ফুলের বাবা
2021-06-26 18:54:17

ফুলের বাবা_fororder_hua3

 

চীনের সানসি প্রদেশের ইউয়ান পিং শহরের সি চুয়াং গ্রামে, একজন ৭২ বছর বয়সী বৃদ্ধ এবং ৬৬ বছর বয়সী বৃদ্ধা বহু বছর ধরে দশ/বারোটি অনাথ ও প্রতিবন্ধী শিশুর দেখাশোনা করছেন। তাঁরা চাষাবাদ করে কিছু অর্থ উপার্জন করে এই কাজ এগিয়ে নিয়েছেন। আগে তাঁরা ছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ, কিন্তু এতগুলো শিশুর যত্ন নেওয়ার জন্য তাঁদেরকে এক সময় মানুষের কাছে হাত পাততে হয়। তবে, এজন্য তাঁরা কখনই অনুতপ্ত হয় নি।

এসব শিশুর বাবার নাম ছেন থিয়ান ওয়েন এবং মা’র নাম কুও কাই রান।

 

গ্রামের ছোট রাস্তার শেষ প্রান্তে একটি দু’তলার বাড়ি হল ছেন থিয়ান ওয়েনের বাসা। প্রাঙ্গনের উঠানে ফুল ফুটে আছে। দরজায় কেউ চক দিয়ে লিখেছে- ‘ফুলের বাড়ি’ এবং নম্বর লেখা আছে। কেউ বলে, এর নাম হল ‘ফুলের বাড়ি’, কারণ এখানে ফুলের মত শিশুরা বাস করে।

 

ভোর ৫টার দিকে, সূর্যোদয়ের আগেই ছেন থিয়ান ওয়েন বিছানা ছেড়েছেন। তিনি শিশুদের জন্য পানি নিয়ে এসেছেন, প্রতিবন্ধী শিশুদের হাতমুখ ধুয়ে দিচ্ছেন। তারপর তিনি রান্না শুরু করেন। এখন তাঁর বাসায় ৯টি শিশু আছেন। তাদের মধ্যে অধিকাংশই নিজের যত্ন নিতে পারে না এবং কথা বলার সামর্থ্য নেই। কেউ কেউ শারীরিক প্রতিবন্ধী, কেউ মানসিক প্রতিবন্ধী। তারা দেখতে আসল বয়সের চেয়ে ছোট, শরীরে প্রতিবন্ধী হলেও, তাদের মুখের হাসি খুব সরল ও আন্তরিক। এতে সময়ের ছাপ পড়ে নি।

ফুলের বাবা_fororder_hua2

ছেন থিয়ান ওয়েন খুব সরু। গ্রামবাসীদের দৃষ্টিতে তিনি চোখে কম দেখেন, হৃদরোগী ও ডায়াবেটিসের রোগী! তবে শিশুদের চোখে তাদের জন্য সবকিছু করতে পারেন- এমন বাবা তিনি! তিনি শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাবার কিনতে ভালোবাসেন, শিশুরা তাঁর রান্না করা খাবার খেতেও বেশ পছন্দ করে।

 

ছেন-এর দৃষ্টিশক্তিও ভালো না। ক্ষেতে কাজ করার সময় তিনি প্রথমে কোদাল দিয়ে ক্ষেতের লাইন খুঁজে বের করেন, তারপর এক লাইন এক লাইন করে জমি চাষ করেন। ভুট্টা চাষ করাকে অনেক জায়গায় ‘অলস লোকের কাজ’ হিসেবে বলা হয়। মানে, ভুট্টা চাষে বেশি যত্ন নেওয়ার দরকার নেই, শরত্কালে আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করতে হয়। তবে ছেন দম্পতি ভুট্টা চাষের ওপর বেশি গুরুত্ব দেন। প্রতি সকালে শিশুদের কাপড় ধোয়া এবং বাড়িঘর পরিষ্কারের পর তাঁরা নিশ্চয় ক্ষেতে গিয়ে শস্য চাষ করবেন।

 

সাধারণত ছেন হাসিখুশি ফুর্তিবাজ লোক। তিনি বলেন, সবচেয়ে কঠোর সময় পার হয়ে গেছে, এখন সরকার আমাদের অনেক ভর্তুকি দেয়, সহৃদয় মানুষদের দেওয়া দুই লাখেরও বেশি ইউয়ান দিয়ে আমরা বর্তমানের ‘ফুলের বাড়ি’ কিনেছি। এখানে থাকার অবস্থা বেশ ভালো, জীবনও দিন দিন ভালো হয়ে উঠছে।

ফুলের বাবা_fororder_hua1

ছেন দম্পতি জানান, আগে ছেন কারখানায় কাজ করতেন, গ্রামে তাঁর পরিবারের অবস্থা ছিল মাঝামাঝি মানের। ১৯৮৯ সালে তিনি ও তাঁর স্ত্রী কুও গ্রামের পথের পাশে একটি প্রতিবন্ধী শিশু কুড়িয়ে পান। তখন তাঁদের তিন ছেলেমেয়ে ছিল। ছেন দম্পতি আন্তরিকভাবে যত্ন নিলেও প্রতিবন্ধী শিশুটি চার বছর বয়সে মারা যায়।

