শত বছরের সবচেয়ে সফল রাজনৈতিক দল-সিপিসি এবং আন্তর্জাতিক বন্ধুর গল্প
প্রিয় বন্ধুরা, পহেলা জুলাই হল চীনের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার শততম বার্ষিকী। একটি রাজনৈতিক পার্টি কীভাবে শত বছরে আরো প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে এবং কীভাবে জনগণকে নিয়ে এত বড় সাফল্য অর্জন করতে পারে? আজকের অনুষ্ঠানে আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করবো কিছু আন্তর্জাতিক বন্ধুর সঙ্গে সিপিসি’র মনোমুগ্ধকর গল্প। ভিন্ন দেশের গল্পের মাধ্যমে আপনারা হয়তো সিপিসি-কে আরো গভীরভাবে জানতে পারবেন।
হান্স মুলার
‘কখনই চীন থেকে যাবে না’। ডাক্তার হান্স মুলার মৃত্যুর আগে স্ত্রীকে বার বার এ কথা বলেছিলেন। সেটি ১৯৯৪ সালের কথা।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হয়। সুইজারল্যান্ড থেকে ডাক্তারি পাস করে জার্মানি যুবক হান্স অনেক কষ্ট করে চীনের শায়ানসি প্রদেশের ইয়ান আন শহরে যান। তিনি জাপানি আগ্রাসনবিরোধী যুদ্ধ ও চীনের মুক্তিযুদ্ধে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এবং চীনা জনগণের পাশে থেকে লড়াই করেছেন। এরপর তিনি চীনের সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণে যোগ দেন।
সিপিসির সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের কথা স্মরণ করে হান্স মুলারের ছেলে বলেন, মুলার চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক নেতা মাও সে তুং এবং প্রধান কমান্ডার চু দ্য-এর সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। এটি ছিল হান্স মুলারের স্মরণীয় স্মৃতি।
১৯২১ সালে সিপিসি প্রতিষ্ঠার পর চীনের কমিউনিস্ট পার্টি বিপ্লব, নির্মাণ এবং সংস্কারের বিভিন্ন সময়ে মুলারের মত অনেক বিদেশি বন্ধুকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। সিপিসি ও ভিনদেশীদের সঙ্গে শত বছরের মৈত্রী ও বন্ধুত্বের গল্পের মাধ্যমে বর্তমান বিশ্ব সিপিসিকে জানার একটি জানালা বটে।
বর্তমানে সিপিসি নয় কোটিরও বেশি সদস্য নিয়ে গঠিত বিশ্বের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। একশ’ বছরে সিপিসি জনগণকে নেতৃত্ব দিয়ে জাতীয় স্বাধীনতা বাস্তবায়ন করেছে, উপনিবেশের ইতিহাস বন্ধ করেছে, দেশটি আগের দরিদ্রতা থেকে বর্তমানে সার্বিক সচ্ছল সমাজ গড়ে তুলেছে। চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক গোষ্ঠী। দেশ অনেক শক্তিশালী হয়েছে।
বর্তমানে সিপিসি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে দ্বিতীয় শত বছরের উন্নয়নের লক্ষ্য বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে, চীনা জাতির মহান পুনরুত্থানের লক্ষ্য পূরণের চেষ্টাও করছে।
আদর্শের শক্তি ‘অবিশ্বাস্য’
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা কেমন মানুষ? ১৯৩৬ সালে চীনের শায়ানসি প্রদেশের সোভিয়েত এলাকায় মার্কিন লেখক এডগার স্নো এই প্রশ্ন করেন। জরাজীর্ণ মাটির গুহায় চীনের সাবেক নেতা মাও সে তুং স্নোর সঙ্গে বেশ কয়েক বার পুরো রাত ধরে আলোচনা করেছিলেন। চার মাসে স্নো সিপিসির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ভেং দ্য হুয়াই ও সুই হাই তুং এবং সাধারণ যোদ্ধাদের সাক্ষাত্কার নেন, লাল ফৌজের জীবন দর্শন করেন, সিপিসি নিজের আদর্শকে কঠোরভাবে পালন করায় তিনি খুব মুগ্ধ হয়েছেন।
‘রেড স্টার ওভার চায়না’ বইয়ে স্নো এভাবে লিখেছেন, সিপিসির সদস্যরা সাম্যবাদের প্রতি বিশ্বস্ত, আদর্শ তাদেরকে অবিশ্বাস্য শক্তি দিয়েছে।
শায়ানসি প্রদেশ পরিদর্শন করার পর মার্কিন ডাক্তার শফিক জর্জ হাতেম লাল ফৌজের সেনাদের দেশের জন্য আত্মত্যাগের চেতনায় মুগ্ধ হয়ে সিপিসিতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সিপিসিতে যোগ দেওয়া প্রথম পশ্চিমা মানুষ। তিনি বলেন যে, নিজের অবদান রাখতে চাইলে মনে দৃঢ় চেতনা থাকতে হবে।
