সম্প্রতি চীনের সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ভিডিওতে দেখা যায়, সিছুয়ান প্রদেশের তালিয়াংশান পাহাড়াঞ্চলের সহকারী শিক্ষক সেখান থেকে বিদায় নিচ্ছেন এবং শিক্ষার্থীরা তার গাড়ির পিছনে পিছনে দৌড়াচ্ছে আর কাঁদছে। দৃশ্যটি অনেক নেটিজেনকে মুগ্ধ করেছে। আজকের বিদ্যাবার্তায় আমরা এ শিক্ষকের গল্প তুলে ধরবো এবং শিশু-কিশোরদের শৃঙ্খলার চেতনা নিয়ে কিছু আলোচনা করবো।
চীনের সিছুয়ান প্রদেশের তালিয়াংশান পাহাড়াঞ্চল অতীতকালে চরম দরিদ্র ছিল, স্থানীয় ক্লিফ গ্রামের গল্প গত বছরের দারিদ্র্যবিমোচন কার্যক্রমের সময় বেশ আলোচিত হয়েছে। স্থানীয় বাচ্চারা প্রতিদিন উঁচু লতার সিড়ি বেয়ে পাহাড় থেকে নেমে স্কুলে যেত। যাওয়া-আসার পথ ছিল অনেক বিপজ্জনক। তালিয়াংশানে আসা সহায়ক শিক্ষিকার নাম হ্য ইয়ু ছিং, তাঁর বয়স ২৭ বছর। পাহাড়াঞ্চলে এসে শিক্ষকতার কাজ নেওয়ার সঙ্গে তার একজন বন্ধুর মৃত্যুর সম্পর্ক রয়েছে।
শিক্ষিকা হ্য বলেন, “আমি নিজেই চরম দরিদ্র গ্রামাঞ্চলে জন্মগ্রহণ করি। তাই গ্রামাঞ্চলের বাচ্চাদের দেখলে আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে।” আর সেজন্যই গ্রামাঞ্চলে শিক্ষকতার কাজ নিতে তিনি বরাবরই আগ্রহী ছিলেন। ২০১৬ সালে যখন তিনি তালিয়াংশানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছিলেন, তখন চিয়াংসু প্রদেশের আরেকজন স্বেচ্ছাসেবক চাং সিয়াও লিনের সাথে তার পরিচিত হয়। দু’জন কম সময়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হন। তবে, ২০১৮ সালে যখন হ্য বেইজিংয়ের চলচ্চিত্র একাডেমির পরিচালনা বিভাগে পড়াশোনা করছিলেন, তখন বন্ধু চাং লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। এ সম্পর্কে শিক্ষক হ্য বলেন, ‘যখন আমি হাসপাতালে সিয়াওলিনকে দেখতে যাই, তখন তাঁকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে পড়াশোনা শেষ করে তালিয়াংশানে যাই। আমি সেখানে সিয়াওলিনের মতো সেখানকার জীবনই যাপন করেছি।’
২০১৪ সাল থেকে জনাব চাং সিয়াও লিন তালিয়াংশান পাহাড়াঞ্চলের বাচ্চাদের জন্য বিভিন্ন শিক্ষাসামগ্রী পাঠাতে থাকেন। তিনি ব্যক্তিগত অর্থায়নে সেখানে স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগও নেন। বিভিন্ন অঞ্চলের দাতাদের সহায়তা এবং স্থানীয় শিক্ষা বিভাগের যৌথ উদ্যোগে ২০২০ সাল পর্যন্ত চাং মোট ৩৯টি স্কুলের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেন।
২০২০ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে চাং সিয়াও লিন শিক্ষক হ্যকে একটি মেসেজ পাঠান। ম্যাসেজে তিনি কৌতুক করে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমাকে নিয়ে চলচ্চিত্রের শুটিং কবে হবে?’ পরের দিনই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এ খবর জেনে অনেক কষ্ট পান শিক্ষক হ্য। মার্চ মাসে তিনি চাংয়ের স্ত্রী’র সাথে তালিয়াংশানে যান এবং সেখানে প্রামাণ্যচিত্রের শুটিংয়ের কাজও শুরু করেন।
