সাজিদ রাজু, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ: নির্ধারিত সময়ের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে আছে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্মাণ করা কর্ণফূলী টানেলের কাজ। বাস্তবায়নকারী সংস্থা চীনা কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন গ্রুপ বলছে, এরই মধ্যে টানেলের কাজ শেষ হয়েছে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত। প্রকল্পে কর্তৃব্যরত চীনা প্রকৌশলী বলছেন, নির্মাণ কাজ শেষ হলে ১শ’ বছর যোগাযোগের সুবিধা দেবে এ টানেল।
চট্টগ্রামের অর্থনীতির অন্যতম অনুসঙ্গ কর্ণফূলী নদীর তীর ঘেঁষে এমন প্রশস্ত রাস্তা ধরে এগোনো যায় বহুদূর। মাঝ নদীতে চোখে পড়বে সারি সারি মালবোঝাই জাহাজ, অপেক্ষায় আছে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙরের জন্য।
নদীর দুই পাড়ে যোগাযোগের জন্য আছে ২টি সেতু। তবে যানবাহনের সংখ্যার তুলনায় যথেষ্ট নয়। আবার পলি জমা ও নদীর তলদেশের ভৌগলিক বিরূপ বৈশিষ্ট্যের কারণে আরো সেতু নির্মাণও যুক্তিসঙ্গত হবে না। তাই যানবাহন চলাচলের চাপ সামাল দিতে হাতে নেয়া হয় এ নদীর তলদেশ দিয়ে ৩ হাজার ৪০০ মিটার দৈর্ঘের টানেল নির্মাণের পরিকল্পনা। এ সড়ক ধরে এগোলেই এক প্রান্তে চোখে পড়বে বিশাল এলাকা জুড়ে চলছে টানেল নির্মানের কর্মযজ্ঞ।
নির্মাণ এলাকার ভেতরে দেখা মিলবে, বিশেষভাবে তৈরি টানেলের সেগমেন্ট। স্তুপ করে রাখা হয়েছে সপরিসর এলাকা জুড়ে।
প্রকল্প এলাকায় কথা হয়, এ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চীনা কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন গ্রুপের প্রকৌশল বিভাগের উপ ব্যবস্থাপক হুয়াং ইউয়ে ছুয়ান এর সঙ্গে।
হুয়াং ইউয়ে ছুয়ান
তিনি জানান, এরই মধ্যে টানেল নির্মাণের প্রায় সব সেগমেন্ট প্রস্তুত। দুই প্রান্তে ভায়াডাক্ট নির্মাণ, বোরড পাইল, কংক্রিট পিয়ার কলার বিমসহ বেশিরভাগ কাজ প্রায় শেষ। চলছে পিয়ার ক্যাপ, প্রি-ফেব্রিকেটেড বক্স গার্ডার নির্মাণসহ অন্যান্য কাজ। তার কাছে প্রশ্ন ছিলো সব মিলে কতোটুকু এগিয়েছে প্রকল্পের কাজ? উত্তরে তিনি জানান, ৭০ শতাংশ কাজ শেষ।
“প্রকল্পের প্রায় ৭০ শতাংশ কাজ শেষ। ৬০ মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও সে তুলনায় আমরা এগিয়ে আছি। টানেল খনন করতে আমরা শিল্ড মেশিন ব্যবহার করছি। এ প্রকল্পের প্রধান সরঞ্জামই এই শিল্ড মেশিন। এ যন্ত্র সম্পূর্ণ চীনা প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম দিয়ে কেবল কর্ণফুলী টানেলের জন্যই বিশেষভাবে নির্মাণ করা হয়েছে।“
এই চীনা প্রকৌশলী বলছেন, করোনার কারণে কর্মীর সংখ্যা কমলেও এখন বেশিরভাগ বাংলাদেশী ও ৩শ’ চীনা কর্মী মিলে হাজার খানেক কর্মী কাজ করেন এখানে। কিন্তু টানেল নির্মাণ শেষ হলেও এর নিরাপত্তা কিংবা ব্যবস্থাপনা হবে কিভাবে? উত্তরে তার পরিস্কার জবাব, বিশেষায়িত যন্ত্রপাতি দিয়েই নির্মাণ করা হচ্ছে টানেল। নদীর পানি বা যে কোন তরল পদার্থ যেন টানেলের ভেতরে ঢুকতে না পারে সেজন্য প্রতিটি সেগমেন্ট নির্মাণ করা হয়েছে এন্টি-সিপেজ ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে। আর ভেতরে বাতাস চলাচলের জন্য কাজ করবে ২০টিরও বেশি উচ্চ-ক্ষমতার পাখা। থাকবে পর্যাপ্ত আলো সরবরাহের ব্যবস্থা। নিরাপত্তায় নেয়া হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির মিশেলে বিশেষ ব্যবস্থা।
