ব্যাংকের কর্মকর্তা থেকে ডেলিভারি বয়: ইয়াও জি কাংয়ের গল্প
2021-07-12 17:42:46

সম্প্রতি চীনের সোশ্যাল মিডিয়ায় একজন পুরুষ সুপরিচিত হয়েছেন, তাঁর গল্প শুনে অনেকে মুগ্ধ হয়েছেন। তাঁর নাম ইয়াও জি কাং। এখন তার বয়স ৫১ বছর। যুবকালে তিনি চিয়াংসু প্রদেশের ছাংচৌ শহরে একটি সরকারি ব্যাংকের শাখা অফিসের পরিচালক ছিলেন। তবে এখন তিনি প্রতিদিন মোটর সাইকেল চালিয়ে পণ্য ডেলিভারির কাজ করেন। আজকের আসরে আমরা জনাব ইয়াও’র গল্প ও তার জীবনে পরিবর্তনের গল্প বলব।

ব্যাংকের কর্মকর্তা থেকে ডেলিভারি বয়: ইয়াও জি কাংয়ের গল্প_fororder_kd1

গত বছরের অক্টোবর মাসে ইয়াও জি কাং এ খাতের অন্যান্য যুবক-যুবতীর মতো পণ্য ডেলিভারির কাজ শুরু করেন। প্রতিদিন মোটর সাইকেল চালিয়ে, অনলাইন প্ল্যাটফর্মের অর্ডার মোতাবেক, শহরবাসীদের মধ্যে মূলত খাবার সরবরাহ করেন তিনি। ডেলিভারিম্যানের কাজ সম্পর্কে তিনি বলেন, এ কাজ ইন্টারেস্টিং। দ্রুত খাবার গ্রাহকদের কাছে পাঠাতে হয়। কাজটা করতে ভালো লাগে। গ্রাহকরা খাবার পেয়ে সন্তুষ্ট হন।

আসলে ৪ বছর আগে ইয়াও চিয়াংসু প্রদেশের ছাংচৌ শহরের একটি ব্যাংকের শাখা অফিসের পরিচালক ছিলেন। সেই সময় তিনি প্রতিদিন অফিসে সুন্দর ও পরিস্কার সুট পরে টাকা, বীমা ও তহিবলের সাথে জড়িত কাজ করতেন। কেন হঠাত্ ডেলিভারিম্যানের কাজ করতে শুরু করলেন?

এ সম্পর্কে ইয়াও বলেন, ‘আমার জন্মস্থানে অনেকের সাথে পরিচয় আছে। তবে আমার বর্তমানের চাকরি ও অবস্থা সম্পর্কে তারা কিছু জানে না। ব্যাংকের পরিচালক আর ডেলিভারিম্যানের মধ্যে অনেক ব্যবধান রয়েছে, তা আমি নিজেই জানি। তবে, আমার পিতামাতাকে বিষয়টা জানাইনি। আসলে, এ কাজ করার জন্যই আমি একটি অপরিচিত শহরে চলে এসেছি।’

কথা বলার সময় ইয়াও’র মুখে হাঁসি দেখা দেয়। তবে, ডেলিভারিম্যানের কাজ যতটা মনে হয় ততটা সহজ নয়। কারণ, ছাংশা শহরে বাণিজ্যিক এলাকা বেশি। সেখানে অনেক ভবন নির্মিত হয়েছে এবং ভৌগোলিক অবস্থানও জটিল। তাই অপরিচিত লোকদের জন্য নির্দিষ্ট রেস্তোরাঁ থেকে খাবার নেওয়া কঠিন ব্যাপার।

ব্যাংকের কর্মকর্তা থেকে ডেলিভারি বয়: ইয়াও জি কাংয়ের গল্প_fororder_kd3

ইয়াও জি কাং তরুণ বয়স থেকেই দৌঁড়াদৌড়ি করে অভ্যস্ত। প্রতিদিন ঘুম থেকে জেগে তিনি ১০ কিলোমিটার হাঁটেন। হাঁটার সময় তিনি ছোট রাস্তা ও অলিগলিগুলোর অবস্থান মনে রাখার চেষ্টা করেন। দোকান ও রেস্তোরাঁর বিস্তারিত অবস্থান, কতো তলায় থাকে এবং কোন লিফ্ট তাড়াতাড়ি ওঠা-নামা করে—এসব তথ্য তিনি সংগ্রহ করেন এবং বিস্তারিত রোডম্যাপ তৈরি করেন। ম্যাপ দেখে তিনি সহজে এক জায়গা থাকে অন্য জায়গায় যেতে পারেন।