২০২০ সালের অগাস্ট মাসে শুটিং শেষ করে তিনি তালিয়াংশানে সহকারী শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। অক্টোবর মাসের শেষ দিকে শিক্ষক হ্য চাওচুয়ে জেলার তেবুল্য উপজেলার একটি স্কুলে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন। তিনি চীনা ভাষা, শিল্পকলা, সংগীত ও নৃত্যসহ বিভিন্ন ক্লাস নিতে থাকেন।
গ্রামাঞ্চলে শিক্ষকতার জীবনের ঝামেলা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার জন্য নিয়মিত স্নান করতে না-পারা কষ্টের ব্যাপার। এখনও এতে অভ্যস্ত হইনি।’ তবে এখানে সহকারী শিক্ষকের জীবন তাঁর জন্য শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা। প্রতিদিন স্কুলের জীবন তিনি ভালোবাসা ও মুগ্ধতার সাথে কাটান।
এ অভিজ্ঞতা স্মরণ করে শিক্ষক হ্য বলেন, ‘একবার আমি আরেকজন শিক্ষকের সাথে শিক্ষার্থীদের বাড়ি পরিদর্শনে যাই। এক পরিবার থেকে অন্য পরিবারে ঘুরতে থাকি। একজন ছাত্র একটি মুরগী আমাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আমরা গ্রহণ করিনি। পরের দিন সেই শিক্ষার্থী একটা বাচ্চা মুরগী নিয়ে স্কুলে আসে। আরেকটি ছেলে এক প্যাকেট আলু বহন করে নিয়ে আসে। এটা আমাদের মুগ্ধ করে। শিক্ষার্থীরা বলে যে, তারা শিক্ষকের জন্য উপহার নিয়ে এসেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আরেকবার ই জাতির উত্সবের সময় স্থানীয় ছাত্রছাত্রীরা আমার বাড়িতে আসে। তাদের মধ্যে দু’জন ভাই-বোন বড় সাইজের মাংস পিণ্ড নিয়ে আসে এবং আমাকে উপহার হিসেবে দিতে চায়। আমি গ্রহণ করতে অস্বীকার করি। কিন্তু ওরা নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত আমি মাংস গ্রহণ করি এবং তারা হাসিমুখে স্কুল থেকে বাসায় ফিরে যায়। তাদের মা স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখে মিষ্টি করে হেসেছেন। আমার জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের আন্তরিকতা অত্যন্ত মূল্যবান ও মুগ্ধকর ব্যাপার। সেখানকার গ্রামবাসীদের জীবন সমৃদ্ধ নয়, তারা ধনীও নয়। কিন্তু তারা তাদের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জিনিস অতিথি বা শিক্ষককে উপহার হিসেবে দেয়। এটা আমার মনে গভীর দাগ কেটেছে।’
সহকারী শিক্ষকতার কাজ কয়েক মাস পর শেষ হয়। পাহাড়াঞ্চলের শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিদায় নিতে হবে শিক্ষক হ্য-কে। বিদায়ের দিন ছিল শনিবার। সে দিন স্কুলে সাপ্তাহিক ছুটি। কিন্তু সকাল সাড়ে সাতটা থেকে ছাত্রছাত্রীরা ও স্কুলের অন্য শিক্ষকরা স্কুলে গিয়ে হ্যকে বিদায় জানাতে অপেক্ষা করতে থাকেন। অনেকে আসে দেড় ঘন্টার পথ হেঁটে। স্কুলের সামনে সবার কাছ থেকে বিদায় নেন হ্য। তবে ছাত্রছাত্রীরা মুখে বিদায়ের কথা বললেও, হ্য’র গাড়ির পিছনে হাঁটা শুরু করে। কয়েক বার গাড়ি থামিয়ে সবার কাছ থেকে বার বার বিদায় নেন হ্য। তিনি বাচ্চাদের কান্নাকাটি না-করে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে উত্সাহ দেন। অনেক বাচ্চা উচ্চস্বরে শিক্ষক হ্যকে বিদায় জানায়। তখনকার স্মৃতি স্মরণ করে হ্য মুগ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘সেই সময় আমি আসলে যেতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু কাজের জন্য যেতে হয়েছে। তাই দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়েই সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে।’
