কীভাবে বর্ষা কাটে বস্তির অসহায় মানুষদের?
2021-06-24 20:37:22

কীভাবে বর্ষা কাটে বস্তির অসহায় মানুষদের?_fororder_jingji11

ঢাকার কড়াইল বস্তিতে এক শিশু। ছবি: আজহার

আজহার লিমন, ঢাকা: প্রতি বছর অতিবৃষ্টি, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের মত কারণে দেশে বাস্তুচ্যুত হয় প্রায় ৪ লাখ মানুষ। এছাড়া কাজের খোঁজে প্রতিনিয়ত শহরমুখি হয় গ্রামের কৃষিজীবীসহ প্রান্তিক মানুষ। সামাজিক সুরক্ষা খাত নিয়ে নানা আলোচনা থাকলেও এতে কতটা জায়গা আছে এসব প্রান্তিক মানুষের?

কীভাবে বর্ষা কাটে বস্তির অসহায় মানুষদের?_fororder_jingji22

কড়াইল বস্তির বাসিন্দা মোহসেন মিয়া। ছবি: হাবিবুর রহমান অভি।

 

আষাঢ়ের টানা বৃষ্টির কোন এক বুধবারবারে আমার কথা হয় রাজধানীর মহাখালির কড়াইল বস্তির মোহসেন মিয়ার সঙ্গে। ৪০ বছর আগে এমনই এক বৃষ্টিমুখর দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ে ছেড়ে রাজধানীতে আসেন তিনি। ৪টি দশক এ শহর তাকে কী দিয়েছে? জানতে চাইলে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন মোহসেন মিয়া। তার কাছে বলতে গেলে জীবনের তেমন কোন পরিবর্তন নেই। শুধু খেয়ে পড়ে জীবন যাপন। মোহসেন মিয়া কড়াইল বস্তির ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি টিনের ঘরে ভাড়া থাকেন। এই টিনের ঘরটিকে বেড়া দিয়ে ৩ ভাগ করা হয়েছে। কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, এই একরুমে আমি আমার বউ, ছেলের বউ সবমিলে ৭ জন থাকি। এটা কেমন জীবন। খুব কষ্ট করে থাকি।

 

বর্ষকাল এলে পরিবারের কষ্ট বাড়ার কারণ হিসেবে মোহসেন মিয়া জানান, সেসহ তার পরিবারের সদস্যরা ভ্যান-রিক্সার চালানোর মত দিনমজুরের কাজে নিয়োজিত। এ সময়টাকে কাজ পাওয়া যায় না।

মোহোসেন মিয়ার মত বর্ষাকালের এমন দুর্ভোগের কথা জানালেন বস্তির অনেকেই। এদের একজন নাজমা বেগম। বস্তির মুখে ছাতা টাঙিয়ে যাকে আমরা চকলেট ও ফ্লেক্সিলোডের দোকান চালাতে দেখি। নাজমা বেগমও প্রায় দুই যুগ আগে তার পরিবারের সঙ্গে সরূপকাঠি থেকে ঢাকার এই বস্তিতে এসেছেন।

কীভাবে বর্ষা কাটে বস্তির অসহায় মানুষদের?_fororder_jingji33

নাজমা বেগম। ছবি: হাবিবুর রহমান অভি

নাজম বেগমের অভিযোগ, করোনা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর জন্য অনেক চেয়েও কোন ত্রাণ পায় নি তার পরিবার। টাকার অভাবে তার মেয়েকে কলেজে ভর্তি করাতে পারেন তিনি। তার স্বামীর কুরিয়ারে ডেলিভারী ম্যান হিসেবে কাজ করেন। তার স্বামীর আয়, তার এ দোকান সব মিলিয়ে প্রতিবেলা খেয়ে পড়ে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন।

কীভাবে সংসার চলছে জানতে চাইলেন নাজমা বেগম বলেন, “ ৩বেলা ডাল ভাত খাচ্ছি!”

