ভূমিদাস বিয়ানছুং-এর জীবনের নতুন লক্ষ্য
2021-06-11 19:26:26

ভূমিদাস বিয়ানছুং-এর জীবনের নতুন লক্ষ্য

চীনের তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের চুংবা জেলাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গড়ে পাঁচ হাজার মিটারেরও বেশি উঁচুতে অবস্থিত। জুন মাস হলেও মালভূমিতে ঠান্ডা বাতাস বইছে।  

তারা খোলা জায়গাকে ক্লাসরুম হিসেবে ব্যবহার করেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে ৭১ বছর বয়সী তিব্বতি মানুষ বিয়ানছুং ঠান্ডা বাতাসে বসে সবার কাছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ও তিব্বতের মুক্তির ইতিহাস বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, পশুপালন অঞ্চলের অবস্থা জরাজীর্ণ। সবাই ঘাসে বসে গল্প শুনতে থাকে।

ভূমিদাস বিয়ানছুং-এর জীবনের নতুন লক্ষ্য_fororder_bian1

সাত বছর ধরে সরকারি সংস্থা, গ্রাম ও থানা, স্কুলসহ বিভিন্ন স্থানে বৃদ্ধ বিয়ানছুং তিব্বতের মুক্তির ইতিহাস তুলে ধরেছেন।

তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। এখন তিনি একজন অভিজ্ঞ ও পুরানো সিপিসি সদস্য, নতুন যুগ শুরু হলে ইতিহাসের সেই সংগ্রামমুখর দিনের কথা ভোলা যায় না।

২০১৪ সালে বিয়ানছুং স্বেচ্ছায় একটি প্রচার দলের সদস্য হন। দলটি পুরো জেলায় মুক্তির ইতিহাস তুলে ধরেছেন। এই কার্যক্রমের আওতায় পুরো চুংবা জেলার ১৩টি থানার ৫৮টি গ্রামে গিয়েছেন তিনি।

 

একটি হ্যান্ডব্যাগ, একটি মোটরসাইকেল, বিভিন্ন সার্টিফিকেট রাখার লোহার বাক্স- এটাই হল তাঁর সরঞ্জাম। তিনি আঙ্গুল নিজের মাথার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, আসলে সব গল্প আমার মাথায় জমা রয়েছে। মুক্তির আগে তাঁদের জীবন ছিল ভীষণ কষ্টের।

বিয়ানছুং বলেন, কমিউনিস্ট পার্টি আমাদের সবাইকে নতুন জীবন দিয়েছে।

জন্মের পর থেকে বিয়ানছুং ভূমিদাসের পরিচয় পান। নয় বছর বয়সে সেই দুঃস্বপ্ন ভেঙে যায়। এর আগে তাঁর পরিবারের সদস্যদের পরার পর্যাপ্ত কাপড় ছিল না, পর্যাপ্ত খাবারও ছিল না। জমিদার তাদের কাজে অসন্তুষ্ট হলে মারধোর করতো।

ছোটবেলার সেই স্মৃতি বিয়ানছুং কখনই ভুলে যান নি। প্রতিবার সবার কাছে সেই ইতিহাস তুলে ধরেন, তাঁর মন বেদনায় ভরে ওঠে।

 

১৯৫৯ সালে তিব্বতে গণতান্ত্রিক মুক্তি বাস্তবায়িত হয়। বিয়ানছুং-এর পরিবার গরু, ছাগলসহ বিভিন্ন পশু লালনপালন করে। তাদের জীবনও ধীরে ধীরে ভালো হয়ে ওঠে। নতুন জীবন পাওয়া বিয়ানছুং পরে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে একজন সেনা হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি ১৯৭৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির একজন সদস্য হিসেবে বাহিনীতে যোগ দেন এবং সীমান্ত এলাকায় দেশের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

 

১০ বছর বাহিনীতে কাজ করেছেন বিয়ানছুং। তিনি সহযোদ্ধার সঙ্গে চীনা ভাষা বা ম্যান্ডারিন ভাষা শিখেছেন। তারপর তিনি বাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর ব্যাংকে চাকরি নেন।

তিনি ব্যাংক থেকেও অবসর নিয়েছেন ২০ বছর আগে। তবে বিয়ানছুং নিজের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে চান। তিনি সবসময় কমিউনিস্ট পার্টি ও ইতিহাস সম্পর্কিত বই কিনেন, তারপর নিজেই যা শিখেছেন, তা পশুপালন অঞ্চলের জনগণের কাছে তুলে ধরেন। সম্প্রতি তিনি করোনাভাইরাস প্রতিরোধের তথ্য বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষকে শেখানোর কাজ করেছেন।

