আজহার লিমন, ঢাকা: করোনার এই সংকটময় মুহুর্তেও ঢাকা ছেড়েছে অর্ধকোটির বেশি মানুষ। কিন্তু এই ঈদযাত্রা কি শুধুই আবেগের? এর পেছনে নির্মম বাস্তবতা কতটুকু? সমাজবিজ্ঞানী ও নগরবিদরা বলছেন, একপেশে নগরায়নের প্রভাবে শহরে শ্রমভিত্তিক যে বিরাট জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে অর্থনৈতিক বৈষম্যের মত তারাও আন্তরিকতা ও নিরাপত্তার সংকটের মুখোমুখি। ফলে যুগ যুগ ধরে আপন হয়ে উঠছে না নগর।
ঈদের আগে দিন ঢাকার সড়কের এক রিক্সাচালক
ঢাকা শহরে প্রায় ১০ লাখ রিক্সা চলে। কিন্তু ঈদের মাত্র একদিন আগে শহুরে সড়কগুলো অনেকটাই ফাঁকা দেখতে পাচ্ছি। প্রশ্ন হলো, করোনার দ্রুত বিস্তার ও বিঁধিনিষেদের মাঝে শহরের এই প্রান্তিক মানুষেরা গেল কোথায়?
আমাদের কথা হয় রিক্সাচালক আজাদের সঙ্গে। বনানীর একটি সড়কে ঈদের আগের দিন রিক্সা চালাতে দেখা গেল তাকে। তিনি জানান, প্রতিবারের মত এবারও ঈদ আসার কারণে বাড়ি ফিরে গেছেন বেশিরভাগ রিক্সাচালক।
আপনি ফিরবেন না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “আগের দিন ফিরবো।”
রিক্সাচালক আজাদ জানান, ঢাকায় একজন রিক্সাচালক থেকে যাবেন সে সুযোগ নেই। তাছাড়া স্ত্রী, সন্তান মা-বাবাও গ্রামে। একটু আনন্দ অন্তত ভাগাভাগি করতে সে গ্রামেই যাবেন।
ঈদ আসলে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বড় শহর থেকে কী পরিমাণ মানুষ নিজ গ্রামে স্থানান্তর হয়, তার সঠিক কোন হিসেব নেই কারও কাছে। তবে যাত্রীকল্যাণ সমিতি নামে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি সংগঠন বলছে, ঈদ আসলে ঢাকা ছেড়ে যায় প্রায় ১ কোটি মানুষ। সবমিলিয়ে দেশের বিভিন্ন নগরী থেকে শেকড়ে ফেরেন এ সংখ্যাটা প্রায় ৩ কোটি। কিন্তু কেন?
ছবি: ঢাকা মহিলা পলিটেকনিকের ইন্সটাকটর এস এম নিয়ামুল হোসাইন
ঢাকা মহিলা পলিটেকনিকের ইন্সটাকটন এস এম নিয়ামুল হোসইন বলেন, “আমি যে ঢাকায় থেকে যাবো আমার তো কোন নিকটাত্নীয় ঢাকায় নেই। তাহলে কীভাবে আমি ঈদের সময়গুলো কাটাবো। এটা তো একটা বন্দি জেলখানার মত হয়ে দাড়াবে। তাছাড়া প্রচন্ড আবেগ কাজ করছে। কারণ মা-সহ গোটা পরিবার বাড়িতে।”
বাস্তবতাও হচ্ছে জীবন ও জীবিকার তাগিদে স্বস্তা শ্রমের এই শহরে জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশই বাইরে থেকে আসা। অভিবাসী এ জনসংখ্যার মধ্যে যারা এ শহরে একটু মাথা গোজার জায়গা করে নিতে পেরেছেন, তাদের ৬০ ভাগেরই জন্ম গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সমাজবিজ্ঞানী তৌহিদুল হক বলেন, বিশাল এই জনগোষ্ঠীর এই স্থানান্তর যে শুধু আবেগের নয়, করোনার এই সংকটকালেও ঘরে ফেরা মানুষের স্রোত তা প্রবলভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
তিনি বলেন, “শহরে যে সম্পর্কগুলো তৈরি হয় তা প্রয়োজনকেন্দ্রিক সম্পর্ক। প্রয়োজনের পেক্ষাপটে যে সম্পর্কটা তৈরি হলো তা প্রয়োজনেই শেষ হয়ে যায়। এ কারণে শহরের মানুষের উৎসব উদযাপনটা অনেকটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে যায়। ব্যক্তিকেন্দ্রিক এই অর্থে সবাই নিজের মত করে উৎসব উদযাপন করছে নিজেই ভোগ করছে। প্রতিবেশির প্রতি যে খেয়াল রাখা বা খোঁজ নেওয়া এই জায়গাটাতে শহরবাসীর খুব একটা নজর থাকে না। বিশেষ করে যারা শহরের আদি বাসিন্দা নয়। আমাদের কিন্তু ১৬ থেকে ২০ ভাগ মানুষ রাজধানীর যাদের কিন্তু শহরে স্থায়ী ঠিকানা রয়েছে বাকি সবাই কিন্তু অস্থায়ী বা স্থানান্তরিত জনগণ।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তৌহিদুল হক
তার মানে উৎসব আসলে শহরের প্রান্তিক মানুষেরা আরও একলা হয়ে যায়। এ বিষয়টা কি এই করোনা সংকটের মধ্যে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠলো?
