বাজেটে ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাঁধাগ্রস্থ করবে: ড. সালেহ উদ্দীন আহমেদ
2021-06-11 18:51:07

আজহার লিমন, ঢাকা: নতুন অর্থবছরের বাজেটকে সামগ্রিক ও সার্বজনীন বলছেন না অর্থনীতিবিদরা। তারা মনে করেন, ব্যবসায়ীদের জন্য কিছু সুযোগ সুবিধা রাখা হলেও সাধারণ ও করোনার অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা নেই। এছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংস্কারে নতুন কোন উদ্যোগ নেই বলেও মনে করেন তারা।

মোটাদাগে বলতে গেলে, নতুন অর্থবছরের বাজেটে নতুন করে সুযোগ সুবিধা যোগ করা হয়েছে ব্যবসায়ীদের জন্য। জীবন ও জীবিকার জন্য খ্যাত এই বাজেটে অর্থনীতির চাকা ঘুরাতে কমানো হয়েছে করপোরেট কর, ব্যবসা চালাতে রাখা হয়েছে প্রণোদনা বা সহজ ঋণের সুযোগ। বাজেটে বিবেচনায় রাখা হয়েছে মেইড ইন বাংলাদেশ পণ্যের প্রচার প্রসারের দিকটিও। তবে কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে কৃষি উপকরণের ওপর মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট প্রত্যাহার। কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন বা কৃষির বাণিজ্যকীকরণ ও আধুনিকায়নে রাখা হয়েছে উৎপাদন বা ব্যবসায়ীও পর্যায়েও ভ্যাট অব্যাহতির সুযোগ। তৃণমূলকে এগিয়ে আনতে বাজেট এই দিকটিকে সম্ভাবনাময় হিসেবেই দেখছে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. এ সাত্তার মণ্ডল। এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, কৃষির সার্বিক বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে এর সুফল পাওয়া সম্ভব। তবে তার জন্য প্রান্তিক এসব উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ করতে হবে ঋণের শর্ত, স্থিতিশীল রাখতে হবে কৃষি বাজার ব্যবস্থাপনা।

তিনি বলেন, ‍“আগামী দিনের কৃষি একটি বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। তাদের নীতি সহায়তা দেওয়ার জন্য বা তাদের যেখানে আর্থিক পূজিঁ যেখানে দরকার যেখানে ঋণ দিতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, তারা কি সেটা ঠিকভাবে পাবে। এটা সহজতর করতে হবে।”

বাজেটে ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাঁধাগ্রস্থ করবে: ড. সালেহ উদ্দীন আহমেদ_fororder_e2

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. এ সাত্তার মণ্ডল

স্বাস্থ্যখাত নিয়ে অনেক আলোচনা থাকলেও নতুন বাজেটে স্বাস্থ্যে বরাদ্দ গতানুগতিক জিডিপির এক শতাংশের মধ্যেই ঘুরপাক খেয়েছে। বাজেটের আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ খাতে বরাদ্দও কিছু বেড়েছে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. নাসরিন সুলতানা মনে করেন, বরাদ্দ বাড়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাতভিত্তিক প্রয়োজন মূল্যায়ন ও গবেষণা। বিদায়ী অর্থবছরে স্বাস্থ্য গবেষণার মত জরুরি গুরুত্বপূর্ণ খাতের অর্থের ১টাকাও ব্যবহার না করার কারণ, আলতান্ত্রিক জটিলতা ও অদক্ষতা, মনে করেন এই বিশ্লেষক।

তিনি বরেণ, “যারা নীতি নির্ধারণ করছে তারা আসলে জানে না রুট পর্যায়ে আসলে প্রয়োজনগুলো কী কী? অন্যদিকে যারা রুট পর্যায়ে কাজ করছে তারা তাদের ডিসিশনগুলো উপরে জানাতেও পারছে না। তাদের মধ্যে একটা দূরত্ব আছে একটা সমন্বয়হীনতা আছে।”

বাজেটে ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাঁধাগ্রস্থ করবে: ড. সালেহ উদ্দীন আহমেদ_fororder_e3