 

তিনি বলেন, তাঁর বয়স ৭০ বছরের বেশি হলেও তিনি পরিশ্রম করতে পারেন। যেখানে তাঁর প্রয়োজন হয়, সেখানে তিনি ছুটে যান। তিনি জানান, সিপিসি’র সদস্য হলে অবশ্যই জনগণের জন্য কাজ করতে হয়।

ভূমিদাস বিয়ানছুং-এর জীবনের নতুন লক্ষ্য_fororder_bian2

বিয়ানছুং সাংবাদিককে বলেন, সেনাবাহিনীতে থাকার সময় তিনি উপলব্ধি করেছেন যে, সীমান্ত রক্ষা করা দেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পরে স্থানীয় লোকজনের উদ্যোগে মোটরসাইকেল টহলদল গঠন করেছেন। অবসরের পর তিনি দলের প্রধান হিসেবে কৃষকদের নিয়ে সীমান্তে টহল দিতেন। প্রতি বছর ৪০ বারেরও বেশি তিনি সীমান্তে টহল দিয়েছেন।

 

একবার টহল দিতে ১৫০ কিলোমিটারেরও বেশি দূর যেতে হয়। দশ/বারো বছর ধরে বিয়ানছুং এক লাখেরও বেশি কিলোমিটার পথ টহল দিয়েছেন। তিনি ৬টি মোটরসাইকেল পরিবর্তন করেছেন। বিয়ানছুং টহলের কথা স্মরণ করে বলেন, আগে টহলের পথের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। প্রচণ্ড বাতাসে পাথরের টুকরা উড়ে বেড়াতো। আমরা কিছু ভাজা চাল ও ইনস্ট্যান্ট নুডল্স সঙ্গে রাখতাম, পথে তুষার জোগাড় করে তা সিদ্ধ করে পান করতাম। তুষার যখন পুরো পাহাড় ঢেকে ফেলতো, তখন আমরা সবাই একসাথে বসে ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে লড়াই করতাম।

 

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে খুব উঁচু জেলা চুংবা। এ জেলায় সমৃদ্ধ তৃণভূমি সম্পদ ছিল। স্থানীয় লোকজন বংশ পরম্পরায় পশুপালন করে জীবনযাপন করত।

গণতান্ত্রিক সংস্কারের পর স্থানীয় মানুষের আয় বেড়েছে। জীবনের মান বৃদ্ধির জন্য তারা খামারের পশুর পরিমাণ বাড়িয়েছে। ফলে স্থানীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার চাপও বেড়ে গেছে।

স্থানীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বিয়ানছুং একদিকে সবাইকে ঘাস চাষের আহ্বান জানান, অন্যদিকে নিজে প্রথমে পশু পালনের সংখ্যা কমিয়েছেন। বর্তমানে তাঁর পারিবারিক খামারে গরুর সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৯০টিতে, ছাগল মাত্র ১৩টি। বিয়ানছুং সবসময় সবাইকে বলেন: যদি সবাই পশু পালনের আকার বাড়িয়ে দেয়, তাহলে জন্মস্থানের নীল আকাশ এবং পরিচ্ছন্ন নদনদী মরুভূমিতে পরিণত হবে।

 

পশু পালনের পরিমাণ কমানোর ফলে তাদের আয় এক সময় অনেক কমে যায়। বিয়ানছুং তার পরিবারের সবাইকে বলেন, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সুবিধাজনক নীতি আছে। পরিবার প্রতি বছর তৃণভূমির ভর্তুকি এবং সীমান্ত এলাকার ভর্তুকি পায়, তিনি নিজেও প্রতি বছর বয়ষ্কভাতা উপভোগ করেন। তাদের জীবন আসলে আগের চেয়ে অনেক সুখকর হয়েছে।

 

এখন বিয়ানছুং-এর পরিবার সরকারি সাহায্যে সচ্ছল সমাজ প্রকল্পের আওতায় তৈরি করা বাড়িতে বাস করে। অবসর নেওয়ার পর বিয়ানছুং চার বার বাসা পরিবর্তন করেছেন। তিনি বলেন, এই নতুন বসতবাড়ি অনেক সুন্দর।

তিনি বলেন, এই বাড়িঘর সরকার আমাদের জন্য বিনামূল্যে দিয়েছে। বর্তমানে আমাদের জীবন আরো সুন্দর হচ্ছে। সীমান্ত এলাকার মানুষ হিসেবে আমাদের উচিত ভালোভাবে সীমান্ত রক্ষা করা, সবার কাছে আমাদের মুক্ত ও সুন্দর জীবনের গল্প তুলে ধরা।

 

