বাংলাদেশের ৫০তম জাতীয় বাজেট: ‘জীবন-জীবিকা’র বাজেটে উপেক্ষিত মধ্যবিত্ত
2021-06-06 19:34:03

করোনা মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ‘জীবন ও জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’-শিরোনামে ৩ জুন সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। রেকর্ড ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ঘাটতি থাকছে রেকর্ড ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপির আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা। জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭.২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ৫.২ শতাংশে রাখার কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশের ৫০তম আর অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামালের তৃতীয় বাজেট এটি। আকার এবং ঘাটতি দুই দিক থেকেই বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি রেকর্ড বাজেট।

করোনার মধ্যে অর্থমন্ত্রীর ভাষায় জীবন ও জীবিকা বাঁচানোর এ বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া রাখা হয়েছে ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। চলতি বাজেটের চেয়ে তা ১১ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা বেশি।

করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাখাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৭১ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। এরপরই পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ৫৫ হাজার ৬২১ কোটি টাকা, স্বা্স্থ্য খাতে ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। এ ছাড়া করোনা মোকাবেলায় ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে ৪২ হাজার ১৯৩ কোটি, প্রতিরক্ষা খাতে ৩৭ হাজার ৬৯১ কোটি আর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ২৭ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

করোনা মহামারি সবচেয়ে বেশি থাবা বসিয়েছে গরীব মানুষের আয়ে। আয় কমার পাশাপাশি বেকার হয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। দুই কোটি মানুষ নেমে গেছে দরিদ্রসীমার নিচে। অর্থমন্ত্রীর তাঁর বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, এ সব বিবেচনায় নিয়ে বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। বয়স্কভাতা গ্রহীতাদের সংখ্যা বাড়িয়ে ৮ লাখে উন্নীত করা হয়েছে। নতুন ৪ লাখসহ ২২ লাখ অসচ্ছল প্রতিবন্ধীকে ভাতার আওতায় আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। তৃতীয় লিঙ্গ, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর ভাতাগ্রহীতার সংখ্যা ৮৬ হাজার জন থেকে ৯৫ হাজারে উন্নীত করা কথা বলা হয়েছে।

তাৎক্ষণিকভাবে বাজেট প্রতিক্রিয়ায় বেশির ভাগ বিশ্লেষক বাজেটকে দিক নির্দেশনাহীন, গতানুগতিক হিসেবে অখ্যায়িত করেন। বাজেটে ব্যবসায়ীদের অনেক বেশি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মধ্যবিত্তদের জন্য কোনো সুযোগ রাখা হয়নি-এমন অভিযোগ আসে। করোনার কারণে দরিদ্র হয়ে পড়া প্রায় ২ কোটি মানুষ- অর্থাৎ নতুন দরিদ্রদের কথা কিছুই বলা হয়নি বাজেটে। এ ছাড়া করোনা মোকাবেলায় কোনো দিকনির্দেশনা বাজেটে নেই বলে মনে করেন বেশির ভাগ বিশ্লেষক। শিক্ষা-স্বাস্থ্যে বরাদ্দ অপ্রতুল বলেও মনে করেন তারা। এ ছাড়া প্রায় সোয়া ২ লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘাটতি কীভাবে মেটানো হবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

৪ জুন বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এ সব সমালোচনার জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেন অর্থমন্ত্রী। করোনা মহামারিতে বাজেট যেমন হওয়া উচিত প্রস্তাবিত বাজেট তেমনই হয়েছে।

কর কমিয়ে ব্যবসায়ীদের বেশি সুবিধা দেওয়া হয়েছে- এ সমালোচনার জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, রাজস্ব আয়, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতেই ব্যবসায়ীদের করছাড় দেওয়া হয়েছে।

করোনা মোকাবেলায় সুস্পষ্ট কোনো দিক নির্দেশনা নেই- এমন সমালোচনার জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, টিকা কেনার জন্য টাকা রাখার পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। তবে এ অর্থ যাতে যথাযথভাবে ব্যবহৃত হয় সেদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় নজর রাখবে বলে জানান তিনি।

বৈদেশিক মুদ্রার ভালো রিজার্ভ এবং বিদেশি ঋণ পাওয়াসহ কিছু বিষয়ে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে থাকায় রেকর্ড ঘাটতি মেটাতেও সমস্যা হবে না বলে দাবি করেন অর্থমন্ত্রী। সর্বোপরী বাজেট বাস্তবায়নে কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী।

প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের পরও এ কথা বলা যায়, বাজেটে মধ্যবিত্ত শ্রেণি উপেক্ষিত হয়েছে, নতুন দরিদ্র ২ কোটি মানুষের কথা ভাবা হয়নি। আর করনোর দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় স্বাস্থ্যখাত যতটা গুরুত্ব পাওয়া উচিত ছিল তা পায়নি।

সংসদে রোববার থেকে শুরু হয়েছে বাজেট নিয়ে সাধারণ আলোচনা। এ বিষয়গুলো বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করে ৩০ জুন সংসদে আগামী অর্থবছরের বাজেট পাশ হবে-এমন প্রত্যাশা দেশবাসীর।

মাহমুদ হাশিম

ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।