একশ’ বছরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি শুরুর দিকের সরল উদ্দেশ্য ও আদর্শ মেনে চলেছে, জনগণকে নেতৃত্ব দিয়ে আবারও বিশ্বমঞ্চে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে চীন, দেশ শক্তিশালী হয়েছে। বিশ্বের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমাজের দীর্ঘস্থায়ী বাস্তবায়ন করছে।
ব্রিটিশ লেখক মার্টিন জ্যাক সম্প্রতি এক প্রবন্ধে বলেন, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি নিঃসন্দেহে একশ’ বছরে সবচেয়ে সফল রাজনৈতিক পার্টি।
চীনে কর্মরত ও অধ্যয়নরত বিদেশিরা বিভিন্ন মহলের সিপিসি সদস্যের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। তাঁরা এর মাধ্যমে সিপিসি সম্বন্ধে নতুন উপলব্ধি অর্জন করেছেন।
ফরাসি বাবুর্চি কুয়াংথান শাংহাইয়ে একটি রেস্তরাঁ খোলেন। তিনি মনে করেন, পশ্চিমা দেশের অনেক মানুষ সাম্যবাদ সম্বন্ধে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের পুরোনো ধারণা পোষণ করছে। তবে, তারা সিপিসি সম্বন্ধে সত্য ধারণা পোষণ করে না। তিনি দেখেছেন যে, যখন দেশ ও জনগণের প্রয়োজন, তখন সিপিসির সদস্যরা সবসময় ফ্রন্ট লাইনে আছে।
চীনে ১৫ বছর বাস করা কুয়াংথান বলেন, রাজনৈতিক পার্টিকে মূল্যায়নের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন। সিপিসির নেতৃত্বে, চীনা মানুষের জীবন আরো সুন্দর হচ্ছে।
জাপান-চীন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের প্রধান নাকাশিমা তসুরমি দীর্ঘসময় ধরে জাপান-চীন বিনিময়ের কাজ করেছেন। তিনি বলেন, সিপিসি দেশের ভবিষ্যত উন্নয়নে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে এবং সে লক্ষ্যে কাজ করছে।
মিলারের স্ত্রী, ৯১ বছর বয়সী কিওকো নাকামুরা আগে লাল ফৌজের একজন সদস্য ছিলেন। মিলার কেন চীনের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেন? এই প্রশ্নের উত্তরে কিওকো নাকামুরা বলেন, চীনে এত বছর থাকার পর তিনি বুঝতে পেরেছেন, চীন একটি আশাব্যঞ্জক দেশ।
স্নোর বন্ধু ইসরাইল এপস্টাইন যুক্তরাষ্ট্রের ইউপিআই বার্তা সংস্থার সাংবাদিক। তিনি ১৯৪৪ সালে ইয়ান আন শহরে যান। তিনি মাও সে তুং, চৌ এন লাই, চু দ্য-সহ সিপিসি’র অন্যান্য নেতাদের সাক্ষাত্কার নেন। এপস্টাইন বিশ্বাস করেন, তিনি ও সিপিসি’র বিশ্বাস অভিন্ন। তিনি বিশ্বাস করেন, ইয়ান আন হল চীনের ভবিষ্যতের প্রতিফলন। এজন্য পরে তিনি চীনের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছেন।
এপস্টাইনের স্ত্রী হুয়া হুয়ান বি বলেন, তিনি সবচেয়ে বেশি যে বিষয়ের প্রশংসা করেন, তা হল সিপিসি সবসময় গরীবকে সাহায্য করে ও জনগণকে সেবা করে।
অস্ট্রেলিয়া কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক অ্যান্ড্রু এরউইন এভাবে মূল্যায়ন করেন: সিপিসি সমাজতন্ত্র ও জনগণের চাহিদাকে সংযুক্ত করে বিরাট সাফল্য অর্জন করেছে। সিপিসি বিশ্বের কাছে সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
সবসময় জনগণের সেবা করা
স্নো ১৯৩৬ সালে সিয়ান শহর ত্যাগ করার সময় দেখেছিলেন, আগে চিয়াং কাই–শেক সবখানে কঠোরভাবে অবরোধ করে রাখতেন; তবে মাও সে তুংসহ সিপিসি’র নেতারা সিয়ানে জনগণের সঙ্গে খুব ভালো সহাবস্থান করছেন। তিনি বইয়ে লিখেছেন, এতে প্রমাণিত হয়, কে জনগণকে ভয় পায় এবং কে জনগণকে বিশ্বাস করে।
এপস্টাইন ‘নিইউয়র্ক টাইমসের’ জন্য লেখা এক প্রবন্ধে বলেন, লাল ফৌজ জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখে; তারা কখনই জনগণের পকেট থেকে কিছু নেয় না।