মালভূমির বাস্কেটবল মাঠের তিব্বতি মেয়ে

জুন মাসে লাসা শহরের তাপমাত্রা থাকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে মালভূমির প্রচুর সূর্যালোক ও তীব্র আলোয় মানুষ পুরোপুরি চোখ খুলতে পারে না। নীল রংয়ের বাস্কেটবল মাঠে পাঁচ/ছয়টি ছেলে বাস্কেটবল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে। তাদের মধ্যে একটি তিব্বতি মেয়েও আছে।

 

মেয়েটির নাম ছিলা, বয়স ১৭ বছর। ছিলা হল সালার নাছুই দ্বিতীয় উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী। তাঁর বাসা সমুদ্রপৃষ্ঠ ৪৫০০ মিটার উঁচুতে নাছুই শহরে। তার বাবা-মা পশুপালক। তাঁরা কল্পনাও করতে পারেন নি যে, তাদের মেয়ের বাস্কেটবল খেলার স্বপ্ন আছে।

নাছুই শহর তিব্বতের উত্তর দিকের মালভূমিতে অবস্থিত। আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা এবং এখানে অক্সিজেনের অভাব রয়েছে। তিব্বতের বিভিন্ন শহরের মধ্যে এখানে জলবায়ু সবচেয়ে খারাপ। ২০১৪ সালে লাসায় নাছুই দ্বিতীয় উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্কুলে স্থানীয় পশুপালকের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছে।

এই স্কুলটিই ছিলা ও অন্যান্য তিব্বতি মেয়েকে স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে দিয়েছে।

 

 

ছিলা বলেন, মাধ্যমিক স্কুলে পড়াশোনা করার সময় আমি বাস্কেটবল খেলতে অনেক পছন্দ করতাম। তবে তখন সহপাঠীদের সঙ্গে খেলাধুলা করতাম। উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আমি স্কুলের বাস্কেটবল দলে যোগ দেই। শিক্ষক আমাকে অনেক পেশাদার কৌশল শিখিয়েছেন। তাই আমি বাস্কেটবল খেলায় অনেক ভালো করতে পেরেছি।

ছিলার শিক্ষকের নাম বাচু, ২০১৫ সালে চীনের ছেংতু শহরের ক্রীড়া ইন্সটিটিউট থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে তিনি এই স্কুলে যোগ দিয়েছেন। তিনি হলেন এই স্কুলের একমাত্র বাস্কেটবল কোচ।

 

বাচু বলেন, স্নাতক পাসের পর দেখেছি, এখানে খুব কম মেয়ে বাস্কেটবল খেলে। তখন অনেক মেয়ের ক্রীড়া ইভেন্ট বলতে ছিল কিছু নাচানাচি। আরো বেশি মেয়েদের বাস্কেটবল খেলায় অংশ নিতে উত্সাহ দেওয়ার জন্য ২০১৬ সালের মে মাসে স্কুলের ইতিহাসের প্রথম বাস্কেটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।

 

তৃতীয় শ্রেণীর মেয়ে দাভা দোলমা এক বাস্কেটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে এই খেলার প্রেমে পড়েন। এর আগে তিনি কখনই বাস্কেটবল খেলা সম্পর্কে জানতেন না।

দাভা দোলমা বলেন, প্রথম শ্রেণীতে পড়ার সময় স্কুলে বাস্কেটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। আমার ক্লাস তৃতীয় পুরস্কার জয় করে। আমরা সবাই এই কারণে অনেক খুশি হই। বিশেষ করে পয়েন্ট পেলে খুব ভালো লাগতো। ধীরে ধীরে সে এই খেলাকে ভালোবেসে ফেলে এবং স্কুলের বাস্কেটবল দলে যোগ দেয়।

দাভা দোলমা নিজের স্বপ্নের কথা সাংবাদিকদের জানান। তিনি বেইজিং ক্রীড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চান।

 

বাস্কেটবল শিক্ষক বাচু বলেন, আগে এসব মেয়েরা খুব লাজুক ছিল। অপরিচিত মানুষ দেখলে কথা বলতে পারত না। বাস্কেটবল খেলা শিশুদের চরিত্রকে দৃঢ় করেছে এবং এর মাধ্যমে তারা আরো আস্থাবান হয়েছে।

বাস্কেটবল দলটি স্কুলের অন্যতম একটি ক্রীড়া দল। এ ছাড়া আরো আছে ইয়োগা, টেবিলটেনিস, আধুনিক নাচসহ ১৩টি ক্রীড়া দল। প্রত্যেক শিক্ষার্থী তার পছন্দের একটি দলে যোগ দিতে পারে।

 

(শুয়েই/তৌহিদ)