গত এক শতাব্দীর চীনা উন্নয়ন বিশ্বের জন্য বড় চমক
2021-07-12 13:59:57

১৯৭৮ সালের পর গত ৩২ বছরে চীনের অর্থনীতি প্রতিবছর গড়ে ৯.৭৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বজায় রেখেছে। গত বছর কোভিড-১৯ মহামারী সত্ত্বেও বিশ্বের একমাত্র প্রধান অর্থনীতি হিসেবে চীন তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রেখে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।

 

এ সময়ে ‘পেই তৌ’ নেভিগেশন গ্লোবাল নেটওয়ার্কিং, ‘ছাং এ’ প্রকল্প, সি-৯১৯ সার্বিক পরীক্ষণ বিমান, ‘ফু সিং’ দ্রুত গতির ট্রেনসহ একের পর এক চীনা সাফল্য বিশ্বকে চমক দেয়।

 

উপকূলবর্তী, নদী বরাবর ও সীমান্ত অঞ্চল থেকে মূল-ভূভাগ পর্যন্ত, শেনজেনসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক বিশেষ অঞ্চল স্থাপন, পুতোং থেকে হাইনান অবাধ বাণিজ্য বন্দর স্থাপনসহ নানা যুগান্তকারী পদক্ষেপের মাধ্যমে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) জনগণকে সঙ্গে নিয়ে অবিচলভাবে তার সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ কাজ সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। উন্মুক্তকরণের মাধ্যমে সংস্কার, উন্নয়ন ও সৃজনশীলতা ত্বরান্বিত করছে।

 

একশ’ বছর ইতিহাসে খুবই অল্প সময়। কিন্তু চীন এ সময়ে সর্বনিম্ন থেকে পুনরুত্থানের পথে ফিরে এসেছে। দারিদ্র্য ও দুর্বলতা থেকে সমৃদ্ধির পথে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে।

 

নয়া চীন প্রতিষ্ঠার শুরুতে চীন বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র্য ও পশ্চাত্পদ দেশগুলোর অন্যতম ছিল। ১৯৫২ সালে মোট দেশজ উত্পাদন জিডিপি ছিল কেবল ৬৭৯ ইউয়ান। সত্তর বছরেরও বেশি সময়ের উন্নয়ন যাত্রার মাধ্যমে চীনের জিডিপি ২০২০ সালে একশ’ ট্রিলিয়ন ইউয়ান অতিক্রম করে বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছেছে।

 

চীনের অর্থনীতি একের পর এক মাইল ফলক ছুঁয়েছে। ১৯৭৮ সালে চীনের জিডিপি বিশ্বের দশম স্থানে ছিল। ২০০৮ সালে তা জার্মানিকে ছাড়িয়ে বিশ্বের তৃতীয় স্থান দখল করে। আর ২০১০ সালে সেই জিডিপি ১০ ট্রিলিয়ন ইউয়ানে দাঁড়ায়। তখন জাপানকে ছাড়িয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। বিশ্বে চীনের অর্থনৈতিক সমষ্টি সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের শুরুর দিকের ১.৮ শতাংশ থেকে বর্তমান ১৭ শতাংশেরও বেশিতে পৌঁছায়।

 

উন্নয়ন জনগণের জন্য, উন্নয়ন জনগণের ওপর নির্ভর করে এবং উন্নয়নের ফলাফল জনগণ ভোগ করে। একশ’ বছরের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে চীনা জনগণের খাওয়া-পরা সমস্যা সমাধান হয়েছে।  জীবনযাপন সাধারণভাবে সচ্ছল মানে পৌঁছেছে। সার্বিক সচ্ছল সমাজ গঠন হয়ে বর্তমানে চীন চরম দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হয়েছে।

 

মাথাপিছু জিডিপির অব্যাহত বৃদ্ধি থেকে বোঝা যায়, চীন কতটা এগিয়েছে। নয়া চীন প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে মাথাপিছু জিডিপি শুধু একশ’ ইউয়ানের চেয়ে একটু বেশি ছিল। ১৯৮৭ সালে হাজার ইউয়ান অতিক্রম করে। ২০০৩ সালে তা ১০ হাজার ইউয়ানের বেশি ছিল এবং ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো ১০ হাজার মার্কিন ডলার অতিক্রম করে।

 

চীনের অর্থনৈতিক বিস্ময়ের পিছনে অবিচল উন্নয়নকে সিপিসির দেশ পুনরুত্থানের প্রধান কাজ হিসেবে দেখা হয়। ১৯৭৮ সালে সিপিসি’র একাদশ কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে পার্টি ও দেশের প্রধান কাজ হিসেবে অর্থনৈতিক নির্মাণকে নির্ধারণ করা হয়। ‘একটি কেন্দ্রীয় কাজ, দুটি মৌলিক পয়েন্ট’ সিপিসি’র মৌলিক লক্ষ্যে পরিণত করা হয়। পরবর্তীতে সিপিসি তার ওপর অবিচল থাকে।

 

