ইভ্যালীর মত অনলাইন মার্কেটপ্লেসগুলো নিয়ে কেন এত বিতর্ক?
আজহার লিমন, ঢাকা: চলমান করোনা সংকটের মধ্যে গেল দেড় বছরে বাংলাদেশে অনলাইন মার্কেটপ্লেস বা ই-কমার্স খাত যতোটা বিস্তৃত হয়েছে, এর আগে তেমনটা দেখা যায়নি। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন এই মাধ্যমের বিস্তার হওয়ার সমান্তরালে বাড়ছে ভোগান্তিসহ নানা অভিযোগ।
কথা হচ্ছিলো দেশের দ্বীপজেলা ভোলার একজন অনলাইন ক্রেতা ইকবালের সঙ্গে।
ছবি: ইভ্যালীর ক্রেতা ইকবাল হোসেন
ইকবাল বলছেন, “আমরা ভেবেছিলাম বড় একটা কমিশন পাবো একটু সময় নিক, সমস্যা কী। কিন্তু ঐ সুযোগ পেতে গিয়ে এখন দেখছি বড় শঙ্কা ডেকে আনছি। আমরা তো টাকা দিয়ে প্রোডাক্ট কিনবো। এত ঝামেলা হবে কেন?”
এই তরুণ জানান, ইভ্যালী নামে দেশের একটি অনলাইন মার্কেটপ্লেস থেকে প্রায় ১ বছর ধরে অগ্রীম অর্থ পরিশোধ করে বিভিন্ন পণ্য কেনার অর্ডার দিয়েছেন তিনি। প্রথম দিকের অর্ডারগুলো হাতে পেলেও পরের অর্ডারের অনেক পণ্য বুঝে পাচ্ছেন না দীর্ঘ দিন ধরে। এখন ছাড়ে পণ্য কেনার লাভের আশা রূপান্তরিত হয়েছে লগ্নি করা অর্থ ফেরত না পাওয়ার শঙ্কায়।
এমন শঙ্কা আছে দেশের অনলাইন মার্কেটপ্লেসগুলোর কয়েক লাখ ক্রেতার মনে। বিশেষ করে ইকমার্স এই সাইটগুলোর মন্তব্যের ঘরে প্রতিনিয়ত হয়রানির বিষয়গুলো তুলে ধরছেন ভুক্তভোগীরা। এর বিপরীতে কার্যকর কোন বিজ্ঞপ্তি বা ঘোষণা দেখা না গেলেও সামাজিক বিভিন্ন সাইট ব্যবহার করে এসব ক্রেতাদের মনোবল ধরে রাখতে প্রেরণামূলক বক্তব্যও দিতে দেখা যায় প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ণধরের পক্ষ থেকে।
অনলাইনে ক্রেতাদের মোটিভেশন দিতে দেখা যায় ইভ্যালীর কর্ণধার মো. রাসেলকে
কিন্তু বিকাশের শুরুতেই এখাত নিয়ে এত বিতর্ক কেন? ইকমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ইক্যাবের জেনারেল ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলম মনে করেন, মানুষের মধ্যে তৈরি হওয়া এ ধারণা ই-কমার্স খাতের সম্ভাবনায় ভবিষত ম্লান করে দিচ্ছে।
জাহাঙ্গীর আলম শোভন, জিএম, ইক্যাব
তিনি বলেন, “কিছু ব্যাড প্রাকটিস বলতে পারেন আবার বলতে পারেন সেবার মান খারাপ যে কারণেই হচ্ছে। কাস্টমার যদি হ্যাপি না হয় তাহলে তো এমন বিতর্ক হওয়াটাই স্বাভাবিক। এখন যে অভিযোগ আসছে তার মধ্যে ডেলিভারী। প্রথম দিকে আমাদের ডেলিভারি সার্ভিসটা ভালো ছিলো না। তবু মানুষ দু’দিন ৪ দিনে ডেলিভারী পেয়ে যেত। কিন্তু এখনকার অভিযোগ আরেকটু ভিন্ন। মানুষের টাকা আটকে আছে ৬ মাসেও ডেলিভারী পাচ্ছে না। দেখুন এ সমস্ত অফার যে প্রতিষ্ঠানগুলো দিচ্ছে বেশিরভাগই কিন্তু ই ক্যাবের সদস্য না। তাদের তথ্যও কিন্তু সরকার পাচ্ছে না। আর যে প্রতিষ্ঠানগুলো ই ক্যাবের সদস্য ওদের তথ্য কিন্তু আমরা সরকারকে দিচ্ছি। যদি এমন হয় ইক্যাব সদস্যপদ স্থগিত করলে কোন সমাধান হয় কি না। আমরা সেটা নিয়ে ভাবছি। কিন্তু তাতে তো তার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে না।”
কিন্তু এসবের বিপরীতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কী ভূমিকা নিচ্ছে? সম্প্রতি অনলাইন মার্কেটপ্লেস ইভ্যালীর ৬৫ কোট টাকার চলতি সম্পদের বিপরীতে ৪শ কোটি টাকার বেশি দায় ও দেনার বিষয়টি আলোচনার আসার পর কিছুটা তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর। এর ধারাবাহিকতা দেশের প্রায় ১০টি ইকমার্স সাইটে আর্থিক লেনদেনের নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে দেশের কয়েকটি ব্যাংক। তড়িঘড়ি করে ‘ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা ২০২১’ নামে একটি গেজেটও প্রকাশ করতে দেখা যায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। কিন্তু এসব নির্দেশিকায় অনিয়ম ও আর্থিক কেলেংকারীতে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স বাতিল ছাড়া নেই সুনির্দিষ্ট কোন শাস্তির ঘোষণা। কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন মনে করেন, এসব ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাসহ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়ে হতাশ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
এসএম নাজের হোসাইন, ভাইস প্রেসিডেন্ট, ক্যাব
তিনি বলেন, “রেগুলটারি কর্তৃপক্ষ কিন্তু সবসময় নজর রাখবে। তাতে কেউ কমপ্লিন করুক আর না করুক। তাদের যে সেক্টরের আওতায় যে অ্যাক্টর আছে তারা কে কীরকম করতেছে সে বিষয়গুলো তদারকি করা কিন্তু তাদের রুটিন দায়িত্ব। এখন আপনি কমপ্লিন করলেন তারপরে আসলেন। আর ইভ্যালীর মত ১০% টাকা দিয়ে ১০০% পণ্য পাওয়ার যে প্রতারণা এ বিষয়গুলো তো তাদেরই দেখার দরকার ছিলো। আর কোম্পানী বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলছেন। কোম্পানী বন্ধ করে দিলে তো ক্রেতাদের ঝুঁকি তো আরও বেশি।”
এ বিশ্লেষক বন্ধ হয়ে যাওয়া এমএলএম কোম্পানী যুবকের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, যুবকের অসংখ্য গ্রহণ এখনও কিন্তু তাদের পুঞ্জিভূত অর্থ আর ফেরত পান নি।
এমন অবস্থায় এ নিয়ে সরকারের অবস্থান কি হবে, বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
ইক্যাব বলছে, প্রতিষ্ঠিত কোম্পানীর বাইরেও প্রায় ২০ হাজার ফেইসবুকভিত্তিক গ্রুপের মাধ্যমে অনলাইন ব্যবসা পরিচালনা করে যাচ্ছে দেশের ছোটবড় অনেক উদ্যোক্তা। তবে এসব ক্ষেত্রেও প্রত্যাশিত পণ্য না পাওয়া, মান ও সরবরাহের নানা অভিযোগ আছে ক্রেতাদের মধ্যে।