ডেলিভারিকাজের সময় কোনো ধরনের খাবার বহন করা  সবচেয়ে কঠিন? উত্তরে ইয়াও বলেন, জন্মদিনের কেক। কেক নরম হয়। একটু অসাবধান হলেই তা নষ্ট হবার ভয়। তাই খুব সাবধানে তা বহন করতে হয়।

জনাব ইয়াও’র সহকর্মী তেং মিন জি ইয়াও’র চরিত্র পর্যবেক্ষণ করে বলেন, তিনি অনেক পরিশ্রমী এবং সাহসী। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পছন্দ করেন। তার চরিত্রও খুব ভালো।

যুবকালে তিনি ফায়ারম্যান হিসেবে কাজ করেছেন। সতর্কতামূলক অ্যালার্ম শুনে তাত্ক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে যেতে হতো; যত দ্রুত সম্ভব আগুন নেভাতে হতো। ডেলিভারিকাজের সাথে তার অনেক মিল রয়েছে। কারণ, খাবারের প্যাকেট নিয়ে তা যত দ্রুত সম্ভব গ্রাহকের হাতে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে তার দায়িত্ব।

চীনের অনলাইন ব্যবসা দ্রুত উন্নত হচ্ছে। এর সাথে সাথে প্রতিবছরের নির্দিষ্ট কয়েক দিনে অনলাইন শপিং উত্সবের কারণে একদিনে বহু ডেলিভারি প্যাকেজ হ্যান্ডেল করতে হয়। সে সময়টা ডেলিভারিম্যানের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ইয়াও অধ্যবসায়ী। কোনো কাজ তিনি শুরু করলে দীর্ঘকাল ধরে সেটি করতে পারেন। যেমন, তিনি কয়েক দশক ধরে নিয়মিত দৌঁড়াচ্ছেন। এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এই ৫১ বছর বয়সেও তাকে যুবকের মতো লাগে।

ব্যাংকের কর্মকর্তা থেকে ডেলিভারি বয়: ইয়াও জি কাংয়ের গল্প_fororder_kd2

কেন ডেলিভারিম্যানের কাজ করতে শুরু করেন তিনি? উত্তরে তিনি নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। ২০১৬ সালে যুবকালে সেনাবাহিনীর একজন সাবেক সহকর্মীর সঙ্গে ইয়াওর দেখা হয়। তিনি তাঁকে কানসু প্রদেশে গিয়ে ব্যবসা করার আমন্ত্রণ জানান। তখন তিনি ব্যাংকের কাজ আর করতে চাইছিলেন না। প্রতিদিন তিনি একই কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তাই চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ব্যাংকের কাজ দেখতে সুন্দর, কিন্তু বাস্তবে অনেক কঠিন ও বিরক্তিকর। তাই চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর তিনি কানসু প্রদেশে এসে কারখানা চালু করেন। তবে স্থানীয় সরকারের নীতিমালা ও বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে ভুল ধারণা থাকায় তাঁর ব্যবসায় লস হয়। ২০১৯ সালে তাঁর সকল সঞ্চয়—প্রায় ২০ লাখ ইউয়ান—লস হয়। তিনি কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন এবং ছাংশায় চলে আসেন।

ছাংশায় আসার পর তিনি শুরুতে কাজিনের সাথে থাকতেন। প্রতিদিন দৌঁড়াদৌড়ি করে মনের দুঃখ কমাতে চেষ্টা করতেন। তবে, এভাবে তো আর জীবন চলে না! তিনি একসময় ডেলিভারিম্যান হিসেবে কাজ শুরু করেন। শুরুতে তিনি মনে করেছিলেন, ডেলিভারিম্যানের কাজ জটিল নয় এবং প্রতিদিন বিভিন্ন স্থানে খাবার পৌঁছে দেওয়ার ফলে শরীরচর্চাও হবে।

নববর্ষের রাতে ইয়াও’র হাতে মোট ৮টি ওর্ডার ছিল। তিনি দৌঁড়াদৌড়ি করে খাবার নির্দিষ্ট গ্রাহকের হাতে পৌঁছে দেন। রাত ১১টায় তিন কাপ দুধ চা নিয়ে গ্রাহকের কাছে পৌঁছান। তখন গ্রহাক ইয়াওকে এক কাপ দুধ চা অফার করে এবং তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। ব্যাপারটা ইয়াওকে মুগ্ধ করে। আসলে, ইয়াও’র পরিবার তাঁর ব্যবসায় ব্যর্থতার খবর অনেক আগে থেকেই জানতে পারে। তবে তাঁরা ইয়াওয়ের সমালোচনা করেনি বা অভিযোগ করেনি। বরং তার নতুন জীবনকে সমর্থন দেয়। এ সম্পর্কে ইয়াও বলেন, ‘গত বছরের ডিসেম্বর মাসে আমার ছেলের জন্মদিনে আমি তাকে একটি লাল খাম দেই, কিন্তু সে সেটা গ্রহণ করেনি।’

