চীনের মহাকাশচারীদের গল্প
2021-06-18 15:51:19

 

চীনের মহাকাশচারীদের গল্প_fororder_shen2

চীন গত বৃহস্পতিবার সফলভাবে মহাকাশে চীনের শেনচৌ ১২নং মানববাহী নভোযান উৎক্ষেপন করেছে। এই নভোযানে তিনজন মহাকাশচারীকে চীনের থিয়েন হ্য মহাকাশ স্টেশনে পাঠানো হয়। তাদের নাম নিয়ে হাই শেং, লিউ বো মিং এবং থাং হুং বো। আজকের অনুষ্ঠানে চীনের মহাকাশ অনুসন্ধান ক্ষেত্রের বীর মহাকাশচারীদের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবো।

 

এবার মহাকাশ মিশনের মহাকাশচারী দলের প্রধান হলেন নিয়ে হাই শেং। তিনি মহাকাশ অভিযানের একজন ‘পুরোনো ও অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন’। তিনি তিনবার শেনচৌ মহাকাশ অনুসন্ধানে অংশ নিয়েছিলেন, যা ছিল শেনচৌ ৫নং, শেনচৌ ৭নং এবং শেনচৌ ৯নং প্রশিক্ষণ অভিযান। তিনি দুই বার শেনচৌ ৬নং এবং শেনচৌ ১০নং-এর মাধ্যমে মহাকাশে গিয়েছিলেন। এবার তিনি শেনচৌ ১২নং মিশনে অংশ নিচ্ছেন, তিনি ইতোমধ্যে চীনের সবচেয়ে বয়স্ক মহাকাশচারী। তাঁর নিজস্ব মহাকাশ অভিযানে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হলো।

 

নিয়ে হাই শেং ১৯৬৪ সালে চীনের হু পেই প্রদেশের চাও ইয়াং শহরের একটি ছোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ছয় ভাইবোন। তিনি সবচেয়ে ছোট। তাঁর বাবা মা দুজনই কৃষক, শস্য চাষ করে জীবনযাপন করেন। তাঁর পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। যথেষ্ট খাবার ছিল না, সারা বছর ভুট্টা খেয়ে জীবনধারণ করতে হতো। তবে তা সত্ত্বেও তাঁর বাবা-মা নিয়ে হাই শেংকে স্কুলে পাঠানোর চেষ্টা করেন। একবার স্কুলে লেখাপড়ার ফি দেওয়ার সময় তাঁর পরিবারে কোনো টাকা ছিল না। তাই স্কুলে একটি খরগোশ দিয়েছিল।

 

নিয়ে হাই শেং খুব মনোযোগ দিয়ে ও পরিশ্রম করে লেখাপড়া করেন। প্রাথমিক স্কুলে লেখাপড়ার সময় তিনি সবসময় বড় বোনের পুরোনো পোশাক পরে স্কুলে যেতেন, তার পায়ে কোনো জুতো থাকত না। এত গরীব অবস্থার মধ্যেও তিনি লেখাপড়া বন্ধ করেন নি। পরীক্ষায় তিনি সবসময় সবচেয়ে ভালো নম্বর পেতেন। মাধ্যমিক স্কুল থেকে স্নাতক পাসের পর তিনি জেলার ভালো উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে সক্ষম হন। সেই গ্রীষ্মের ছুটিতে উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার ফি উপার্জনের জন্য তিনি বিভিন্ন কাজ করেন। তাঁর থানা থেকে মাত্র দুইজন শিক্ষার্থী জেলার এই উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছিল। স্কুল তাঁর পরিবারের অবস্থা জানতে পেরে তাঁর জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থা করে। তারপরও প্রতি বছরের গ্রীষ্মকালের ছুটিতে তিনি অন্যের বাসায় গিয়ে কাঠ কাটা, চা তৈরি করা এবং কৃষিকাজ-সহ বিভিন্ন কাজ করে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করতেন। এভাবে এক ছুটিতে দশ বারো ইউয়ান অর্জন করতে পারতেন তিনি। এভাবে তিনি নিজের হাতেই উচ্চ বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার ফি সংগ্রহ করতেন।

চীনের মহাকাশচারীদের গল্প_fororder_shen

নিয়ে হাই শেং একটি প্রবন্ধে বলেছিলেন যে, ১৯৮৩ সালে উচ্চ বিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর চীনের বিমানবাহিনীতে নতুন সেনা ভর্তির বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। আমি এতে ভর্তি হতে চেয়েছিলাম, তাই আমি নাম নিবন্ধন করি। পরে বিভিন্ন পরীক্ষা ও শেনচৌ পরীক্ষায় পাস করে সত্যিই বিমানবাহিনীতে যোগ দিতে সক্ষম হই।

 

