মরুকরণ প্রতিরোধের বীর সি কুয়াং ইন
2021-07-14 11:12:43

মরুকরণ প্রতিরোধের বীর সি কুয়াং ইন_fororder_shi1

 

সম্প্রতি চীনের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার শততম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে ২৯ জনকে সিপিসি’র সর্বোচ্চ পদক ‘পয়লা জুলাই পদক’ প্রদান করা হয়েছে। যাতে নিজস্ব অঞ্চলে তাঁদের উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া যায়। সি কুয়াং ইন তাদের মধ্যে একজন। তিনি সিপিসি’র একজন সদস্য। তিনি হলেন চীনে মরুকরণ প্রতিরোধ এবং বৃক্ষরোপণ প্রকল্পের অন্যতম প্রতিনিধি। ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি মরুভূমির কঠিন পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, মরুকরণ প্রতিরোধ করেছেন এবং জনগণকে ধনী করার ব্যবস্থার সংযোগ করার নতুন কাঠামো স্থাপন করেছেন। তিনি চীনের মাও উ সু মরুভূমির দক্ষিণাঞ্চলের খারাপ প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নয়নের জন্য উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।

 

চীনের শায়ানসি প্রদেশের তিং বিয়ান জেলায় গ্রীষ্মকালে একবার প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়। সি কুয়াং ইন তাঁর নাতিকে নিয়ে পাইন গাছের নিচ দিয়ে হাঁটছেন। এই পাইন বনের গাছগুলো তিনি চাষ করেছেন। চারপাশে বিভিন্ন পাখির শব্দ শোনা যায়। গাছ দিয়ে বৃষ্টির পানি নামছে। চোখের সামনে এই ৬০০০ মু সবুজ দুনিয়ার কিন্তু একটি ভয়ংকর নাম আছে; তা হলো- ‘লাং ও শা’। এর অর্থ নেকড়ে বাসার বালি। আজ থেকে ৩০ বছর আগে, স্থানীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ এই নামের মতোই ভয়ংকর ছিল। সবখানে শুধু বালি আর বালি, ধু ধু মরুভূমি, কোথাও কোনো সবুজের চিহ্ন নেই। কুইকস্যান্ড মানুষের জীবনের নিরাপত্তার বড় হুমকি।

 

সি কুয়াং ইন মাও উ সু মরুভূমির দক্ষিণাঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় তিনি মরুভূমির কষ্টকর জীবন সহ্য করে বড় হয়েছেন। স্থানীয় লোকজন বলে: পুরো বছরজুড়ে শুধু বালিঝড় হতো। যা স্থানীয় লোকজনের কাছে ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। কুইকস্যান্ড এড়ানোর জন্য সি কুয়াং ইনের পরিবার নয়বার বাসা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়।

 

সি কুয়াং ইনের ছোটবেলার স্মৃতি শুধু বালিঝড়ে পরিপূর্ণ। বাতাস শেষ হলে লোকজনের বাসার সবখানে বালির স্তর জমে যেত। জমিতে যেসব গম থাকত, বালিঝড় শেষ হলে কিছুই দেখা যেত না। সবই বালুর নিচে চাপা পড়ে যায়। সি কুয়াং ইন স্মরণ করে বলেন, তখন এক মু জমি থেকে শুধু একশ কেজি শস্য পাওয়া যায়। যা খাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়।

স্থানীয় ফাইল থেকে জানা যায়, ১৯৪৯ সালের আগের বছর, অর্থাত্ নয়াচীন প্রতিষ্ঠার একশ’ বছর আগে, ইয়ু লিন মরুভূমি এলাকায় ২১ লাখ মু জমি বালিঝড়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, ১৯৪৯ সালের জুন মাসে ইয়ু লিন মরুভূমি এলাকায় ঘাসের পরিমাণ ছিল মাত্র ১.৮ শতাংশ!

 

মরুভূমির আয়তন বাড়তে থাকে, মানুষের জমি হারিয়ে যেতে থাকে। ক্রমবর্ধমান মরুভূমি স্থানীয় লোকজনের জীবনে জন্য বড় হুমকি সৃষ্টি করে। সি কুয়াং ইন স্মরণ করে বলেন, মরুকরণ প্রতিরোধ না করলে এই অঞ্চল ক্রমেই দরিদ্র হতে থাকবে। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি তাঁর জীবনে মরুকরণ প্রতিরোধের মিশন হাতে নেবেন—আর কিছু করবেন না।

 

পরে সি কুয়াং ইন স্থানীয় গ্রামের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি স্থানীয় লোকজন নিয়ে বৃক্ষরোপণের কাজ শুরু করেন। তিন বছরের কঠোর লড়াইয়ের পর সফলভাবে ১৪ হাজার মু বন চাষ করতে সক্ষম হন। হাই জি লিয়াং নামের গ্রামটিতে তাঁর তৈরি প্রথম মরূদ্যান দেখা যায়।

