চীনের পেইতৌ নেভিগেশন ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা
2021-07-05 17:03:33

গত বছরের ৩১ জুলাই চীনের নেভিগেশন উপগ্রহব্যবস্থা পেইতৌর পূর্ণাঙ্গ আনুষ্ঠানিক ব্যবহার শুরু হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ব্যবস্থা গোটা মানবজাতির জন্য কল্যাণকর প্রমাণিত হবে। আজকের ‘বিদ্যাবার্তা’য় আমরা পেইতৌর নির্মাণকাজ নিয়ে কিছু তথ্য শেয়ার করবো।

২০২০ সালের ২৩ জুন সকালে চীনের সিছুয়ান প্রদেশের তালিয়াংশান পাহাড়ের কোলে অবস্থিত উত্ক্ষেপণকেন্দ্র থেকে চীনের লংমার্চ রকেট ৫৫তম পেইতৌ উপগ্রহ নিয়ে মহাশূন্যে যাত্রা করে। পরে ‘চিশিং’ নামের ৫৫তম পেইতৌ উপগ্রহটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে প্রবেশ করে। আর এর মাধ্যমে মহাকাশে পেইতৌ-৩ উপগ্রহ-নেটওয়ার্কের ৩০টি উপগ্রহের মোতায়েনকাজ সম্পন্ন হয়। এটি ছিল চীন তথা বিশ্বের উপগ্রহ নেভিগেশন ক্ষেত্রে একটি বড় অগ্রগতি।

আসলে চীনে উপগ্রহ গবেষণাকাজ বহু বছর আগে শুরু হয়। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে ‘তুংফাংহুং ১’ উপগ্রহ সাফল্যের সঙ্গে উত্ক্ষেপণ করার ৬ মাস পর চীনের প্রথম নেভিগেশন উপগ্রহসংশ্লিষ্ট রিপোর্ট তৈরির কাজ শেষ হয়। এই রিপোর্টে নেভিগেশন উপগ্রহ তৈরির প্রস্তাব রাখা হয়। কিন্তু প্রযুক্তি ও অর্থের অভাবের কারণে এ প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১০ বছরেরও বেশি সময়ের গবেষণায় পেইতৌ উপগ্রহব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয় চীন।

চীনের পেইতৌ নেভিগেশন ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা_fororder_bd1

১৯৮৩ সালে ডক্টর ছেন ফাং ইয়ুনসহ কয়েক জন বিশেষজ্ঞের পরামর্শে ‘ডাবল স্টার পজিশনিং’ ব্যবস্থাপনার ধারণা পেশ করা হয়। ডক্টর ছেন গবেষকদল নিয়ে চীনের সিনচিয়াং, কুয়াংসি ও বেইজিংয়ের উপগ্রহ মনিটরিং স্টেশনে রাতের সময় দুটি টেলিযোগাযোগ উপগ্রহের মাধ্যমে পরীক্ষাকাজ চালু করেন। ১৯৮৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর চীনের গবেষকরা সাফল্যের সঙ্গে দুটি উপগ্রহের মাধ্যমে পজিশনিং চাহিদা মেটাতে সক্ষম হন। আসলে, উপগ্রহ নেভিগেশন প্রকল্প চালু করার জন্য ব্যাপক অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন। তাই এ প্রকল্পের গবেষণায় ভিন্ন ধরনের মতামত দেখা যায়। এরই মধ্যে ১৯৯০ সালে বিশ্বে উপসাগরীয় যুদ্ধ ঘটে। মার্কিন গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম তথা জিপিএসের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে জয়লাভ করে।

তারপর ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ডাবল স্টার পজিশনিং’ ব্যবস্থাপনা গবেষণার কাজ তথা ‘পেইতৌ ১’ প্রকল্পের গবেষণাকাজ শুরু হয়। ৬৫ বছর বয়সী প্রকৌশলী সুন চিয়া তুং প্রধান ডিজাইনার হিসেবে মনোনয়ন পান।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া সরাসরি নিজেদের জিপিএস ব্যবস্থা চালু করে। ওদিকে, পেইতৌ প্রকল্পে বরাদ্দ, প্রযুক্তি ও সেরা ব্যক্তির ব্যাপক অভাব ছিল। তাই চীনের অবস্থা বিবেচনা করে, তিন ধাপে নিজস্ব নেভিগেশন ব্যবস্থা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় চীনের সরকার।

১৯৯৪ সাল থেকে ‘পেইতৌ-১’ উপগ্রহের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০০০ সালের অক্টোবর ও ডিসেম্বর মাসে দুটি পেইতৌ-১ উপগ্রহ পর্যায়ক্রমে মহাশূন্যের নির্দিষ্ট কক্ষপথে পাঠানো হয়। এর মাধ্যমে চীন বিশ্বের তৃতীয় দেশ হিসেবে নিজস্ব নেভিগেশন উপগ্রহ আবিষ্কারের কৃতিত্ব অর্জন করে। ২০০৮ সালের ১২ মে চীনের সিছুয়ান প্রদেশের ওয়েনছুয়ান জেলায় ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। তখন স্থানীয় ওয়েনছুয়ান আর ইংসিউ জেলায় টেলিযোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক ঘন্টা পর পেইতৌ উপগ্রহের সাহায্যে সেখানকার উদ্ধারকাজে গতি আসে।