সহকারী শিক্ষকের কাজ সম্পর্কে হ্য মনে করেন, তা শুধু অবদান রাখার ব্যাপার নয়, বরং নিজের জীবনে নতুন অনুপ্রেরণা বয়ে আনা। তিনি বাচ্চাদের বলতে চান, ‘তোমরা খুবই মেধাবী ও সেরা বাচ্চা। প্রতিদিন পরিশ্রম করে পড়াশোনা করলে অবশ্যই সুন্দর জীবন কাটাতে সক্ষম হবে।’ তালিয়াংশান থেকে কুয়াংতুং প্রদেশে ফিরে আসেন তিনি এবং চলতি বছরের মে মাসে আরেক বার তালিয়াংশানে যান। স্থানীয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তার আবার দেখা হয়।
চলচ্চিত্রের পরিচালক হিসেবে তিনি নিয়মিত ভিডিও শুটিং করেন। তাই তালিয়াংশান আসার ভিডিও অনলাইনে পোস্ট করেন। পরে তা ভাইরাস হয়। এ সম্পর্কে হ্য বলেন, ‘কখনও ভাবিনি আমার ভিডিও এতো বেশি মানুষের মনোযোগ পাবে। আমি এখানকার বাচ্চাদের বেশ গুরুত্ব দেই। প্রতিবছর এখানে ফিরে এসে তাদের ক্লাস নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি।’
বর্তমানে একটি সহকারী শিক্ষকদের দাতব্য প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে চেষ্টা করছেন হ্য ইয়ু ছিং। তার মাধ্যমে পাহাড়াঞ্চলের আরো বেশি বাচ্চা সুন্দর জীবন পাবে বলে তিনি আশা করেন। পাশাপাশি তিনি ইতিবাচক ও অনুপ্রেরণাদায়ক ভিডিও তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছে।
যেভাবে বাচ্চাকে দায়িত্বশীল হবার প্রশিক্ষণ দেবেন
বাচ্চাদের চরিত্রগঠন ও ভালো অভ্যাস গড়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া বিভিন্ন দেশের পিতামাতাদের জন্য চ্যালেঞ্জ বটে। একজন সেরা ও শ্রেষ্ঠ মানুষ হতে চাইলে নিজের দায়িত্ব পালন করা বা নিজের সিদ্ধান্তের ফল মাথা পেতে নেওয়ার মতো মনোভাব গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্ন হচ্ছে: কিভাবে বাচ্চাদের দায়িত্বশীল হতে প্রশিক্ষণ দেবেন? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাচ্চাকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, নিজের কাজ নিজেকেই করতে হবে। পড়াশোনা হোক, স্বাস্থ্যসচেতনতা হোক, বাচ্চাদের বুঝতে হবে যে, তাদের নিজেদের আচরণের ফল তাদেরকেই ভোগ করতে হবে।
বাচ্চাদের ছোটবেলায়, বিশেষ করে ৬ বছর বয়সের আগে, খাওয়া-থাকাসহ বিভিন্ন কাজে বড়দের যত্ন প্রয়োজন। তবে, ধীরে ধীরে যখন বয়স বাড়ে, তখন তাদেরকে নিজেদের দায়িত্ব নিজেরকেই বহন করতে দিতে হবে। যেমন, নিজে খাবার খাওয়া, কাপড়চোপড় পরা, স্কুলের ব্যাগ গুছিয়ে নেওয়া, ইত্যাদি কাজ বাচ্চাদেরকে করতে দিতে হবে। অনেক পিতামাতা বাচ্চাদের ধীরগতির কাজ সহ্য করে না। দ্রুত কাজ শেষ করতে বাচ্চাদের অতিরিক্ত সহায়তা দিয়ে থাকেন। এতে বাচ্চাদের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার আগ্রহ কমে যায়।