২০২০ সালে সর্বশেষ অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে: তৃতীয় শিল্পের বর্ধিত-মূল্য জিডিপিতে ৫৪.৫ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত হয়। শিল্প কাঠামোর রূপান্তর নতুন পর্যায়ে পৌঁছায়। উচ্চ প্রযুক্তিগত শিল্প বিনিয়োগ, সামাজিক ক্ষেত্রের বিনিয়োগ উভয়ে দুই অংকের প্রবৃদ্ধি বজায় ছিল। চাহিদা কাঠামোর সমন্বয় নতুন অগ্রগতি লাভ করে। উচ্চ প্রযুক্তিগত নির্মাণ শিল্প উত্পাদনের বৃদ্ধির গতি গোটা শিল্পের বৃদ্ধির চেয়ে অনেক বেশি ছিল।   ইন্টারনেটে বস্তুগত পণ্যের খুচরা-বিক্রয় মূল্য ১৪.৮ শতাংশ বেড়েছে। নতুন চালিকা শক্তির নেতৃত্বাধীন ভূমিকাও বেড়েছে।  

 

একশ’ বছর আগে শাংহাই থেকে নানচিংগামী ট্রেনের কমপক্ষে ১০ ঘন্টা লাগত। কিন্তু বর্তমানে তা শুধু এক ঘন্টা লাগে। ঘন্টায় ৩০ কিলোমিটার থেকে ৩৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত উন্নীত হয়েছে।

 

জাতীয় অর্থনীতিতে শিল্পের অবদান ১০ শতাংশেরও কম থেকে বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে সম্পূর্ণ শিল্প ব্যবস্থার অধিকারী হয়েছে চীন। শুধু কয়েক দশকে চীন কয়েক শ’ বছরের শিল্পায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে।

 

শূণ্য থেকে অবস্থা সম্পন্ন, দুর্বল থেকে শক্তিশালী দেশে পরিণত হয়েছে। ফলে চীনের শিল্প উত্পাদন মাত্রা একের পর এক বাধা অতিক্রম করেছে। ২০০৪ সালে চীনের শিল্প বর্ধিত মূল্য জার্মানিকে অতিক্রম করে বিশ্বের তৃতীয় হয়। ২০০৭ সালে জাপানকে অতিক্রম করে বিশ্বের দ্বিতীয় হয়। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করে বিশ্বের প্রথম হয়।

 

একের পর এক সফলতা থেকে দেখা যায়, চীনের শিল্প অর্থনীতি অভূতপূর্ব গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। শিল্পের বর্ধিত মূল্য ১৯৫২ সালের ১২ বিলিয়ন ইউয়ান থেকে ২০২০ সালের ৩১.৩ ট্রিলিয়ন ইউয়ান পর্যন্ত হাজার গুণ বেড়েছে এবং গত  ১১ বছর ধরে বিশ্বের বৃহত্তম নির্মাণ শিল্প দেশের মর্যাদা ধরে রেখেছে চীন।

 

১৯৫৬ সালে ৫০ টনের সিঙ্গাপুর রবার বণিক জাহাজের মাধ্যমে শাংহাই বন্দরে পাঠানো হতো। এটা ছিল চীনের আমদানি শিল্প উপাদান। সে সময় চীন শুধু খাদ্য ও কয়লাসহ বিভিন্ন প্রাথমিক পণ্য রপ্তানি করার মাধ্যমে রবারসহ বিভিন্ন জরুরী সরঞ্জাম বিনিময় করতে পারত।

 

বর্তমানে শাংহাই ইয়াং শান গভীর বন্দরে বার্ষিক মাল বহন ও খালাসের পরিমাণ দুই কোটিরও বেশি। গাড়ি, মোবাইল-ফোন, পোশাক ও খেলনাসহ বিভিন্ন পণ্য এখান থেকে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়।

 

১৯৭৮ সালে সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ থেকে ২০০১ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগ দেওয়া পর্যন্ত চীন তার উন্মুক্তকরণের দরজা আরো বড় করে, বাণিজ্যিক অংশীদার আরো বাড়ায়, এবং বাণিজ্যিক মাত্রা ও পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি করে।

 

জাতিসংঘের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের এক প্রবন্ধে বলা হয়: গত ২৫ বছরে চীন বিশ্ব বাণিজ্যে এক শতাংশেরও কম ‘প্রান্তিক মানুষ’ থেকে ‘বাণিজ্যিক দানবে’ উন্নত হয়েছে।

 

দেশি-বিদেশি বিপদ ও জটিল পরিস্থিতি এবং কোভিড-১৯ মহামারীর ঝুঁকি সত্ত্বেও ২০২০ সালে চীনের বৈদেশিক বাণিজ্য বিশ্ব ইতিহাসে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে এবং বিশ্বের একমাত্র পণ্য ও বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী প্রধান অর্থনৈতিক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। একই বছর চীনের বাণিজ্য পরিমাণ বিশ্বের প্রায় ১৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

 

সার্বিক সচ্ছল সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চীনের অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং সার্বিক রাষ্ট্রীয় শক্তি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। চীনা জাতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিশ্বকে নেতৃত্বদানে প্রস্তুত হচ্ছে।

 

(প্রেমা/এনাম)