চীনের ডিজিটাল ইউয়ান— সম্ভাবনা ও কিছু প্রশ্ন
2021-06-11 18:08:54

সংবাদ পর্যালোচনা:

 

বর্তমান বিশ্বে ডিজিটাল মুদ্রার ধারণাটি খুব নতুন নয়। কিন্তু চীনের ডিজিটাল ইউয়ান এই জগতে একটি শক্তিশালী ঢেউ তুলেছে। চীনের প্রতিদ্বন্দ্বীরা একে হুমকি হিসেবে দেখছে। তবে, সাধারণ ব্যবহারকারী ও আধিপত্যবাদীদের চাপে থাকা দেশগুলোর অর্থনীতিবিদরা ডিজিটাল ইউয়ানকে সম্ভাবনা হিসাবে মনে করছে। ডিজিটাল মুদ্রার বাস্তবতা ও সংশ্লিষ্ট কিছু প্রশ্নের জবাব থাকছে আজকের সংবাদ পর্যালোচনায়।

 

হাজার বছর আগে, যখন ধাতব মুদ্রার প্রচলন ছিল, চীন তখন কাগজের মুদ্রা আবিষ্কার করেছিল। এখন চীন সরকার আমেরিকার শক্তির স্তম্ভকে কাঁপিয়ে দিতে সক্ষম এমন মুদ্রা চালু করতে যাচ্ছে। এটিই হলো ডিজিটাল ইউয়ান বা ই-সিএনওয়াই। এই ডিজিটাল ইউয়ান নিয়ে অনেকেই কিছুটা ধাঁধাঁর মধ্যে রয়েছেন। কারণ, বর্তমান বিশ্বে ইতোমধ্যে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কারেন্সি ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন- ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, মার্কিন অ্যাপল পে এবং চীনের আলি পে উইচ্যাট পে অথবা বাংলাদেশের বিকাশ, রকেট, নগদ, এমক্যাশ ইত্যাদি। এগুলো মূলত ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে তৃতীয় পক্ষের অ্যাপলিকেশনের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের পদ্ধতি। বাস্তবিক আর্থিক লেনদেন নয়।

 

তাহলে ডিজিটাল মুদ্রা বা ই-সিএনওয়াই এর ধারণাটি কেমন? সহজ উত্তর হলো- এটি ঠিক নগদ টাকা ব্যবহারের মতো। অর্থাৎ, যে টাকা আপনার ওয়ালেট বা হাতে থাকে, সেই টাকার যান্ত্রিক ফরমেট আপনারই মোবাইল ওয়ালেটের মধ্যে থাকবে। কাগজের মুদ্রা বিনিময় করে আপনি যেমন পণ্য বা সেবা কিনে থাকেন, মোবাইল ওয়ালেটে থাকা টাকা দিয়ে আপনি সেই সেবাটি পাবেন। এক্ষেত্রে ওপরে উল্লেখিত কোনো ধরনের ‘থার্ড পার্টি অ্যাপ’ ব্যবহার করতে হবে না ও সার্ভিস চার্জও দিতে হবে না। লেনদেন চেইনে থাকবে ব্যাংক ও গ্রাহক।

প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে চীন ইতিমধ্যে গোটা দেশে পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসাবে দুইশ মিলিয়ন ডিজিটাল ইউয়ান (৩০.৭  মিলিয়ন মার্কিন ডলার) বিতরণ করেছে। চীনের ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম জায়ান্ট আলিবাবা, টেনসেন্ট, জেডি ও বাইদু সফলভাবে এর ব্যবহার করেছে। খবরে বলা হয়, আসন্ন শীতকালীন অলিম্পিকের সময় বিদেশিরা চীনের ডিজিটাল ইউয়ান ব্যবহারের সুযোগ পাবেন।

 

ইতোমধ্যে আধুনিক বিশ্বে ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার শুরু হয়েছে। যেমন- বিটকয়েন, লাইটকয়েন, ইথেরিয়াম ইত্যাদি। যা প্রচলিত আর্থিক ব্যবস্থার চেয়ে ভিন্ন ধাঁচের। এর ওপর কোনো দেশ বা রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের যেমন নিয়ন্ত্রণ নেই, তেমনি এর ব্যবহার ও লেনদেন প্রক্রিয়া সাধারণ মানুষের জন্য জটিল।

অপরদিকে ডিজিটাল মুদ্রা সরাসরি দেশের মুদ্রাব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত এবং দেশের সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে। আর এখানেই একটি প্রশ্ন করা হয়। তা হলো- যেহেতু এই মুদ্রার লেনদেন ট্র্যাক করা যায়, সেহেতু এর ওপর নজরদারি কেউ কেউ পছন্দ করছেন না। কিন্তু বাস্তবতা হলো- বর্তমানের যেসব ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড বা থার্ড পার্টি অ্যাপ দিয়ে লেনদেন করা হয়, তা কি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টির আড়ালে থাকে? অবশ্যই না। সব লেনদেনই ট্র্যাক করা যায় এবং তা গোপনীয় নয়। তাই নতুন করে নজরদারির প্রশ্ন অর্থহীন।
দ্বিতীয় বিষয় হলো- যারা নজরদারির অভিযোগ তুলছেন, তাদের আশঙ্কার মূল কারণ আসলে কী?

 

চীন ২০১৪ সালে এই সার্বভৌম ডিজিটাল মুদ্রার ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করে। চীনের ডিজিটাল ইউয়ান দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এটি চীন সরকারের অর্থনৈতিক প্রযুক্তি ব্যবস্থা এবং জনগণের লেনদেনকে আরও স্বচ্ছ ও নির্ভুল করে তুলবে, জাল টাকার কবল থেকে রক্ষা করবে এবং সার্বিকভাবে ‘পেপারলেস কমিউনিটি’ গঠনে অনেকদূর এগিয়ে নেবে।

উপরন্তু, ডিজিটাল ইউয়ান ব্যবহার করার কারণে ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো অদৃশ্য লেনদেন বা কালো টাকা পাচারের সুযোগ একেবারেই থাকবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।

 

বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কাগজের ইউয়ানকে ডিজিটালাইজেশন করার পর এক দেশ থেকে অন্য দেশে পণ্য কেনায় আর ডলারের ওপর নির্ভর করতে হবে না। আর এখানেই দ্বিতীয় প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়। তাহলে ডিজিটাল ইউয়ান কি মার্কিন ডলারের জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে যাচ্ছে?

মূলত এই প্রশ্নের মধ্যেই আছে শুভঙ্করের ফাঁকি। ডিজিটাল ইউয়ান মার্কিন ডলারের বিরুদ্ধে হুমকি নয় বরং ডিজিটাল ইউয়ান বিশ্বে মার্কিন ডলারের একচেটিয়া আধিপত্যের পথ রুখে দেবে নিঃসন্দেহে!

 

 

ডিজিটাল ইউয়ানের সম্ভাবনা দরিদ্র দেশের জন্যও আন্তর্জাতিক আর্থিক সহযোগিতার নতুন বিকল্প পথ দেখিয়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত একতরফা নিষেধাজ্ঞাকে নমনীয় করতে সক্ষম হবে। এক কথায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশের ওপর অবৈধ নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পথ থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হবে।

ডিজিটাল ইউয়ানের এসব সুযোগ-সম্ভাবনা প্রকৃত অবস্থা দেখার জন্য কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।

 

মোহাম্মদ তৌহিদ

বার্তা সম্পাদক, সিএমজি বাংলা বিভাগ।