স্নো আগে চীনের শায়ানসি প্রদেশের উত্তরাঞ্চলে চীনের সবচেয়ে গরীব এলাকার অন্যতম হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এখন সিপিসির নির্দিষ্ট দারিদ্র্যবিমোচন নীতির কল্যাণে এবং চীনের অন্যান্য দরিদ্র এলাকা দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের পর থেকে এপর্যন্ত চীনে ৭০ কোটিরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ডেভিড অসবর্ন হলেন চীনের দারিদ্র্যবিমোচন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণকারী একজন। পাঁচ বছরে তিনি দশ/বারো বারের মতো চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কানসু প্রদেশের হুয়ান জেলায় যান। তিনি স্থানীয় মেষ লালন প্রকল্পে সাহায্য করেন।
তিনি বলেন, সিপিসি কোটি কোটি মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করেছে, যা অতুলনীয় সাফল্য, এটি বিশ্বের অন্যতম একটি সাফল্য। তিনি দেখেছেন, সিপিসি’র স্থানীয় সদস্যরা খুব উষ্ণহৃদয়ের মানুষ। তারা অন্যকে সাহায্য করতে পছন্দ করেন; তারা যথাসাধ্য সব প্রয়োজনীয় কাজ করেন।
২০২০ সালে আকষ্মিক করোনাভাইরাসের মহামারি প্রতিরোধে চীন সবসময় জনগণের জীবন রক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। পুরো দেশের শক্তি জড়ো করে ভাইরাস প্রতিরোধ করেছে। সিপিসি’র সদস্যরা সবসময় মহামারি প্রতিরোধের ফ্রন্ট লাইনে দাঁড়িয়ে কাজ করেছে।
চীনের কুয়াংচৌ শহরের এক হাসপাতালে কাজ করা গ্যাবনের ডাক্তার জিন ক্রিশ্চিয়ান নেজেঞ্জার গত বছর চীনা ডাক্তারদের সঙ্গে চীনা কমিউনিটিতে ভাইরাস প্রতিরোধের কাজ করেছিলেন। তিনি বলেন, এটি খুব বিপদজনক কাজ। তবে আমার সঙ্গে কাজ করা সিপিসি’র সদস্যরা কখনওই ভয় পায় নি। তারা খুব সাহস ও পরিশ্রমের সঙ্গে কাজ করেছেন। কারণ, তারা নিজের দেশকে ভালোবাসেন, দেশের জনগণকে রক্ষা করতে চান।
সিপিসি সবসময় দেশ ও জনগণের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। জাপানি আগ্রাসনবিরোধী যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ, ওয়েন ছুয়ান ভয়াবহ ভূমিকম্প, বিশ্বের আর্থিক সংকট মোকাবিলা, করোনাভাইরাসের মহামারি প্রতিরোধসহ বিভিন্ন ব্যাপারে সিপিসি জনগণকে নেতৃত্ব দিয়ে সফলভাবে বিভিন্ন সমস্যা ও ঝুঁকি প্রতিরোধ করেছে।
২০২০ সালের জুন মাসে প্রকাশিত চীনের করোনাভাইরাস মহামারি প্রতিরোধে চীনের কার্যক্রম নামে শ্বেতপত্রে বলা হয়, দেশে ৩.৯ কোটিরও বেশি সিপিসি সদস্য মহামারি প্রতিরোধের ফ্রন্ট লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, প্রায় চার শতাধিক সিপিসি সদস্য জনগণের প্রাণ রক্ষায় নিজের প্রাণ উত্সর্গ করেছেন।
পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ১৮০০ জনেরও বেশি সিপিসি সদস্য চীনের দারিদ্র্যবিমোচনের যাত্রায় প্রাণ উত্সর্গ করেছেন। ২০২০ সালে চীন সফলভাবে দারিদ্র্যমুক্তির লক্ষ্য বাস্তবায়ন করেছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থার গণজরিপে থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, সিপিসি আরো বেশি জনসমর্থন পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত জরিপ থেকে জানা গেছে, সিপিসির নেতৃত্বাধীন চীন সরকার জনগণের ৯৩ শতাংশ সন্তুষ্টি পেয়েছে।
১৯৩৬ সালে স্নো তাঁর বইতে লিখেন: লাল তারকা পুরো চীনকে উজ্জ্বল করবে।
এখন তাঁর কথা সত্য হয়েছে। সিপিসি চীনা জনগণকে নিয়ে মহান সাফল্য অর্জন করেছে এবং নয়া চীন প্রতিষ্ঠা করেছে।
করোনাভাইরাসের মহামারিতে সিপিসি’র দেওয়া ‘মানবজাতির অভিন্ন ভাগ্যের কমিউনিটির’ ধারণা আরো বেশি দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। মানবজাতির জন্য আরো বেশি অবদান রাখা হল সিপিসি’র উন্নয়নের লক্ষ্য ও কর্তব্য।
(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)