ডেলিভারিম্যান হিসেবেও তিনি দ্রুত উন্নতি করছেন। দ্বিতীয় মাসে ইয়াও দলের প্রধান নির্বাচিত হন এবং ৪ মাস পর ডেলিভারিস্টেশনের প্রধান নির্বাচিত হন। আরো কয়েক মাসের মধ্যে তিনি এদতদঞ্চলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান।

এ সম্পর্কে ইয়াও বলেন, মানুষের জীবনে ব্যর্থতা কোনো ভয়ের ব্যাপার নয়, পড়ে গেলে আবার দাঁড়াতে হয়। সহনশীল চরিত্র ও অব্যাহত পরিশ্রমে তিনি পুনরায় একটি নতুন জীবন শুরু করেছেন। যদিও শূন্য থেকে নতুন কাজ শুরু করা খুবই কঠিন ব্যাপার, তবে সঠিকভাবে পরিশ্রম করলে সাফল্য আসতে বাধ্য।

আসলে মধ্যবয়সে অনেকের জন্যই নতুন করে কিছু শুরু করা কঠিন। কিন্তু অলসতা আরও বেশি বিপজ্জনক। নিজের ব্যর্থতাকে মেনে নিয়ে নতুন করে নতুন করে কিছু শুরু করা গুরুত্বপূর্ণ।

অনেকে সমস্যা বা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলে আপোস করেন। ইয়াও সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে আপোস করেননি, বরং নতুন করে লড়াই শুরু করেছেন। ডেলিভারিম্যানের কাজ দেখতে সহজ, তবে এ কাজেও বুদ্ধিমান ও মেধাবী মানুষ প্রয়োজন। এ কাজ করার প্রথম মাসে তিনি ১৫৮০টি অর্ডার ডেলিভারি দেন  এবং তার আশেপাশের ডেলিভারিম্যানদের মধ্যে সেরা হন। বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ ও খাবার পৌঁছানের রোডম্যাপ এঁকে তিনি অন্যদের তুলনায় দ্রুততর গতিতে খাবার পৌঁছে দিতে পারেন। তা ছাড়া, তার অতীত কাজের অভিজ্ঞতা তাকে যে কোনো কাজ সুন্দর করে আঞ্জাম দেওয়ার সামর্থ্য এনে দিয়েছে।

জনাব ইয়াও’র চেহারায় কোনো হতাশা ছাপ নেই। তিনি জীবনে যে কাজই করেন, নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুসারেই করেন। ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে তার কাজের অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে তাকে বর্তমান কাজেও সাহায্য করেছে। তাই তিনি নতুন কাজেও সাফল্য অর্জন করেছেন।

তবে অন্য দিক থেকে বিবেচনা করে আমরাও কিছু শিক্ষা নিতে পারি। যেমন, মধ্যবয়সেও নতুন কিছু করা সম্ভব। শুধু সঠিক কাজটি খুঁজে বের করতে হবে। অনেক পদে শুরুতে শুধু যুবক-যুবতীদেরকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়। মধ্যবয়সীরা সেসব কাজ নতুন করে শুরু করার সুযোগ পান না। অনেকেই এটাকে বৈষম্য হিসেবে দেখে থাকেন। তারা মনে করেন, যে-কোনো কাজে মধ্যবয়সীদেরকেও সমান সুযোগ দেওয়া উচিত। যুবক-যুবতীদের সঙ্গে ন্যায্য প্রতিযোগিতায় নামার অধিকার যে-কোনো বয়সের মানুষের থাকা উচিত।

সুপ্রিয় বন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা এখানে শেষ হয়ে এলো। আমাদের অনুষ্ঠান যারা মিস করেছেন, তারা আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন। ওয়েবসাইট ঠিকানা www.bengali.cri.cn,ফেসবুকে CRIbangla মাধ্যমে চীন ও বিশ্ব সম্পর্কে আরও অনেককিছু জানতে পারেন। তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন, আগামী সপ্তাহে আবার কথা হবে,যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)