বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতির অবনতি: সংক্রমণ-মৃত্যুতে ম্লান টিকার স্বস্তি
2021-07-18 20:08:59

দেশের করোনা পরিস্থিতি ক্রমশই অবনতির দিকে যাচ্ছে। গত শুক্রবার শেষ হওয়া চলতি বছরের ২৮তম সপ্তাহে মৃত্যু ও সংক্রমণ আগের সপ্তাহের চেয়ে বেড়েছে। আগের অর্থাৎ ২৭তম সপ্তাহে যেখানে মারা যান ১ হাজার ২৭৭ জন সেখানে পরের সপ্তাহে মৃত্যু হয়েছে ১ হাজার ৪৮০ জনের। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ। ২৭তম সপ্তাহে যেখানে রোগী শনাক্ত হয়েছে ৭৩ হাজার ৫৯ জন, সেখানে ২৮তম সপ্তাহে রোগী শনাক্ত হয় ৮৩ হাজার ৯৬ জন। অর্থাৎ রোগী শনাক্ত বেড়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ।

মৃত্যু ও সংক্রমণ গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। মাঝখানে এক দিন বাদ দিয়ে গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে মৃত্যু দু’শোর ওপরে রয়েছে। রাজধানী ঢাকার পরেই খুলনা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিভাগে মৃত্যু ও সংক্রমণ বাড়ছে হু হু করে। গোটা দেশেরই প্রায় একই চিত্র। সবকিছু মিলিয়ে খুব খারাপ একটা পরিস্থিতি সামনে- এটা প্রায় নিশ্চিত বলা যায়।

এরই মধ্যে কোরবানীর ইদকে সামনে রেখে সরকার দু’সপ্তাহের মাথায় লকডাউন তুলে নিয়েছে। ১৫ জুলাই থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত সব কিছু খুলে দেওয়া হয়েছে। চালু হয়েছে দূরপাল্লার গণপরিবহনও। মানুষ পড়িমরি করে ঢাকা ছাড়ছে। রাস্তাঘাট, হোটেল-রেস্তোঁরা, দোকানপাট, শপিংমল, কোরবানীর পশুরহাট- লোকেলোকারণ্য। এতে করে ইদের পর করোনা পরিস্থিতি খুব খারাপ হবে- একথা বলছেন- শুধু বিশেষজ্ঞরা নয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা এমনকি খোদ স্বাস্থমন্ত্রী নিজে। দেশে করোনা রোগী ভর্তি করার জন্য হাসপাতালে আর কোনো শয্যা খালি নেই বলেও জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। অক্সিজেন আর আইসিইউ ও শয্যা সঙ্কটের বিষয় তো গণমাধ্যমে নিয়মিতই খবর হচ্ছে।

করোনা বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি পরিষ্কার বলেছে, লকডাউন তুলে নেয়ার ক্ষেত্রে সরকার তাদের পরামর্শ নেয়নি। এবং তারা লকডাউন তুলে নেওয়ার বিপক্ষে ছিলেন। বরং ঢিলেঢালা বিধিনিষেধের পরিবর্তে কঠোর লকডাউনের কথা বলেন তারা।

তাহলে জেনেশুনে সরকার কেন এমন একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিল?

এটা ধারনা করা কঠিন নয় যে, কোরবানীর ইদকে ঘিরে হাজার হাজার কোটি টাকার একটা অর্থনৈতিক লেনদেনের বিষয় রয়েছে। আর ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট তো রয়েছেই। সরকার সেটাকে গ্রাহ্য করেছে- খুবই ভালো কথা। সেক্ষেত্রে সরকার গণপরিবহন এবং দূরপাল্লার যানবাহন বন্ধ রেখেও কোরবানীর পশুরহাট আর শপিংমল চালু করতে পারতো। তাতে অন্তত রাজধানী থেকে গ্রামমুখো জনস্রোত ঠেকানো যেতে।

অতীতে কিছু মানুষকে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পায়ে হেটে, ছোট যানবাহানে করে গাদাগাদি করে করোনা ঝুঁকি নিয়ে গ্রামে ছুটতে দেখা গেছে। কিন্তু সরকার চাইলে এবার তাদের রাজধানী কিংবা অন্য শহরের প্রবেশ ও নির্গমণ পথে আটকাতে পারতো। কিন্তু সরকার সে পথে না গিয়ে দূরপাল্লার গণপরিবহনসহ সবকিছু খুলে দিয়েছে। গত কয়েকদিনে দেখা গেছে ট্রেনে বাসে কিছুটা থাকলেও লঞ্চে স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই নেই। এমন অবস্থায় অনেকে পরিহাস করে বলছেন যে-মানুষ নয়, করোনা বাড়ি যাচ্ছে!

পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে গত ১ জুলাই থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত কঠোর লকডাউন দিয়ে করোনা কমানো না গেলেও যে ফলাফল সামনে পাওয়া যেতো সেটা আর পাওয়া গেলো না। এখন ইদের পর ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ফের কঠোর লকডাউন দিয়ে পরিস্থিতির কতটা সামাল দেওয়া যাবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে অভিজ্ঞ মহলের।

এমন একটা বিপন্ন অবস্থায় কিছুটা সুখবর রয়েছে টিকায়। সবশেষ শনিবার রাতে চীনের সিনোফার্মের ২০ লাখ টিকা পৌঁছেছে দেশে। সোমবার কোভ্যাক্সের আওতায় মডার্নার ৩৫ লাখ আসছে। চীন আগস্টে আরও ৪০ লাখ টিকা দেবে। রাশিয়ার কাছ থেকে পাওয়া যেতে পারে ১০ লাখ। কোভ্যাক্সের আওতায় সেপ্টেম্বরের মধ্যে আসবে সোয়া কোটির বেশি টিকা। সবমিলয়ে আগামী দুমাসে প্রায়  দু কোটি টিকা পাবে বাংলাদেশ।

এরমধ্যে টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন ১ কোটি ৫ লাখ মানুষ। রাজধানী ঢাকাসহ ১২টি সিটিতে দেওয়া হচ্ছে মডার্নার টিকা। সারাদেশে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সিনোফার্মের টিকায় সচল রয়েছে গণটিকা কর্মসূচি। যদিও টিকা পেতে অশেষ ভোগান্তি পোহাচ্ছেন রেমিটেন্সযোদ্ধা প্রবাসীরা।

দেশের বেশিরভাগ মানুষ যেখানে স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা করছে না, কঠোর লকডাউন যেখানে কদিন বাদে ঢিলেঢালা লকডাউনে পরিণত হচ্ছে, সেখানে টিকাটাই বোধ হয় শেষ প্রতিবিধান বাংলাদেশের জন্য।

মাহমুদ হাশিম

ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।