এর উত্তরে এই শিক্ষক বলেন, “শহরের মধ্যে স্বল্প আয়ের মানুষ যারা তাদের মধ্যে যারা কর্মহীন হয়েছে বা উপার্জন কমে গিয়েছে সে সমস্ত মানুষগুলোও কিন্তু বেঁচে থাকার তাগিদে শহরে থাকতে গেলে তার যে খাবারের নিশ্চয়তা সে জায়গায় কিন্তু অনিশ্চয়তা আছে সে জায়গাতেও কিন্তু সে গ্রামেই ফিরে যেতে চাইবে। কেন ফিরে যেতে চাইবে কারণ সেখানে তার আপনজনেরা রয়েছে যে আপনজনেরা সংকটের সময় তার পাশে দাড়াবে, তাকে ফেলে দেবে না, তাকে দূরে সরিয়ে দেবে না, তাদের চলাফেরার মধ্যে এই ব্যক্তিকেও সম্পৃক্ত করে নেবে।”
কিন্তু এতে নগরায়নের কোন দায় আছে কি? নগরবিদ ড. আদিল মুহম্মদ মনে করেন, মহামারির এ সংকটকালে স্পষ্ট হয়ে গেছে একপাক্ষিক শহরায়নের সংকটের দিক। তিনি মনে করেন, এতে শুধু বৈষম্যমূলক অর্থনীতিই তৈরি হয়নি শারিরীক ও মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে প্রান্তিক মানুষ।
পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহম্মদ
তিনি বলেন, “এখন একটা নগর এলাকায় বসবাস করতে গেলে সবার আগে প্রয়োজন হচ্ছে আবাসন। বিশ্বের সকল উন্নত দেশেই কিন্তু লোয়ার ক্লাস, লোয়ার মিডল বা মিডল ক্লাস লোকজনের জন্য এ সুযোগ কিন্তু আছে। আমরা দেখি যে তাদের জন্য সেখানে সোস্যাল হাউজিং তৈরি করা হয়। মানে হলো তারা তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী একটা মিনিমাম স্টান্ডার্ড একটা হাউজিংয়ে থাকবে। আমাদের ক্ষেত্রে দেখি তারা নাহয় একটি বস্তিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কিংবা তারা এমন কিছু লোকলিটিতে তাদের আবাসন এলাকা যেখানে তাদের নুন্যতম সেবা ও সুবিধাটা নেই। এই যে আবাসনের দিকে দিয়ে নগরায়নের যে সাম্য রাষ্ট্রের তৈরি করার কথা ছিলো সেটা তৈরি করতে পারেনি। শিক্ষা কিংবা চিকিৎসায়ও পারে নি।”
এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, প্রান্তিক মানুষদের জন্য এমনকি সাশ্রয়ী যোগাযোগ ব্যবস্থাও তৈরি হয় নি এখানে।
তার মানে কি বিকেন্দ্রিকরণের যে দাবি বা আলোচনা তা কি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে?
এ উত্তরে এই বিশেষজ্ঞ জানান, সরকারের নীতি নির্ধারণী সকল দলিলে বিকেন্দ্রিকরণের কথা বলা হলেও তা কাগজে কলমেই রয়ে গেছে।
এই দুই সমাজ ও নগর বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালীর চিরায়ত সম্প্রতি আর বন্ধনের বিপরীতে শহরে বস্তুবাদী যে সমাজ গড়ে উঠছে তাকে ফেরানো যাবে না। তবে ক্ষমতা ও শিল্পের বিকেন্দ্রীকরণ না হলে প্রান্তিক মানুষদের অর্থনৈতিক ও মানসিক সমৃদ্ধির ব্যাপারটি যে কাগজে কলমেই থাকবে তারও ইঙ্গিত দিচ্ছেন তারা।
আজহার লিমন। চীন আন্তর্জাতিক বেতার। ঢাকা।