১৯৯৮ সালের মার্চ মাসে কয়েক দফা কঠোর পরীক্ষার পর প্রথম দফায় ১৪জন মকাশচারীর প্রশিক্ষণ শুরু হয়। চার বছরে তারা শেনচৌ ব্যবস্থাপনা, মানসিক অবস্থা, মহাকাশ পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সামর্থ্য, মহাকাশের পেশাদার প্রযুক্তি, উদ্ধার ও বেঁচে থাকাসহ ৮টি ক্ষেত্রের শতাধিক বিষয়ে কঠোর প্রশিক্ষণ নিতে হয়। যা মহাকাশচারীদের মানসিক ও শেনচৌ অবস্থার জন্য বড় চ্যালেঞ্জও বটে।

 

নিয়ে হাই শেং বলেন, মহাকাশের বিষয়গুলো শেখার সময় তাঁর কিছুটা কষ্ট হয়েছিল। স্কুল থেকে বের হয়েছেন দশ বারো বছরের মত, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির মতো দিন-রাত সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো শিখতে থাকেন। পরিবার যেন তাঁর লেখাপড়ার কক্ষ। সবখানে বই আর বই। দেয়ালেও লাগানো আছে বিভিন্ন নোট। তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে তাঁর ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিসেবে তাঁকে সাহায্য করতেন।

 

২০০৫ সালের ১২ অক্টোবর, শেনচৌ ৬নং উত্ক্ষেপন হয়। নিয়ে হাই শেং এবং ফেই চুন লুং এবারের অভিযানে যাবেন। তবে উত্ক্ষেপণের দিন হঠাত্ তুষারপাত হয়। নিয়ে হাই শেং-এর স্ত্রী নিয়ে চিয়ে লিন সাক্ষাত্কারে বলেন, তুষার দেখে তিনি খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তবে এই তুষারপাত নিয়ে হাই শেং-এর মনে তেমন প্রভাব ফেলে নি। তিনি স্মরণ করে বলেন, সেদিন তাঁরা দু’জন যেন স্বাভাবিক প্রশিক্ষণ দিনের মতো আচরণ করেন। তাঁদের হৃদস্পন্দন ছিল প্রতি মিনিটে ৭০। রকেট উত্ক্ষেপণের মুহূর্তে তিনি এবং ফেই চুন লুং হাত ধরেন। মহাকাশে পৌঁছার দ্বিতীয় দিন ছিল তাঁর ৪১তম জন্মদিন। কর্ম পরিকল্পনা খুব ব্যস্ত হওয়ায় আগের দিন রাতে পৃথিবীর স্টেশন তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে হাই শেং-এর ফোনালাপের ব্যবস্থা করে। তাঁর মেয়ে তাঁকে জন্মদিনের গান গেয়ে শোনায়, তাঁর স্ত্রীও শুভকামনা জানায়। তিনি মহাকাশে একটি স্মরণীয় জন্মদিন কাটান।

 

২০১১ সালের জুলাই মাসে নিয়ে হাই শেং মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। দুই বছর পর ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে নিয়ে হাই শেং শেনচৌ ১০নং অভিযান গ্রুপে নির্বাচিত হন। অভিযানের আগে নিয়ে হাই শেং দুই হাজার বারেরও বেশি প্রশিক্ষণ নেন।

শেনচৌ ১০নং অভিযানের মাধ্যমে নিয়ে হাই শেং মহাকাশে যাওয়া চীনের সবচেয়ে বয়স্ক মকাশচারীর সম্মান অর্জন করেন। তিনি জেনারেলের পরিচয়ে মহাকাশে যাওয়া প্রথম চীনা মহাকাশচারী। আট বছর পর এখন ৫৭  বছর বয়সী নিয়ে হাই শেং আবারও মহাকাশে যান।

 

নিয়ে হাই শেং এর আগে আস্থার সঙ্গে বলেছিলেন যে, বিদেশে ৫০, ৬০ বছর বয়সী মহাকাশচারীর সংখ্যা অনেক বেশি। মহাকাশ খুব বিস্ময়কর, মহাকাশের জীবন দারুণ আকর্ষণীয়। মানবজাতির মহাকাশ অনুসন্ধানের পেছনে কিছু রাজনীতি, অর্থনীতি ও বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন ধরনের উদ্দেশ্য আছে। তবে, এসব উপাদান ছাড়া, শুধুই মহাকাশে যাওয়াটা আমাদের চীনা জাতির হাজার বছর ধরের আকাঙ্ক্ষা। আমাদের পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি সময়ের ইতিহাস আছে, আমাদের জাতির জন্য আমরা এই চেষ্টা করবো।