ছেন দম্পতির অনাথ ও প্রতিবন্ধী শিশুদের লালন করার সহৃদয় আচরণ মানুষ জানতে পারে। কেউ তাদের প্রশংসা করে, কেউ তাদেরকে বোকা বলে। কেউ কেউ সরাসরি তার শিশুকে ছেনের বাসার দরজার সামনে রেখে চলে যায়।

 

এখন শিশুর সংখ্যা বেড়েছে, খাবার খাওয়া ছাড়া তাদের চিকিত্সাও করতে হয়। ছেন বাধ্য হয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন এবং স্ত্রী কুও-এর সঙ্গে শুধু শিশুদের যত্ন নেন। এ কারণে পরিবারের আয় অনেক কমে গেছে। সবচেয়ে কঠোর সময়ে, ছেন সব আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকা পয়সা ধার নেন, একটা সময় কেউ তাকে টাকা ধার দিতে চায় না।

 

তাঁর দ্বিতীয় ছেলে ছেন চিয়ান ওয়েই-এর বিয়ে করার সময় হয়েছে। তবে কয়েকবার প্রেমের পরও শেষ পর্যন্ত কোনো মেয়ে তাকে বিয়ে করতে রাজি হয় নি। বৃদ্ধ ছেন মনে করেন, হয়তো তার পরিবারের এ অবস্থা দেখে কোনো মেয়ে তাঁর ছেলেকে বিয়ে করতে চাচ্ছে না! পরিবারের কাজকে বোঝা হিসেবে মনে করছে মেয়েরা। তাঁর বড় ছেলে ছেন চুন ওয়েই বলেন, আমি পরিবারের বড় ছেলে, আমি এ কথা না-বললে কে বলবে? আমাদের পরিবারের অবস্থা ধীরে ধীরে আরো খারাপ হচ্ছে; প্রতিদিন প্রতিবন্ধী শিশুদের যত্ন ও লালন-পালনের কাজ করতে হয়।

 বড় ছেলে ছেন চুন ওয়েই বলেন, তিনি একদিন আর সহ্য করতে না-পেরে বাবাকে এসব কথা বলেন, মনের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তবে বাবা ছেন তাঁর কথা শুনে তাকে গোপনে একটি কথা জানান। তা হল- তাঁর বড় ছেলে ছেন চুন ওয়েই আসলে ওইসব শিশুর মতোই সমাজের একটি পরিত্যক্ত শিশু ছিলেন।

সেই মুহূর্তে ছেন চুন ওয়েইয়ের মাথায় যেন বিনা মেয়ে বজ্রপাত হয়!

এখন তার মানসিক অবস্থা পরিবর্তন হয়েছে। এখন তাঁর মনে এই পালক বাবা-মা’র প্রতি শুধুই কৃতজ্ঞতা!

ফুলের বাবা_fororder_hua4

দ্বিতীয় ছেলে ছেন চিয়ান ওয়েই বলেন, আমার বাবা মা সবসময় শিশুদের যত্ন নেন। তাঁদেরকে অনেক কাজ করতে হয়, কষ্ট সহ্য করতে হয়। আমাদের বড় ভাই, বড় বোন এবং আমি অল্প বয়স থেকে ছোট ভাইবোনের লালনপালন করার পদ্ধতি শিখেছি। শুরুতে বড় ভাই ছোট শিশুদের সাহায্য করতেন, তারপর বড় ভাই বোর্ডিং স্কুলে যাওয়ার পর তাঁর বড় বোন, তাঁর পর তিনি। ছোট ভাই বোনের যত্ন নেয়ার জন্য ছেন চিয়ান ওয়েই ৯ বছর বয়সে রান্না করা শিখেন। তখন তার উচ্চতা ছিল চুলার সমান। যখন বাবা মা ক্ষেতের কাজ করতেন, তখন এতগুলো শিশুকে সময়মত গরম খাবার খাওয়াতে হতো।

 

এখন এসব শিশুদের মধ্যে যে দুইজন প্রতিবন্ধী নন, তারা থাই ইউয়ান শহরে খেলাধুলা শিখছে। বড় বোন বাসায় দুইজন প্রতিবন্ধী শিশু দেখাশোনা করেন। আর ছেন দম্পতিকে সাহায্য করছেন বড় ছেলে ছেন চুন ওয়েই।

বড় ছেলে ছেন চুন ওয়েই বলেন: আমার বাবা মা’র বয়স বাড়ছে। তাদের চিন্তার বিষয় হল- বাবা মা মারা গেলে কীভাবে এসব শিশুর দেখাশোনা করা হবে? তবে, আমরা আছি। আমরা নিশ্চয় তাদের লালনপালন করবো। তিনি বলেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বাবা মা’র কষ্ট আরো ভালোভাবে বুঝতে পারছেন।

বড় ছেলে ছেন চুন ওয়েই বলেন: বাবা একটি বড় পাহাড়, তিনি পুরো পরিবারের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মানুষ।