যখন পেইতৌ-১ সিরিজের উপগ্রহ নিক্ষেপ করা হয়, তখন পৃথিবীর উপরে ৮০ শতাংশেরও বেশি শ্রেষ্ঠ কক্ষপথ যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার উপগ্রহগুলো ব্যবহার করছিল। ২০০০ সালের ১৭ এপ্রিল আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের কাছে ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ড ব্যবহারের আবেদন করে চীন। সংশ্লিষ্ট নিয়ম অনুসারে, আবেদনের তারিখ থেকে ৭ বছরের মধ্যে উপগ্রহ নিক্ষেপ ও তা থেকে সংকেত সংগ্রহের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। তা না-হলে ব্যান্ড ব্যবহারের যোগ্যতা হারাতে হবে। এর মানে, পেইতৌ-২ সিরিজের উপগ্রহের গবেষণা-কাজ ৭ বছরের মধ্যে শেষ করতে হবে। ২০০৫ সালে উপগ্রহের গবেষণাকাজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়পর্বে প্রবেশ করে। তখন চীনের রাষ্ট্রীয়ভাবে উত্পাদিত ঘড়ির মানের সঙ্গে বাস্তব চাহিদার ব্যবধান ছিল। অথচ উপগ্রহ-ঘড়ি নেভিগেশন উপগ্রহের জন্য অনেকটা হৃদয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছ থেকে এ ঘড়ি আমদানি করতে চেয়েছিল চীন। কিন্তু সফল হয়নি। ফলে চীনের তিনটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে অবশেষে এ প্রযুক্তিগত বাধা অতিক্রম করা সম্ভব হয়।

২০০৭ সালের ১৪ এপ্রিল ‘চীনে তৈরি ঘড়ি’ নিয়ে পেইতৌ-২ সিরিজের উপগ্রহ মহাকাশে যাত্রা করে। উপগ্রহটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে ৭ দিন সমন্বয়ী কাজ করে। ১৭ এপ্রিল রাত ৮টায় কম্পিউটার থেকে পাওয়া যায় উপগ্রহের পাঠানো স্পষ্ট সংকেত। তখন আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের দেওয়া ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহারের মেয়াদ শেষের মাত্র ৪ ঘন্টা বাকি ছিল। তাই বলা যায়, একেবারে শেষ মুহূর্তে পেইতৌ নেভিগেশন ব্যবস্থা বিশ্বের জিপিএস ক্লাবে যোগ দিতে সক্ষম হয়।

২০১৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে পরের ৩২ মাসের মধ্যে পেইতৌ-৩ সিরিজের ৩০টি উপগ্রহ এবং পেইতৌ-২ ব্যবস্থার ব্যাপআপ উপগ্রহ নিক্ষেপ করা হয়, যা বিশ্বে নতুন রেকর্ডও সৃষ্টি করে। পেইতৌ-৩ সিরিজের উপগ্রহগুলো বিশ্বমানের। চীনের তৈরি উচ্চমানের ঘড়ি ও উপগ্রহ অতি চমত্কার, যা নেভিগেশন, সময় পরিমাপ, সংক্ষিপ্ত বার্তা পাঠানো এবং আন্তর্জাতিক উদ্ধার কাজসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে সেবা দিতে সক্ষম।

এখন পেইতৌ নেভিগেশন ব্যবস্থার বিভিন্ন উপগ্রহ নিজ নিজ কক্ষপথে ভুমিকা পালন করছে। তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের পরিবহন অতি বিপজ্জনক কাজ। প্রতিবছর প্রচুর তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সড়কপথে পরিবহন করা হয়। পেইতৌ নেভিগেশন প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্পূর্ণ কাজ মনিটর করা যায়। যদি গাড়ি পরিকল্পিত পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তবে পেইতৌ ব্যবস্থা তা দ্রুত পর্যবেক্ষণকেন্দ্রকে জানিয়ে দেয়।

পেইতৌ উপগ্রহ ব্যবস্থাপনার সময় পরিমাপের সঠিকতা অতি গুরুত্বপূর্ণ। চীনারা এ প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেক সমীক্ষা ও ম্যাপিং কাজ করতে সক্ষম। যেমন, প্রতিদিন সকাল ৬টা ১০ মিনিটে বেইজিং থেকে চাংচিয়াখৌগামী দ্রুতগতির ট্রেনের সময়মতো যাত্রা শুরু হয়। এটা চীনের বুদ্ধিমান দ্রুতগতির ট্রেনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যাত্রা ও পৌঁছানোর সময় নির্দিষ্টভাবে সময়সূচির সাথে মিলতে হবে। পেইতৌ ব্যবস্থা ব্যবহারের মাধ্যমে ট্রেনগুলো সঠিক সময়ে স্টেশনে পৌঁছাতে পারে এবং বিভিন্ন ট্রেনের অবস্থানও সার্বক্ষণিকভাবে মনিটর করা যায়।