১৯৮৪ সালে সি কুয়াং ইন সিপিসি’র আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের প্রথম মরুকরণ প্রতিরোধের কৃষক কোম্পানি- সিন সিং বন ও পশু পালন খামার স্থাপন করেন। তিনি তিন হাজার মু মরুভূমি অঞ্চল ঠিকা নেন, বাসার ৮৪টি ছাগল বিক্রি করেন। তিনি স্থানীয় কৃষকদের নিয়ে প্রকৃতির প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করার মিশন শুরু করেন। প্রকৃতিও যেন তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। সে বছর আগের চেয়েও বৃষ্টি বেশি হয়, তাই তাঁদের চাষ করা গাছ সবগুলো বেঁচে যায়।

 

এই পরিবর্তন সি কুয়াং ইনকে উত্সাহ দেয়। ১৯৮৫ সালে তিনি আবারও প্রতিশ্রুতি দেন যে, আরো ৫০ হাজার মু মরুভূমি এলাকা পরিচালনার দায়িত্ব নেবেন। সীমাহীন মরুভূমি দেখে অনেকেই উদ্বিগ্ন হয়েছিল, তাঁর প্রতিশ্রুতি কি বাস্তবায়ন করা সম্ভব? অতীতে এখানে কি কখনও একটি গাছও ছিল? কিন্তু তিনি এখানে বৃক্ষরোপণের প্রতিশ্রুতি দেন, এ কাজ কীভাবে করা যায়। স্থানীয় কৃষকের মুখের সেই ‘পাগল’ ঘাসের বীজ নিয়ে মরুভূমিতে দিন কাটানো শুরু করেন।

মরুকরণ প্রতিরোধের বীর সি কুয়াং ইন_fororder_shi2

সি কুয়াং ইন যে মরুভূমির ঠিকা নিয়েছেন, তার মধ্যে ছয় হাজার মু’র ‘লাং ও শা’ সবচেয়ে কঠিন অবস্থায় রয়েছে। প্রতি বছর প্রচুর বাতাস হয়। ১৯৮৬ সালে সি কুয়াং ইন শতাধিক লোকজনকে নেতৃত্ব দিয়ে লাং ও সায় তিন চার মাস ধরে থেকেছেন। ক্ষুধা লাগলে কয়েকটি ভুট্টা দিয়ে তৈরি রুটি খান, তৃষ্ণা লাগলে বালিযুক্ত পানি পান করেন। ঘুম আসলে ঘাসের ঘরে শুয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন।

 

অভিজ্ঞতা ও সঠিক জ্ঞানের অভাবে শুরুর দুই বছর তারা অনেক কষ্ট করে যে গাছ চাষ করেছিলেন, তার মাত্র ৩০ শতাংশ রক্ষা করা যায়। তখন অনেকেই হতাশ হয়ে চলে যায়। সি কুয়াং ইন ভাবেন, এভাবে কাজ করলে হবে না। তিনি বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে কিছু শিখার চেষ্টা করেন। তারপর তৃতীয় বছর, সি কুয়াং ইন লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে আবারও লাং ও সায় গিয়ে লড়াই শুরু করেন। এবার তাঁরা বিশেষজ্ঞদের কথামতো বৈজ্ঞানিকভাবে গাছ ও ঘাস চাষ করেন। এবার তারা ইতিবাচক ফলাফল পান।

 

এখন এই জায়গায় মাও উ সু মরুভূমির সীমান্ত এলাকায় এক দৃঢ় প্রাকৃতিক সুরক্ষা ‘দেয়াল’ হয়েছে। ৩০ বছরে সি কুয়াং ইন ২.৫ লাখ মু মরুভূমিতে ৫.৩ কোটিরও বেশি গাছ লাগিয়েছেন। সার্বিকভাবে স্থানীয় মরুভূমির অবস্থা পরিবর্তন করে দিয়েছেন।

 

এখন বনের মাঝে হাঁটলে সবুজ দুনিয়া দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। এখন সবুজ প্রকৃতি পুনরুদ্ধার করা হল সি কুয়াং ইনের লক্ষ্য। তাঁর মরুকরণ প্রতিরোধ কোম্পানি বনজ অর্থনীতি গড়ে তুলছে। তিনি বলেন, বৃক্ষরোপণ ও শিশু লালন একই ব্যাপার, ভালোভাবে যত্ন নিলে সুন্দরভাবে বড় হয়ে ওঠে। তিনি তাঁর বৃক্ষরোপণের অভিজ্ঞতা নাতি সি চিয়ান ইয়াংকে শিখিয়ে দিয়েছেন। এখন ২৫ বছর বয়সী সি চিয়ান ইয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ে বনজ শিল্প নিয়ে লেখাপড়া করছে। ভবিষ্যতে তিনি বন বিজ্ঞানী হবেন; তৃতীয় প্রজন্মের বন রক্ষাকারীর দায়িত্ব নেবেন তিনি। তিনি বলেন, একজন তরুণ সিপিসি সদস্য হিসেবে, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে জ্ঞান অর্জন করেছি, তা বন রক্ষায় কাজে লাগাতে চাই। শুধু প্রাকৃতিক পরিবেশকে উন্নত করাই যথেষ্ট নয়, বরং বনজ অর্থনীতিও উন্নত করতে হবে।