ন উঠছে, যুক্তরাষ্ট্র, তুমি কী সত্য লুকাতে চাচ্ছো?
উত্স অনুসন্ধানে চীন বরারবই উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ মনোভাব নিয়ে হু’কে সহযোগিতা করছে। হু ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে দুবার চীন সফর করেছে। এবার যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাব ও ইলেকট্রনিক ককটিল নিউমোনিয়া নিয়ে তদন্তের পালা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উচিত বস্তুনিষ্ঠ ও সমতাসম্পন্ন মনোভাব নিয়ে আন্তর্জাতিক সমাজের দাবিকে মাথায় রেখে বিজ্ঞানসম্মত ও যুক্তিযুক্ত অনুসন্ধানকাজ চালিয়ে যাওয়া। মানব জাতি এবারেই প্রথম এবং শেষবারের মতো মহামারির সম্মুখীন হয়নি। তাই আসল উত্স অনুসন্ধান করে মানব জাতির নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য রক্ষা করতে হবে।
(রুবি/এনাম)