বর্তমানে পেইতৌ ব্যবস্থা পরিবহন, জনসাধারণের নিরাপত্তা, দুর্যোগ এড়ানো, শহর প্রশাসনসহ বিভিন্ন খাতে সেবা দিচ্ছে। চীনের বিদ্যুতশক্তি, টেলিযোগাযোগসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণকাজেও অংশ নিচ্ছে পেইতৌ। নতুন প্রজন্মের টেলিযোগাযোগ, ইন্টারনেট ও এআই প্রযুক্তির সংমিশ্রণে পেইতৌ আরও বেশি কার্যকর হবে, এ কথা বলাই বাহুল্য।

চীনের বিভিন্ন খাতে সেবা দেওয়ার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপীও সেবা দিচ্ছে পেইতৌ ব্যবস্থা। যেমন, আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল সংস্থা পেইতৌ-কে বিশ্বের চতুর্থ নেভিগেশন ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সংস্থাও পেইতৌ’র রেডিও নেভিগেশন ব্যবস্থা ব্যবহার করে থাকে।

২০১৩ সালে মিয়ানমার ৫০০টিরও বেশি উচ্চ সঠিকতার পেইতৌ-সেবাসংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে কৃষিতথ্য সংগ্রহ আর কৃষিক্ষেত্রের কার্যকর ব্যবহারে পেইতৌর সেবা কাজে লাগছে। ২০১৫ সালে পেইতৌ ব্যবস্থার সহায়তায় কুয়েতের জাতীয় ব্যাংকের সদরদপ্তরের ৩০০ মিটার উঁচু ভবনের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয় এবং নির্মাণকাজে মাপের কোনো ভুল ছিল না। ২০১৮ সালে মালদ্বীপের আরাহ দ্বীপের সমুদ্রে পাইলিং কাজে পরিমাপের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে পেইতৌ। এর মাধ্যমে সমুদ্রে পাইলিং কাজের মনিটরকাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তা ছাড়া, ইউরোপের মালবাহী ট্রেনের কন্টেইনারে পেইতৌসংশ্লিষ্ট পরিমাপযন্ত্র দেখা যায়। এসব যন্ত্র ট্রেন ও মালামালের চলাচল ট্র্যাক করতে সক্ষম, যার সঠিকতা উচ্চমানের।

চীনের পেইতৌ নেভিগেশন ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা_fororder_sjd

পেইতৌ ব্যবস্থার প্রধান ডিজাইনার সুন চিয়া তুং চীনের সিনিয়র প্রকৌশলী। ১৯৬৭ সালে তিনি চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি গবেষণাগারে ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে গবেষণাকাজ করছিলেন। তখন চীনা সেনাপতি নিয়ে রুং চেনের নির্দেশনায় তিনি চীনের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহের ডিজাইন করেন। চীনের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ছিয়ান স্যুয়ে সেন আর সেনাপতি নিয়ে রুং চেনের সুপারিশে প্রকৌশলী সুন তাঁর গবেষণাকাজ শুরু করেন। ১৯৭০ সালের এপ্রিল মাসে ‘তুংফাংহুং ১’ উপগ্রহ সাফল্যের সঙ্গে নিক্ষেপ করা হয়। তখন জনাব সুন উদ্বেগ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন উপগ্রহের সফল উত্ক্ষেপণের জন্য, অনেকটা প্রথম বাচ্চা প্রসবের সময় পিতা যেমন উদ্বিগ্ন থাকেন।

তারপর তিনি অনেক কৃত্রিম উপগ্রহ, টেলিযোগাযোগ উপগ্রহ তৈরি করেছেন। জনাব সুন নিজের গবেষণাকাজ সম্পর্কে বলেন,  ‘জীবনের ৭ বছর বিমানের ডিজাইন শিখেছে, ৯ বছর ধরে ক্ষেপণাস্ত্রের ডিজাইন করেছি, এবং বাকি ৫০ বছর উপগ্রহের ডিজাইন করেছি।’ তার বয়স হয়েছে, তবে গবেষণার কাজ ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘মহাকাশের কাজে আমার আগ্রহ তীব্র। সারা জীবনেও আমি ক্লান্তি অনুভব করব না।’

সুপ্রিয় বন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা এখানে শেষ হয়ে এলো। আমাদের অনুষ্ঠান যারা মিস করেছেন, তারা আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন। ওয়েবসাইট ঠিকানা www.bengali.cri.cn,ফেসবুকে CRIbangla মাধ্যমে চীন ও বিশ্ব সম্পর্কে আরও অনেককিছু জানতে পারেন। তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন, আগামী সপ্তাহে আবার কথা হবে,যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)