“টানেল নকশার সময়, আমরা উচ্চমানের অ্যান্টি-সিপেজ ডিজাইন করেছি। প্রথমে, টানেলের টিউবগুলো উচ্চ মানের অ্যান্টি-সিপেজ উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। দ্বিতীয়, টিউবের বাইরে আমরা গ্রাউন্টিং ব্যবস্থা করেছি, যাতে বাইরে থেকে পানি আসবে না। তৃতীয়, টানেলের নিচে পাম্প ঘর রেখেছি। প্রয়োজন হলে পাম্পের মাধ্যমে পানি ফেলে দেয়া যাবে।“
নির্মাণ পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণে এক হ্যান্ডবুক প্রস্তুত করা হয়েছে এবং দেশীয় কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি। এর ফরে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শুরু করতে পারবেন তারা।
এ টানেল দিয়ে মোটর গাড়ি, পাবলিক বাস, ট্রাকসহ প্রায় সব ধরণের যানবাহন চলাচল করতে পারবে। বিশেষ করে নদীর পূর্ব তীরের শিল্পাঞ্চল ও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের টার্মিনাল চালু হলে এখানকার মালামাল পরিবহনের লরিসহ ভারী যানবাহন চলাচল করবে টানেল দিয়েই। ফলে শহরের যানজট এড়িয়ে যোগাযোগ সহজ করবে টানেলটি।
“ চট্টগ্রাম হলো বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক ও প্রধান বন্দর নগরী। কর্ণফুলী নদী চট্টগ্রাম শহরকে দুইভাগে বিভক্ত করেছে। এক ভাগে রয়েছে নগর ও বন্দর এবং অপর ভাগে ভারী শিল্প এলাকা। প্রস্তাবিত টানেল চট্টগ্রাম বন্দর নগরকে কর্ণফুলী নদীর অপর অংশের সাথে সরাসরি সংযুক্ত করবে এবং পরোক্ষভাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মাধ্যমে সারা দেশের সাথে সংযুক্ত করবে।“
কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের পর পুরো চট্টগ্রামের পরিবহন ক্ষমতা বাড়বে। পশ্চিত তীর থেকে পূর্ব তীরে যেতে মাত্র ২০ মিনিট সময় লাগবে।
বাংলাদেশের পোশাক খাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলছিলেন, টানেল উন্মুক্ত করে দিলে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক বিকাশে।
নাসির উদ্দিন চৌধুরী
“প্রচুর শিল্প-অবকাঠামো তৈরি করার সুযোগ আছে নদীর ওপারে। এই টানেলটা হলে দক্ষিণ চট্টগ্রামে ব্যাপক শিল্পায়ন হবে। লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের জায়গা তৈরি হবে। দেশের জিডিপিতে ভূমিকা পালন করতে পারবে, একটা সুন্দর শহর তৈরি হবে ওপাশে। আমাদের চট্টগ্রামে কিন্তু শিল্প প্লটের খুব অভাব। আশাকরি সে অভাব পূরণ হবে”।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলমের মতে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে গতি ফিরবে চট্টগ্রামের বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে।
মাহবুবুল আলম
“এটা বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রাম হবে টুইন-সিটি। অনকেটা চীনের সাংহাই এর মতো। মানুষের বিকেন্দ্রীকরণ হবে, ওপাশে আরেকটা বড় শহর হবে। এটা চট্টগ্রামের জন্য অনেব বড় পাওয়া।“
টানেল হয়ে গেলে ঢাকা থেকে কক্সবাজার যেতে ৫০ কিলোমিটার দূরত্ব কমে আসবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ শেষে চালু হলে সার্বিকভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজীকরণসহ শিল্প-কারখানার বিকাশ ও পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।