মালভূমির সবচেয়ে সুন্দর ফুল, দেশের সীমান্তরক্ষাকারী দোলকা
2021-07-23 16:48:08

মালভূমির সবচেয়ে সুন্দর ফুল, দেশের সীমান্তরক্ষাকারী দোলকা

 

মালভূমির সবচেয়ে সুন্দর ফুল, দেশের সীমান্তরক্ষাকারী দোলকা_fororder_zhuo1

গত ২৯ জুন তিব্বতের বৈশিষ্ট্যময় ও ঐতিহ্যবাহী পোশাক পড়ে ৬০ বছর বয়সী চীনের ইয়ু মাই গ্রামের সাবেক প্রধান দোলকা বেইজিংয়ে গণ-মহাভবনে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সর্বোচ্চ পদক ‘পয়লা জুলাই পদক’ গ্রহণ করেন। সে মুহূর্তে তিনি খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন।

দেশপ্রেমিক সীমান্তরক্ষী হিসেবে দোলকা বছরের পর বছর ধরে ভালোভাবে দেশের সীমান্ত রক্ষা করেছেন। আজকের অনুষ্ঠানে আপনাদেরকে তাঁর গল্প বলবো।

 

ইয়ু মাই গ্রাম তিব্বতের সাননান শহরের লুংজি জেলায় অবস্থিত। এই গ্রাম চীন ও ভারতের সীমান্তে অবস্থিত।

১৯৯৫ সালের আগের কয়েক ডজন বছরে দোলকা, তাঁর ছোট বোন ইয়াংজুং এবং বাবা সানজাই তুবা হলেন সেই ভূখণ্ডের একমাত্র  অধিবাসী।

একটি বাড়ি, সেটাই গ্রামের সরকারি ভবন।

 

কয়েক ডজন বছরের মধ্যে দূরবর্তী এই গ্রামটিতে বছরে ছয় মাসব্যাপী তুষারপাত হতো। এ কারণে বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে গ্রামটি। যেন একটি নিঃসঙ্গ দ্বীপ। ভারত মহাসাগরের মৌসুমি বায়ুর কারণে প্রতি বছর সেখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। তবে ইয়ু মাই গ্রামের জমি উর্বর মনে হলেও, ভালো ফসল পাওয়া যায় না। প্রতিবার বাইরে শস্য বিক্রি করতে হলে শুধু মানুষের কাঁধে করে এবং ঘোড়ার মাধ্যমে খাড়া উঁচু পাহাড়ি পথ ও জলাভূমি পার হতে হয়। তারপর আবারও ৫ হাজার মিটার উঁচু পাহাড় পার হয়ে ৪০ কিলোমিটার দূরের সবচেয়ে কাছাকাছি সড়কে ওঠা যায়।

মালভূমির সবচেয়ে সুন্দর ফুল, দেশের সীমান্তরক্ষাকারী দোলকা_fororder_zhuo2

১৯৬২ সালে কয়েক দফা মানুষ সেখানে যাতায়াত করে এবং পরে তা বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৮৩ সালে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে, অবশিষ্ট ৩টি পরিবারকে কাছাকাছি একটু ভালো পরিবেশের গ্রামে স্থানান্তর করা দরকার।

 

দোলকা আগের কথা স্মরণ করে বলেন: তখন তিনি বাবাকে বলতেন যে, বাবা, আমরা এই নতুন গ্রামে থাকি, আর ইয়ু মাই গ্রামে ফিরে যাবো না। দোলকা বলেন: তখন তিনি অনেক তরুণ, তরুণরা শুধু ভালো জায়গায় গিয়ে ভালোভাবে জীবনযাপন করার কথা ভাবে। দেশপ্রেমের অনুভূতি বেশিরভাগ তরুণের কাছে ধারণামাত্র।

তবে বাবা বলেন, আমার স্বপ্নেও ইয়ু মাই গ্রাম রয়েছে। সেটি হল আমাদের জন্মস্থান, আমাদের সেখানে ফিরে যাওয়া উচিত।

নতুন গ্রামে তারা শুধু একটি শীতকাল কাটায়; তারপর বাবার সিদ্ধান্তে দোলকা ও ছোট বোন আবারও বাবার সঙ্গে ইয়ু মাই গ্রামে ফিরে যায়। পরিবারের তিনজন আবারও বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন শুরু করে।

 

ইয়ু মাই কিন্তু বেশ বড় একটি জায়গা। এর আয়তন ৩৬৪৪ বর্গমিটার।

বাবা বলেন, যদি আমরা চলে যাই, তাহলে এই বিশাল ভূখণ্ড কে রক্ষা করবে? এই প্রশ্ন দোলকা এবং তাঁর ছোট বোনের মনে গভীর ছাপ ফেলে।

 

এখনও দোলকার মনে আছে, একদিন বাবা বাসায় পোশাক তৈরি করার জন্য লাল ও হলুদ কাপড় খুঁজে বের করেন এবং  তারপর কিছু তৈরি করা শুরু করেন।

তখন তিনি ভেবেছিলেন, বাবা নিশ্চয় তার ও ছোট বোনের জন্য নতুন পোশাক তৈরি করতে যাচ্ছেন।

তবে না। দুই বোন তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, এটা কি?