এ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলেন, সর্বপ্রথমে পিতামাতার উচিত সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব বাচ্চাকে পালন করতে দেওয়া। যেমন, ধীরগতিতে হোমওয়ার্ক করতে দিতে হবে। বাচ্চাদের মানসিক অবস্থার কথা ভাবতে হবে। বাচ্চাকে এক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা ও উত্সাহ দিতে হবে। বাচ্চার ধীরগতিতে হোমওয়ার্ক পিতামাতার সবচেয়ে উদ্বেগের ব্যাপার। অনেক বাচ্চা মনে করে, ধীরগতিতে হোমওয়ার্ক করলে পিতামাতা অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপ দেবে না! তাই এ সমস্যার সমাধানে বাচ্চাদের দৃষ্টিতে বিষয়টা ভাবতে হবে। যেমন, তাদের বলতে হবে যে, দ্রুতগতিতে হোমওয়ার্ক শেষ হলে খেলার সময় দেওয়া হবে, ইত্যাদি। যদি বাচ্চা খেলায় বেশি আগ্রহী হয়, তাহলে সে নিজেই দ্রুতগতিতে হোমওয়ার্ক শেষ করতে চেষ্টা করবে।
আরেকটি বিষয় অতি গুরুত্বপূর্ণ, আর তা হল: ভুল কাজ করলে নিজেকেই তার ফল ভোগ করতে হবে—এই ধারণা বাচ্চাদের মনে গেঁথে দিতে হবে। কথায় কথায় শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বাচ্চারা নিয়মিত কোনো-না-কোনো ভুল আচরণ করে বা দুষ্টুমি করে। পিতামাতার উচিত এতে রাগ না করা। কথায় কথায় রেগে যাওয়া কোনো ভালো কাজ নয়। বাচ্চাদেরকে বুঝিয়ে বলতে হবে যে, ভুল করলে তার জন্য নেতিবাচক ফল ভোগ করতে হয়। এই বোঝানোটা কার্যকর। যেমন, হোমওয়ার্ক করতে না চাইলে, তাদের কখনও কখনও হোমওয়ার্ক না-করতে দেওয়া উচিত। কারণ, পরের দিনি স্কুলে টিচারের কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। এতে বাচ্চা বুঝতে পারবে যে, হোমওয়ার্ক করা জরুরি।
আরেকটি ব্যাপার অতি গুরুত্বপূর্ণ, আর তা হল: সহমর্মিতা। বাচ্চাদের অবস্থান থেকে তাদের আচরণ বিচার করার চেষ্টা করতে হবে। বাচ্চারা কীভাবে চিন্তা করে, কেন একটা বিশেষ কাজের প্রতি আগ্রহ দেখায় ও অন্য কাজের প্রতি আগ্রহ দেখায় না, কেন মাঝেমাঝে তারা অপছন্দনীয় কাজ করে—তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। এভাবে বাচ্চাদের সঙ্গে ভাব বিনিময় করা ও তাদেরকে বোঝা সহজতর হবে।
মোদ্দাকথা, দায়িত্বশীল চরিত্র গঠন একদিনের কাজ নয়, তা প্রতিদিনের প্রশিক্ষণ ও চর্চার ব্যাপার। বাচ্চা বড় হওয়ার প্রক্রিয়ায় বাবা-মাও নতুন নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। তাই বাচ্চাদের দুর্বলতা ও সবলতা বিচার করে তাদের সঙ্গে সঠিক আচরণ করা পিতামাতার জন্যও চ্যালেঞ্জ বটে। পিতামাতাকেও এ প্রক্রিয়ায় অনেককিছু শিখতে হবে।
সুপ্রিয় বন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা এখানে শেষ হয়ে এলো। আমাদের অনুষ্ঠান যারা মিস করেছেন, তারা আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন। ওয়েবসাইট ঠিকানা www.bengali.cri.cn,ফেসবুকে CRIbangla মাধ্যমে চীন ও বিশ্ব সম্পর্কে আরও অনেককিছু জানতে পারেন। তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন, আগামী সপ্তাহে আবার কথা হবে,যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)