চীনের মহাকাশচারীদের গল্প_fororder_shen1

এই তিনজন মহাকাশচারী মহাকাশে যাওয়ার আগে সাংবাদিকরা তাদের সাক্ষাত্কার নেন। এই সাক্ষাত্কারে মহাকাশ অভিযানের সদস্য লিউ বো মিং বলেন, তিনি মহাকাশ অনুসন্ধান কর্তব্যে অংশ নেন ২০০৮ সালে। তিনি শেনচৌ ৭নং নভোযানের মাধ্যমে মহাকাশ ভ্রমণ করেছেন। এ পর্যন্ত দীর্ঘ ১৩ বছর পার হয়েছে। তিনি বলেন, এই ১৩ বছর ধরে তাঁরা সবাই পরবর্তী মহাকাশ অভিযানের প্রস্তুতি নিয়েছেন। স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন। এই ১৩ বছরে চীনা মকাশচারীরা ধাপে ধাপে তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছে। তিনি এই স্বপ্ন পূরণের পথে অনেক এগিয়েছেন। ১৩ বছরের প্রশিক্ষণ, ১৩ বছরের চেষ্টা, ১৩ বছরের আকাঙ্ক্ষা। আগেরবার মহাকাশ যাওয়ার অভিজ্ঞতা যেন গতকালে মত। এখন তিনি আবারও মহাকাশে গিয়েছেন, এখন মহাকাশ থেকে সুন্দর পৃথিবী দেখছেন।

 

এতে মহাকাশচারী থাং হুং বো বলেন, এটাই হল তাঁর প্রথম মহাকাশ অভিযান। তিনি নিজেকে খুব ভাগ্যবান বলে মনে করছেন। তিনি ১৯৯৫ সালে বিমানবাহিনীতে যোগ দেন এবং ২০১০ সালে মহাকাশচারী হিসেবে নির্বাচিত হন। বহুবছর ধরে তিনি সবসময় চেষ্টা চালিয়ে গেছেন, কঠোর  প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। চিন্তাভাবনা, শরীর, মন এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েছেন। তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন যে, উপরের দিকে উঠতে চাইলে প্রথমে নিচের দিকে মূল শক্ত করতে হয়। ভূপৃষ্ঠে ভালোভাবে প্রশিক্ষণ নিলেই কেবল মহাকাশ অভিযান পালন করা যাবে।

 

১১ বছরে তাঁর সহযোদ্ধা লিউ ইয়াং, ওয়াং ইয়া পিং ও ছেন তুং মহাকাশযাত্রা সম্পন্ন করেন। ২০১৬ সালে তাঁকে শেনচৌ ১১নং মহাকাশ অভিযানের ব্যাক’আপ টিমে নির্বাচন করা হয়। তবে, সেবার তিনি মহাকাশে যেতে পারেন নি। তিনি নিজেকে বলেন, মহাকাশ যাত্রা হল তাঁর স্বপ্ন, মনে স্বপ্ন থাকলে ধাপে ধাপে স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। অবশেষে একদিন স্বপ্ন পূরণ হবে।

 

মহাকাশে তাঁদের তিনজন কীভাবে কাজ করেন?

এ সম্পর্কে নিয়ে হাই শেং বলেন, তিনি শেনচৌ ১২নং মহাকাশ মিশনের প্রধান। তবে তিনি মনে করেন, সবার দায়িত্বই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শেনচৌ ১২ মিশনে, যে কোনো সিংগল অপারেশন তাদের তিনজনের মধ্যে যে কোনো একজন স্বাধীনভাবে করতে পারে। যে কাজে দু’জনের প্রয়োজন, তাদের মধ্যে যে কোনো দু’জন একসাথে তা করতে পারে। যে কাজে তিনজনের প্রয়োজন হয়, সে কাজ তারা দলবদ্ধভাবে করেন।

 

কেন এভাবে বলেন। কারণ মানববাহী অভিযানের একটি বৈশিষ্ট্য হল ব্যাকআপ দরকার। মানে, যদি কেউ মিশন সম্পন্ন করতে না পরে, তাহলে ব্যাকআপ টিম তা সম্পন্ন করবে।

লিউ বো মিং বলেন, নিয়ে হাই শেং দুইবার মহাকাশ অভিযানে গিয়েছেন তাঁর অভিজ্ঞতা অনেক সমৃদ্ধ। তিনি প্রধানত সমন্বয় ও যোগাযোগের কাজ করেন। লিউ বো মিং শেনচৌ ৭নং অভিযানে প্রথমবার স্পেস শিপের বাইরে গিয়ে কাজ করেছেন। তিনি এক্ষেত্রে বেশ অভিজ্ঞ। আর নতুন মহাকাশচারী থাং হুং বো লেখাপড়া করতে পছন্দ করেন। এটাই হল তাঁর প্রথম মহাকাশ অভিযান, তিনি হলেন নিয়ে হাই শেং ও লিউ বো মিং-এর সহকারী।

 

নিয়ে হাই শেং বলেন, তিনি একজন মহাকাশচারী। তিনি সিপিসি’র একজন সদস্য। মহাকাশচারী ২০ বছরের বেশি সময় তিনি কাজ করছেন। তিনি দেখেছেন চীনের মানববাহী মহাকাশ অভিযানের অগ্রগতি। মহাকাশের সীমানা নেই, তাই স্বপ্ন পূরণে আরো দূরে যেতে হবে।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)