বাবা হাসিমুখে বলেন, এটা হল চীনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস।

সেদিন, গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের বিশাল ভূখণ্ডের ছোট এক কোণায়, একটি পাঁচতারকা খচিত লাল পতাকা বাতাসে উড়তে শুরু করে। যা ছিল দোলকার বাবার হাতে তৈরি চীনের জাতীয় পতাকা।

পরে প্রত্যেক বার তিনি যখন বাইরে যেতেন, তিনি সবসময় নতুন জাতীয় পতাকা কিনতেন।

দুই বোন বুঝতে পেরেছিল, নিজের পায়ের নিচের এই জমি রক্ষা করা মানে দেশকে রক্ষা করা।

মালভূমির সবচেয়ে সুন্দর ফুল, দেশের সীমান্তরক্ষাকারী দোলকা_fororder_zhuo3

সীমান্ত রক্ষার জন্য বাবা সানজাই তুবা ১৯৬০ সালে ইয়ু মাই গ্রাম প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গ্রামের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এই পদে তিনি ২৯ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮৮ সালে দোলকা বাবার হাত থেকে এই দায়িত্ব বুঝে পান এবং তিনিও ২৩ বছর ধরে একই দায়িত্ব পালন করছেন।

 

১৯৯৯ সালে ইয়ু মাই গ্রামে ৫টি পরিবারে মোট ২২জন মানুষ ছিল। গ্রামটির মাথাপিছু আয় তিব্বতের কৃষক ও পশু পালকদের মাথাপিছু আয়ের চেয়েও বেশি। যার পরিমাণ ২১৪৩ ইউয়ান।

 

একই বছর চার কোটি ইউয়ান বরাদ্দ দিয়ে ছুইইয়ু সড়কের নির্মাণকাজ শুরু হয়। সে বছর থেকে ইয়ু মাই গ্রামে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিনে সবসময় জাতীয় পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। যা ছিল গ্রামবাসীদের দেশপ্রেমের অনুভূতি প্রকাশের সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি।

 

দোলকা সাংবাদিকদের বলেন: আমরা সবসময় টিভিতে দেখতাম যে, আমাদের সিপিসি’র সাধারণ সম্পাদক সি চিন পিং দূরবর্তী পাহাড়ি এলাকায় গিয়ে জনসাধারণের খোঁজখবর নেন, তাই আমরাও তাঁকে একটি চিঠি লিখে আমাদের বর্তমান ভালো জীবনের কথা জানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা কল্পনাও করতে পারি নি যে, প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং আমাদের চিঠির জবাব দেবেন।

২০১৭ সালের ২৮ অক্টোবর, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং দোলকা ও ইয়াংজু’র চিঠির জবাব দেন। চিঠিতে তাঁদের দুই প্রজন্মের সীমান্ত রক্ষার কর্তব্যকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যুগের পর যুগ ধরে সীমান্ত রক্ষার জন্য ধন্যবাদ জানানো হয় এবং স্থানীয় কৃষক ও পশুপালকদের সীমান্ত এলাকা উন্নয়নে উত্সাহ দেওয়া হয়।

মালভূমির সবচেয়ে সুন্দর ফুল, দেশের সীমান্তরক্ষাকারী দোলকা_fororder_zhuo4

বিরাট পরিবর্তন: সুন্দর ইয়ু মাই

২০১৭ সালে চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদ ‘সীমান্ত এলাকা সমৃদ্ধ করে জনগণকে ধনী করার লক্ষ্যে ‘ত্রয়োদশ পাঁচসালা পরিকল্পনা’ প্রকাশ করে। এতে ত্রয়োদশ পাঁচসালা পরিকল্পনাকালে গভীরভাবে সীমান্ত এলাকা সমৃদ্ধ করে জনগণকে ধনী করা এবং সীমান্ত এলাকার দ্রুত উন্নয়নে সমর্থন জানানোর কাজের সার্বিক বিন্যাস করা হয়।

দেশের অন্যান্য সীমান্ত এলাকার মতো, সুন্দর জীবন সম্বন্ধে ইয়ু মাই গ্রামের মানুষের আকাঙ্ক্ষা ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হচ্ছে।

 

