যে কারণে আম জাতীয় পণ্য বছর জুড়ে পাওয়া যায় না
2021-06-17 19:51:32

আজহার লিমন, ঢাকা: ঐতিহত্যগতভাবে চাষাবাদের দীর্ঘ ইতিহাস থাকলেও শিল্প হিসেবে দাঁড়ায়নি আম। গেল দশক জুড়ে এর উৎপাদন বেড়েছে, বেড়েছে জমির পরিমাণ। কিন্তু স্থানীয়ভাবে মৌসুমি ব্যবসা ছাড়া অর্থনীতিতে এর তেমন কোন প্রভাব নেই। কেন আমকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে না শিল্প? আমের বহুমাত্রিক বাণিজ্যিকিকরণ নিয়ে নতুন উদ্যোক্তাই বা তৈরি হচ্ছে না কেন?

 

আমের সঙ্গে এই অঞ্চলের সম্পর্কটা অতি প্রাচীন। চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং বাংলাদেশে এসেছিলেন ৬৩২ থেকে ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। সেসময়ে রসালো আমের জন্য বাংলাদেশের খ্যাতির কথা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বে। বাণিজ্যিকভাবে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আমের চাষও শুরু হয়েছিলো মুঘলদের সময় থেকে। বৃটিশ আমলেও এই বাংলাদেশেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদন হতো।

সেসব এখন অতীত। তবে এখনও বিশ্বের ৭ম আম উৎপাদনকারী দেশের খেতাব আছে বাংলাদেশের ঝুলিতে। এবং দেশজ ফল উৎপাদনের ৫ ভাগের এক ভাগই আসে আম থেকে। বাংলাদেশের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেবে, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে দেশে ফলের উৎপাদন ছিলো ১ কোটি ২১ লক্ষ ৫১ হাজার ৯৩৪ মেট্রিক টন যার মধ্যে ২৩ লাখ ৭২ হাজার টনই ছিলো আম।

 

দেশের উত্তর-পশ্চিমে আমকেন্দ্রিক এই অর্থনীতির আকার দিনকে দিন বাড়ছে। আন্তর্জাতিক কৃষি ও খাদ্য সংস্থাও বলছে, গেল দুই দশকে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আম চাষ বেড়েছে বাংলাদেশে, বছরে যার বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ১৬ শতাংশ। আগে আম ছিলো শুধু উত্তরাঞ্চলের ফল কিন্তু উত্তরপশ্চিম থেকে দক্ষিণেও শুরু হয়েছে আমের চাষ। সব মিলিয়ে দেশের অন্তত ৩০ জেলায় পাওয়া যাবে কৃষকের বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করা আমের বাগান।

 

দীর্ঘ এই সময়ে দেশের অভ্যন্তরে আমের ভোক্তাও বেড়েছে দ্বিগুণ। কিন্তু যে হারে কৃষক বাড়ছে, যে হারে আমের জমি বাড়ছে সে হারে বাড়ছে না, আমকে কেন্দ্র করে কোন স্থায়ী শিল্প কারখানা বা উদ্যোগ। দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনার কারণে ভোগ বাড়লেও, এতিহ্যগত মৌসুমভিত্তিক ব্যবসায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে আমের উৎপাদন ও বিপণণ। পচনশীল হওয়ায় চাহিদা যোগানের মারপ্যাচে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার অভিযোগও করেন কৃষক।

 

রাজশাহীর নওহাটা পৌরসভার পুঠিয়াবাড়ির তরুণ কৃষক জুয়েল রানা। তিনি ৩ বিঘা জমিতে এবার আম চাষ করেছেন। বলছিলেন, “সামগ্রিকভাবে আমাদের গাছের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু মানুষের সামগ্রিক লোকসানের কারণে ব্যবসাটা ধীরে ধীরে কমে আসতেছে। এক সময় ছিলো গাছগুলো ৩ বছর ৪ বছর আগেই কিনে নেওয়া হতো। এখন সে গাছ কেনার পরিমাণটা একেবারেই কমে গেছে। ক্রেতারা আম গাছে ধরার পরে দেখতেছে, দেখে তারপরে কিনছে। আমি নিজে ৩ থেকে ৪ বছর আগে শুরু করেছিলাম।  তখন যে বড় বড় গাছগুলো ছিলো সে গাছগুলো এখন কেটে ফেলার চিন্তা ভাবনা করছেন মালিকরা, কারণ তারা স্বাভাবিক যে অর্থ তারা পেত তা পাচ্ছে না।”

 

কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? দীর্ঘ ইতিহাস থাকার পরও কেন স্থায়ী শিল্প হিসেবে দাঁড়াচ্ছে না আম। মৌসুমী ব্যবসা বাদে, দেশীয় দুয়েকটি কোম্পানি আম থেকে জুস উৎপাদনের লক্ষ্যে পাল্প তৈরি ছাড়া সংরক্ষণের আর কোন উদ্যোগ চোখে পড়ে না। কিন্তু বিশ্বব্যাপীই চাহিদা রয়েছে হিমায়িত আম, ডিহাইড্রেট বা শুকানো আমেরা মত মানসম্মত পণ্যের। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কৃষি বিশেষজ্ঞ  মঞ্জুরুল ইসলাম মনে করেন, আধুনিক সময়ের চাহিদা অনুযায়ী আমকেন্দ্রিক শিল্প গঠনে বাঁধা রয়েছে উৎপাদক থেকে সরকারি পর্যায়ে।

 

তিনি বলেন, “আমের কিন্তু বিরাট একটা অপরচুনিটি আছে। যেমন ডিহাইড্রেড ম্যাংগো করা যেতে পারে, ফ্রোজেন ম্যাংগো। নানা প্রোডাক্ট আছে। ভ্যালু অ্যাডেড প্রোডাক্ট তৈরি করা আদার দ্যান ম্যাংগো পাল্প ঐভাবে কিন্তু গড়ে উঠেনি এখানে। আমি কৃষকদের কাছে জিজ্ঞেস করেছি, তারা এগুলো জানে না, এটা বলেছে আর কি।”

যে কারণে আম জাতীয় পণ্য বছর জুড়ে পাওয়া যায় না_fororder_jingji1

কৃষি বিশেষজ্ঞ মঞ্জুরুল ইসলাম

কিন্তু সরকারি উদ্যোগ কিন্তু নতুন কোন উদ্যোক্তাও তো সৃষ্টি হচ্ছে না। কেন?

এক্ষেত্রে কৃষি বিশেষজ্ঞ মঞ্জুরুল ইসলাম মনে করেন সমস্যাটা মন-মানসিকতার। তিনি বলেন, “তারা যেভাবে ব্যবসা করতে চায়। ঐ যে মিনিমাম ইনভেস্টমেন্ট, ম্যাক্সিমাম প্রোফিট যেমন ম্যাংগো পাল্প। কিন্তু পাল্প থেকে বেড়িয়ে যে অন্যান্য প্রোডাক্টগুলো আছে সেগুলো করতে গেলে যে পরিমাণ ইনভেস্টমেন্ট এবং আমাদের গুড কোয়ালিটি ম্যাংগোগুলো ব্যবহার করা এটা আমি ইনভেস্টরদের মধ্যে দেখেছি বলে মনে হয় না। সরকারের পক্ষ থেকেও আমি এভাবে কোন উদ্যোগ নিতে দেখিনি। যেমন ডেএই করতে পারতো, ডেমোনস্ট্রেশন প্লট করার তারা কিন্তু সেটা করে নি।”

 

তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা মূলধান পাচ্ছেন না। রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট মনিরুজ্জামান মনির অভিযোগ, কাগজে কলমে উদ্যোক্তা তৈরির নানা প্রতিশ্রুতি থাকলেও অর্থের অভাবে ব্যবসা শুরু করতে পারছেন না অনেকেই।

যে কারণে আম জাতীয় পণ্য বছর জুড়ে পাওয়া যায় না_fororder_jingji2

মনিরুজ্জামান মনি, সভাপতি, রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স

 

এ ব্যবসায়ী বলেন, “আজকে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক আছে ঠিকই। কিন্তু নামে। রাজশাহী কৃষকরা পায় কিন্তু কোনটা পায়, ঐ বীজ বা মসলা তৈরিতে। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির জন্য টাকা দেয় না। মেইল প্রোবলেম এই জায়গাতে আর কি। লোন চাইলে ছিটকে ওঠে ব্যাংকাররা।”

 

কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আসাদুল্লাহ বলছেন, আমকে আন্তর্জাতিক বাজারে নিয়ে যেতে মান নির্ধারণী ল্যাব, প্যাকেজিং কারখানা স্থাপনসহ নানা মাত্রার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে এর জন্য স্থানীয় উদ্যোক্তা তৈরিতে তাদের কোন উদ্যোগ আছে কি?

যে কারণে আম জাতীয় পণ্য বছর জুড়ে পাওয়া যায় না_fororder_jingji3

মো. আসাদুল্লাহ, মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর

এ কর্মকর্তা বলেন, “এখনও আমরা এটা নিয়ে.... চিন্তা ভাবনা অবশ্যই আছে। মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় আমাদের ই দিচ্ছেন। কিন্তু আমরা তো আসলে এগ্রিকালচারের যারা আমাদের তো মেইন কাজটা থাকে প্রোডাকশনের সঙ্গে।”

 

চলতি বছরও ২৪ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার।

আজহার লিমন। চীন আন্তর্জাতিক বেতার। ঢাকা।