স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. নাসরিন সুলতানা

কিন্তু এতসব আলোচনা ছাপিয়ে বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে, দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দিয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে। বাজেট হিসেবেই অর্থমন্ত্রী দেখিয়েছেন  সব দিক লক্ষ্য পূরণ হলে, রাজস্বসহ আয় হতে পারে সর্বোচ্চ ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। ফলে একইসঙ্গে বাজেটটি সর্বকালের সবচেয়ে বড় ঘাটতির বাজেট। এই ঘাটতি পোষাতে বিদেশি ঋণের কথা বলা হলেও ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র মত আর্থিক খাতগুলো থেকে এবারও সরকার ঋণ নেবে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। এটি দেশের অর্থনীতির ওপর কেমন প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহ উদ্দীন আহমেদ মনে করেন, বাজেটের এই ব্যাংক নির্ভরতা নতুন উদ্যোক্তা তৈরি কিংবা বেসরকারিখাত সম্প্রসারণের সম্ভাবনার জন্য নেতিবাচিক প্রভাব ফেলবে।

তিনি বলেন, “ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়াটা ব্যক্তিগত আমি পছন্দ করি না। কারণ এই ৭৬ হাজার কোটি নেওয়া মানে প্রাইভেট সেক্টরের ওপর চাপ পড়বে। ব্যাংকগুলো চালাক, তারা ঋণ দেওয়ার ঝক্কি ঝামেলাগুলো চায় না। আবার সরকারি সুদের সুবিধা ও নিরাপত্তাও বেশি। মানে কিছু না করেই আপনি লাভটা পাচ্ছেন। এজন্য তারা ওদিকে যেতে চায়, কিন্তু এর জন্য প্রাইভেট সেক্টরগুলো সাফার করবে, প্রাইভেট অর্গানাইজেশন বাড়বে না। আর এই বেসরকারি খাত না বাড়লে বিনিয়োগ হবে না অপরদিকে দেশেরও প্রবৃদ্ধি হবে না।”

 

তাহলে তো জিপিডি লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হবে না?

“এটা চ্যালেঞ্জ হবে। ৭ দশমিক ২ শতাংশ ধরেছে যেটা। ওয়াল্ড ব্যাংকও ৫ শতাংশের ঘরে বলেছে। কিন্তু আমার মতে এটা ৬ দশমিকক ৫ ও যদি অর্জন করতে পারে সেটা ভালো। আমার মনে হয় সেটা কঠিন হবে না। ছয় সাড়ে ছয় যদি করতে পারে সেটাই আমাদের জন্য অনেক ভালো। বেশি উচ্চ প্রবৃদ্ধির আমাদের দরকার নেই। আমাদের দরকার হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং যারা দরিদ্র লোক আছে তাদের কর্মসংস্থান তাদের আয়ের ব্যবস্থা করা।”

 

 

বাজেটে ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাঁধাগ্রস্থ করবে: ড. সালেহ উদ্দীন আহমেদ_fororder_e4

সাবেক গর্ভনর ড. সালেহ উদ্দীন আহমেদ

 

তাহলে সামগ্রিকভাবে কি লক্ষ্য পূরণ সম্ভব?

 

এই অর্থনীতির বিশ্লেষক মনে করেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতগুলোর জন্য প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থাপনা সহায়ক না হওয়ার কারণে তাদের জন্য ঋণ প্রণোদনা কাজে আসছে না। এক্ষেত্রে ব্যাংক বহির্ভূত প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগানোর দাবি জানান এই বিশ্লেষক।

বাজেটে কোভিডের মত নাজুক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও নতুন গরীব হওয়া বা চাকরি হারানো আড়াই কোটি মানুষের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা দেখছেন না বিশ্লেষকরা। সব মিলিয়ে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ, বিদেশি ঋণ সহায়তা প্রাপ্তি একইসঙ্গে সরকারি ঋণের আধিক্যের কারণে এ বাজেট কতটা বাস্তবায়িত হবে তা নিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জ দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।