২০১৭ সালে চীন সরকার ছুই ইয়ু সড়ক নির্মাণের জন্য ৫০ কোটি ইউয়ান বরাদ্দ দেয়। চীনের রাষ্ট্রীয় বিদ্যুত্ নেট ইয়ু মাই গ্রামে বিদ্যুত্ সংযোগের ব্যবস্থা করে। গ্রামের প্রত্যেক পরিবার ওয়াইফাই সেবা পাচ্ছে। চীন সরকার ইয়ু মাই গ্রামে ১২ কোটি ইউয়ান বরাদ্দ দিয়েছে। এ অর্থ দিয়ে ৬৭টি ‘সুখী ও সুন্দর সীমান্তবর্তী সচ্ছল গ্রাম’ গড়ে উঠেছে। এতে তিব্বত স্টাইলের বাড়িঘর, চিকিত্সা কেন্দ্র ও গ্রামের সরকারি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।

 

সময় যেন ইয়ু মাই গ্রামের সেই নদীর মত বয়ে যায়। ২০২০ সালের আগের সেই ‘তিন জনের গ্রাম’ বর্তমানে ৬৭টি পরিবার ও ২৩৪জনের সচ্ছল সীমান্ত গ্রামে পরিণত হয়েছে। এটি এখন সুখী ও সুন্দর সচ্ছল গ্রাম।

বর্তমানে ইয়ু মাই গ্রামের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পিচঢালা রাস্তায় হাঁটলে সুন্দর বাড়িঘর, নির্মাণাধীন গ্রামীণ জাদুঘর, পর্যটন কেন্দ্র ও নানা পরিবর্তন দেখা যায়। গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে আছে অভূতপূর্ব প্রাণের ছোঁয়া।

২০২০ সালে ইয়ু মাই গ্রামের মাথাপিছু আয় ছিল ৩৪,০১২ ইউয়ান। যা সে বছর তিব্বতের গ্রামবাসীদের মাথাপিছু আয়ের দ্বিগুণ।

 

বাসা মানে ইয়ু মাই, দেশ হল চীন

আগে ইয়ু মাই গ্রামে কোনো স্কুল ও বিদ্যালয় ছিল না, দোলকা এজন্য খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। কারণ তিনি জানেন, শিশুরা হলো ইয়ু মাই গ্রামের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা।

দোলকা সাংবাদিককে বলেন, ২০১৯ সালে ইয়ু মাই গ্রামের প্রথম কিন্ডারগার্ডেন চালু হয়। তিন ক্লাসের এই কিন্ডারগার্ডেনে মোট ১৮টি শিশু আছে।

২০২০ সালে ইয়ু মাই প্রাথমিক স্কুল শুরু হয়। বর্তমানে প্রথম শ্রেণীতে ৮টি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। দ্বিতীয় শ্রেণীতে দুটি ছাত্র আছে। দোলকা বলেন, আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্য হল আরো ভালোভাবে সীমান্ত রক্ষা করা এবং দেশকে ভালোবাসার চেতনা লালন করা।

 

জুলাই মাসের ইয়ু মাই গ্রামে সিল্কের মতো পাতলা কুয়াশা সবুজ পাহাড় জড়িয়ে ছিল। দোলকা বলেন, এখানে স্থানান্তর হওয়া নতুন লোকজন সবসময় আমাকে সীমান্ত রক্ষার জন্য টহলের পথের কথা জিজ্ঞেস করে। তিনি বলেন, এখন ইয়ু মাই গ্রামের মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। তরুণ মানুষরা টহলের সময় আরো দূরে এবং আরো উঁচু পাহাড়ে উঠতে পারে। বয়স্ক গ্রামবাসীরা কাছাকাছি এলাকায় পশু চড়াতে যায়। বাইরের বড় দুনিয়া দেখার পর দোলকা ঠিক তার বাবার মতো এই সুন্দর মালভূমিকে আরো বেশি ভালোবাসেন।

 

বর্তমানে দোলকা তাঁর বাবার মত, এখনও নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পাদন করে যাচ্ছেন। তিনি গ্রামবাসীদের নেতৃত্ব দিয়ে এই সুন্দর ভূমিতে সুন্দর জীবনযাপনের জন্য চেষ্টা করছেন।

বড় কোনো কথা নেই, শুধু চুপচাপ নিজের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। কোনো মহান প্রতিশ্রুতি নয় শুধু নীরবে দেশকে ভালোবাসে কাজ করে যান তিনি।

 

এখন ইয়ু মাই গ্রাম পরিবর্তিত হয়েছে। তবে যা পরিবর্তিত হয়নি, তা হল ইয়ু মাই গ্রামবাসীদের দায়িত্বশীল মনোভাব এবং দেশের প্রতি তাদের বিশ্বস্ত ভালোবাসা।

সিপিসির সর্বোচ্চ পদক ‘পয়লা জুলাই পদক’ হাতে নিয়ে দোলকা বলেন, এই পদক, ইয়ু মাই-এর, তিব্বতের এবং দীর্ঘসময় ধরে দেশের সীমান্ত রক্ষাকারী সব সাধারণ মানুষের।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)