সাজিদ রাজু, ঢাকা, জুন ১৭: আগামী দুই তিন মাসের মধ্যে রাজশাহীর ফজলি আম পেতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক ভৌগলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্যের স্বীকৃতি। এর মাধ্যমে আগের ৯টি পণ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের ঝুলিতে উঠবে আরো একটি জিআই পণ্যের খেতাব। তালিকায় আছে দিনাজপুরের লিচুসহ আরো বেশ কিছু পণ্য।
খিরসাপাতি আম
বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত পেটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদফতরের রেজিস্ট্রার আব্দুস সাত্তার চীন আন্তর্জাতিক বেতারকে জানান, দেশকে বিদেশের মাটিতে ব্র্যান্ডিং করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এ কার্যক্রম শুরু করেছেন তারা। তিনি বলছিলেন, কোন একটি দেশের মাটি, পানি, আবহাওয়া এবং জনগোষ্ঠী যদি কোন একটি পণ্য উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে থাকে তাহলে সেটিকে ঐ দেশের ভৌগলিক কিংবা জি আই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কোন অঞ্চলের একটি পণ্য জিআই হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অর্থ এটি কেবল ওই নির্দিষ্ট অঞ্চলের পণ্য, অন্য কোথাও এটি খুব একটা উৎপন্ন হয় না বা হলেও তার গুণগতমানে পার্থক্য থাকে। জিআই পণ্য যে দেশ বা অঞ্চলে উৎপন্ন হয় সেই পণ্যের সম্পূর্ণ ব্যবসায়ীক মুনাফার মালিক হবে সে দেশ বা অঞ্চল। এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সেই পণ্যের সত্ত্ব অন্য কোন দেশ দাবি করতে পারবেনা।
তার মতে খিরসাপাতি আমের চাহিদা ইউরোপে ব্যাপক। এছাড়া সারা বিশ্বে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের কাছেও খুব জনপ্রিয়। তাই দেশীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক আম বিদেশে রফতানি হয়।
প্রশ্ন ছিলো এই সার্টিফিকেট অর্জন করায় চাষীদের কি লাভ? উত্তরে তিনি জানান, জিআই নিবন্ধন পাওয়া পণ্যে ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য সংযোজন সম্ভব। তার দাবি, এ বর্ধিত মূল্যের অংশীদার হবেন কৃষকও।
“ফল গবেষণা ইন্সটিটিউট জিআই সার্টিফিকেটটা নিয়েছে। যারা রফতানি করবে তারা যদি এই সার্টিফিকেট নেয় কিংবা ওদের গ্রাহক হয় তবে পণ্যের বা প্যাকেটের গায়ে জিআই হিসেবে উল্লেখ করবে। ওয়ার্ল্ড ইনটেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অরগানাইজেশন –ডাব্লিউআইপিও অনুমোদিত হওয়ায় এবং ওয়ার্ল্ড ট্রেড অরগানাইজেশন –ডাব্লিউটিও স্বীকৃত হওয়ায় জিআই পণ্য বিদেশে রফতানির ক্ষেত্রে ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য সংযোজন করা যায়। তাই উচ্চ মূল্যে বিক্রি করা যায়।”
মৌসুমী এ ফলের বর্তমান বাজার কেমন, দামই বা কেমন হচ্ছে?
কথা হয় চাপাইনবাবগঞ্জের আম বাগান মালিক মো. কাসেদ আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, নিজের ১৪-১৫ বিঘা জমিতে আমের বাগান তার। প্রতি বছর এখানে অন্য আমের পাাশাপাশি খিরসাপাতি আম ফলান ২ থেকে আড়াইশ’ মন। তার দাবি, রফতানির কোন তথ্য তারা পান না। ফলে বাজার দর অনুযায়ীই আম বিক্রি করতে বাধ্য হন তারা। জিআই পণ্য হিসেবে অতিরিক্ত কোন লাভের মুখ তারা দেখেন না।
“ আমাদের কাছ থেকে অল্প দামে কেনে। যারা বিদেশ পাঠায় তারাই টাকাটা বেশি পায়। এটা আমাদের বলে কি যে এটা আমরা বিদেশ পাঠাবো, অমুক করবো, তমুক করবো? বাজার বরাবর কিনে প্যাকিং করে বিদেশ পাঠায়।“
এ নিয়ে কথা হয় চাপাইনবাবগঞ্জ জেলা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর সভাপতি মোহাম্মদ এরফান আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, জিআই নিবন্ধন পাওয়ার পরপরই করোনার থাবায় প্রাতিষ্ঠানিক কোন সুফল মেলেনি আম রফতানির ক্ষেত্রে। তাই মাঠ পর্যায়ে কাজে আসছে না আমের জিআই স্বীকৃতি।
“বিদেশ তো দূরে থাক, বাংলাদেশেই বিক্রি করতে পারছে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে আম নামাতে হচ্ছে, বাজারে উঠাতে হচ্ছে। মার্কেট সীমিত সময়ের জন্য খোলা। জিআই নিবন্ধন পাওয়া গেছে আজ থেকে তিন বছর হলো, এরপর দুই সিজন লকডাউন। নিবন্ধনও হয়েছে, আমের উপর দুর্যোগ নেমে এসেছে।“
কিন্তু কেবলই কি করোনা সব সুযোগ নষ্টের জন্য দায়ী? বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও উন্নয়ন শিক্ষা ইন্সটিটিউটের পরিচালক ড. মো. সাইদুর রহমান মনে করেন, সরকারি দফতরগুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকলে নানা সমস্যা মোকাবিলা করেও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এসব জিআই পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার ধরা সম্ভব।
“আমরা পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এখনো পৌছাতে পারিনি। তাই জিআই পণ্যের মূল্য সংযোজনের পদ্ধতিতেও পরিপূর্ণতা আসেনি। কেউ যেন বঞ্চিত না হয়, কেউ যেন ইচ্ছে করে কাউকে বঞ্চিত করতে না পারে তার জন্য একটা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সেটা হলে আমরা আগেই জানবো যে উৎপাদনকারী কতোটুকু পাবে, মধ্যস্বত্বভোগী কতোটুকু পাবে, রফতানিকারক কতোটুকু পাবে সেটাও চিহ্নিত হয়ে যাবে।“
ড. মো. সাইদুর রহমান
২০১৪ সালে প্রথম বাংলাদেশের জি আই পণ্যের জন্য আবেদন করে, ২০১৬ সালে জামদানি জি আই পন্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এরপর একে একে ইলিশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাতি আম ও সবশেষে মসলিন জি আই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।