ছুংছিং শহরের সিয়া চুয়াং গ্রামের চার পাশেই হাজার মিটার উঁচু পাহাড়। এই গ্রামে একটি দু’তলার জাদুঘর আছে, এতে সিয়া চুয়াং গ্রামের মানুষের পাহাড়ে সড়ক তৈরি করার স্মৃতি সংগ্রহ করা হয়েছে।
সিয়া চুয়াং গ্রামকে ‘থিয়ানখেং’ বলা হয়, এর অর্থ ‘আকাশের খাদ’। অতীতে, চার পাশে খাড়া উঁচু দুর্গম পর্বতশ্রেণী ছিল। খাড়া দেয়ালের মতো। এসব খাড়া পাহাড় সিয়া চুয়াংয়ের মানুষকে সেখানে আটকে রেখেছিল। প্রায় চারশ’ গ্রামবাসীদের মধ্যে অর্ধেকই কখনও পাহাড় থেকে বের হন নি!
১৯৯৭ সালে মাও সিয়াং লিনকে গ্রামের সিপিসি’র শাখা সম্পাদক হিসেবে নির্বাচন করা হয়। তিনি পাহাড় থেকে বের হওয়ার এক সড়ক তৈরি করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
গ্রামবাসীদের সম্মেলনে তিনি সবাইকে উত্সাহ দিয়ে বলেন: সবাই সারা জীবন গরীব হয়ে থাকবে না। এক ইঞ্চি খনন করলে পাহাড় এক ইঞ্চি ছোট হয়ে যায়, এক ইঞ্চি পথ তৈরি করলে এক ইঞ্চি আশা তৈরি হয়। এই প্রজন্মের মানুষ কাজ শেষ করতে না পারলে পরবর্তী বংশধররা এই কাজ এগিয়ে নেবে। হাত দিয়ে একটি পথ গড়ে তোলা যায়। সম্মেলনে মাও সিয়াং লিন সবার আগে প্রতিশ্রুতি পত্রে তার নাম সই করেন। তিনি লেখেন, সড়ক তৈরি না হওয়া পর্যন্ত কখনওই চেষ্টা বন্ধ করবো না।
আসলে সড়ক নির্মাণের কাজ ছিল কল্পনার চেয়েও অনেক কঠিন। চারদিকে উঁচু পাহাড়, পা রাখার কোনো জায়গা নেই। যাদের সাহস বেশি, তারা কোমরে দড়ি বেঁধে ঝুলে ঝুলে, কয়েকশ’ মিটার উঁচু পাহাড়ে বিস্ফোরক রাখার গর্ত খনন করেন।
পায়ের নিচে খাড়া খাদ; একবার পা ফসকে পড়ে গেলে নির্ঘাত মৃত্যু। কাজের সময় উপর থেকে ভাঙা পাথরের টুকরা খসে পড়ে! মাও সিয়াং লিন সবার আগে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন। তিনি প্রথমে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি নেন। তারপর অন্যরা তাঁর পিছে এই কাজ করতে থাকে।
সড়ক নির্মাণের কাজ চলে সাত বছর। এর মধ্যে ছয়জন গ্রামবাসী সড়ক নির্মাণের কাজ করতে গিয়ে প্রাণ হারান।
গ্রামবাসী হুয়াং হুই ইউয়ানের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে মাও সিয়াং লিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে সবাইকে জিজ্ঞেস করেন: যদি আবারও সড়ক নির্মাণের কাজ করি, তাহলে হয়তো অন্য কেউ মারা যাবে। এখন বলুন, আমরা কি এই সড়ক নির্মাণ করবো?
কেউ একজন চিত্কার করে বলে, ‘করবো, করবো...’। কথাটি বলেছেন মৃত হুয়াং হুই ইউয়ানের বাবা হুয়াং ই খুন।
সবাই হাত তুলে তার কথার সঙ্গে কণ্ঠ মিলায়। খাড়া পাহাড়ের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে তাদের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি।
অবশেষে ২০০৪ সালে খাড়া উঁচু পাহাড়ে একটি ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২ মিটার চওড়া সড়ক তৈরি হয়।
সড়ক চালু হওয়ার দিনে মাও সিয়াং লিন একটি গাড়ি নিয়ে আসেন। তিনি পুরো সড়ক ঘুরে দেখেন। গোটা গ্রামের মানুষ সেই গাড়ির পিছনে পহাড়ি সড়কে হাঁটতে থাকে। গ্রামবাসী ফেং রেন সুং বলেন, যখন পথের শেষ মাথায় পৌঁছাই, তখন মাও সিয়াং লিন ধৈর্য ধরে রাখতে পারেন নি। তিনি বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন; শুধু তিনিই নন সবাই কাঁদতে থাকেন। এ আনন্দের কান্না; ধৈর্য, পরিশ্রম ও ত্যাগের পর বিজয় অর্জনের কান্না।
পরে স্থানীয় সরকার সিয়া চুয়াং গ্রামের সড়ক উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দ দেয়। আগে সিয়া চুয়াং গ্রাম থেকে জেলা শহরে যেতে দুই দিন সময় লাগত; এখন লাগে দেড় ঘণ্টা!
২০০৪ সালে সিয়া চুয়াং গ্রাম ছিল হতদরিদ্র গ্রাম। মাও সিয়াং লিন জানান, দারিদ্র্যমুক্ত হতে চাইলে শুধু সড়ক নির্মাণ যথেষ্ট নয়, বরং শিল্পোন্নয়ন করতে হয়।
তিনি কৃষি বিশেষজ্ঞকে গ্রামে আসার আমন্ত্রণ জানান, তিনি গ্রামের কৃষি অবস্থার সার্বিক পরীক্ষা করেন। অবশেষে গ্রামে কমলা, পিচ ও তরমুজ এই তিনটি দারিদ্র্যবিমোচনের শিল্প উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জেলা কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ পাঠিয়ে এ কাজে সাহায্য দেয়।
কয়েক বছর চেষ্টার পর ২০১৫ সালে সিয়া চুয়াং গ্রাম দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। ২০২০ সালে পুরো গ্রামের মাথাপিছু আয় ১৩ হাজার ইউয়ান ছাড়িয়ে যায়।
২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি, মাও সিয়াং লিন বেইজিংয়ের গণ-মহাভবনে দাওয়াত পান। চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদ তাঁকে ‘দেশের দারিদ্র্যবিমোচনের দৃষ্টান্ত’ সম্মাননা দেয়।
তিনি আবার গ্রামে ফিরে আসেন। এবার তিনি গ্রামবাসীদের সঙ্গে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এবারের মিশন: গ্রামের পরিবেশ সুন্দর করতে হবে, পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে এবং গ্রামীণ পর্যটনকে সমৃদ্ধ করতে হবে।
(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)