কিন্তু সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিয়ে এত এত আলোচনার পরই এমন অভিযোগ কেন আসছে? সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত রিপোর্ট বলছে, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে প্রকৃতিক দুর্যোগ সহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণেই প্রতিবছর বাংলাদেশে বাস্তচ্যুত হচ্ছে প্রায় ৪ লাখ মানুষ। ভিটেমাটিহারা এমন মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে দেশের বড় বড় নগরীগুলো। এ কারণে প্রতিবছর শহরে বাড়ছে জনসংখ্যাও। গ্রাম থেকে আহার, কর্মসংস্থানের খোঁজে শহরের দিকে এই মানুষের পদযাত্রা, তাতে লাভ হচ্ছে কতটা? স্বাস্থ্য, শিক্ষার মৌলিক সুবিধাবঞ্চিত একেকটা প্রজন্ম তৈরি ছাড়া তেমন কোন উৎপাদনশীলতা পাওয়া যায় না এসব বস্তি থেকে। কেন সবসময় হিসেবের বাইরে থেকে বঞ্চিত এই মানুষগুলো? বেসরকারি সংস্থা ব্রাকের মাইগ্রেশন বিভাগের প্রধান শরিফুল ইসলাম মনে করেন, সামাজিক সুরক্ষা খাতে ক্যাটাগরিভিত্তিক বিভাজনে এসব বাস্তুচ্যুত মানুষের কোন বিভাগ না থাকায় হিসেবের বাইরে থেকে যাচ্ছে জনসংখ্যার এই বিরাট অংশ।

কীভাবে বর্ষা কাটে বস্তির অসহায় মানুষদের?_fororder_jingji4

 

শরিফুল হাসান, হেড অব মাইগ্রেশন, ব্রাক

শরিফুল হাসান বলেন, “আমাদের সোস্যাল সেফনিনেটের মাঝে নানাভাবেই আমরা মানুষকে টার্গেট করা চেষ্ট করে। কিন্তু সেটা যদি দেখেন বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী বা এরকম। সেখানে আলাদা করে বস্তিকে টার্গেট করে বা স্থায়ী নয় এরকম টার্গেট করে করা  হয় না। যার কারণে ইন্টারনাল মাইগ্রেশনের কারণে আমরা তাদেরকে সোস্যাল সেফটিনেটের কোন আওতায় আনি না।

জনাব শরিফুল হাসান  এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ‘কোন মানুষ গৃহহীন থাকবে না’ উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেন। কিন্তু বস্তিরবাসীর প্রতি স্বাভাবিক একটা ধারণা যে তারেদ  গ্রামে কোন একটা ঠিকানা আছে, সে দিক বিবেচনায় এর আওতায়্ও আসে না এসব বস্তিবাসী। এ ক্ষেত্রে তাহলে করণীয় কী?

জনাব হাসান বলেন, “এ ক্ষেত্রে সিটি করপেরেশন, পৌরসভাগুলো উদ্যোগ নিতে পারে। যেহেতু এসব স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজই নগরীবাসীর সেবা করা। এক্ষেত্রে এসব জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে অর্থনৈতিক, সামাজিক বা মৌলিক স্বাস্থ্যসেবার মত উদ্যোগ হাতে নেওয়া যেতে পারে।”

 

২০১৪ সালে সবশেষ বস্তিুশুমারি অনুসারে শুধু ঢাকা মহানগরীর দুই সিটিতে বস্তির সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩ হাজার। দসে সময় দেশে বস্তিবাসীর সংখ্যা ছিলো ২২ লাখেরও বেশি। এরপরের দীর্ঘ এই সময়টাতে শহরের বস্তিগুলোতে কত সংখ্যক মানুষের ঠাই হলো সেটা যেমন নিশ্চিত হয়, তেমনি নিশ্চিত নয় বংশ পরম্পায় এক বঞ্চিত প্রজন্মের ভবিষত।

আজহার লিমন। চীন আন্তর্জাতিক বেতার।