ইউন নান প্রদেশে বন্য হাতিদের অসমাপ্ত ভ্রমণ কাহিনী
2021-06-02 14:26:12

চীনের ইউন নান প্রদেশের সিসুয়াংপাননা বন্য হাতির অধুষ্যিত এলাকা। তবে, সম্প্রতি একটি হাতির দল সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে, খেতে খেতে উত্তর দিকে যেতে থাকে। গত ২৯ মে রাতে হাতিগুলো ইউয়ু সি শহরে প্রবেশ করে। ফলে তারা প্রদেশটির রাজধানী খুন মিংয়ের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসে।

বন্য হাতি চীনের প্রথম শ্রেণীর জাতীয় সংরক্ষণ পশু। তাদের এমন চলাচল অস্বাভাবিক একটি ব্যাপার। ফলে সমাজের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আশার খবর হলো, তারা এখনো মানুষের ওপর হামলা করেনি। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ তাদের ওপর নজর রাখছে এবং তাদের এ ভ্রমণে অন্যান্য পশু ও মানুষদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে।

বন্য হাতিরা আসলে কোথায় যেতে চায়? তারা কেন হঠাত্ করে এমন ভ্রমণ শুরু করেছে? আজকে আমরা এ বিষয়ে কথা বলব।

ইউন নান প্রদেশের বন এবং তৃণভূমি ব্যুরো সূত্র অনুযায়ী, গত ১৬ এপ্রিল সিশুয়াংপাননা জাতীয় প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকার ১৭টি বন্য হাতি ইউয়ু সি শহরের ইউয়ান জিয়াং জেলার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। তারপর দুটি হাতি সংরক্ষণ এলকায় ফিরে গেলেও বাকি ১৫টি হাতি তাদের যাত্রা অব্যাহত রাখে। গত ২৭ মে রাতে হাতিগুলো একটি জেলার কেন্দ্রীয় এলাকায় প্রবেশ করে হুং থা নামের একটি জায়গায় পৌঁছায়। এখন দুটি জায়গার সরকারি কর্মকর্তারা হাতির দলটিকে পর্যবেক্ষণে রেখেছেন।

হাতির দলটিতে রয়েছে ছয়টি মহিলা হাতি, তিনটি পুরুষ হাতি, তিনটি তরুণ হাতি এবং তিনটি বাচ্চা হাতি । তারা সিশুয়ানপান না থেকে যাত্রা করে  ৫০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে বর্তমান অবস্থানে পৌঁছেছে। তারা ইউন নান প্রদেশের প্রায় অর্ধেক অতিক্রম করেছে।‌ এশিয়ান হাতির স্থানান্তর স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। তারা মূলত দক্ষিণ দিকে নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকর মধ্যে আসা-যাওয়া করে। তবে, এবার তারা উত্তর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তা খুব কমই দেখা যায়।

ইউন নান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চেন দীর্ঘসময় ধরে এশিয়ান হাতি নিয়ে গবেষণা করে আসছেন এবং তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করছেন।

তিনি বলেন, এবার প্রথম চীনে এশিয়ান হাতি এত দূর উত্তর দিকে গিয়েছে। এখন হাতিগুলো কোথায় যেতে চায়, তা জানা যায়নি। জলবায়ু, খাদ্য ও পানীয় কত দূর তাদের ভ্রমণে সহায়ক হবে, তাও অনিশ্চিত। সম্ভবত এবার তারা গন্তব্যহীন ভ্রমণ শুরু করেছে।

গেল ৪০ দিনে হাতি দলটি দুটো জেলায় মোট ৪১২ বার গোলযোগ সৃষ্টি করেছে। সরাসরি ৫৬ হেক্টর জমির চাষ নষ্ট করেছে, যার অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি প্রায় ৬৮ লাখ ইউয়ান। এটি স্থানীয়দের জীবনযাপনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তাছাড়া, হাতি দলটি এখন এ শান জেলা অতিক্রম করছে, সেখানে আরও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

বিশ্বেষজ্ঞরা বলছেন, যদি হাতিগুলো আরও উত্তরে যায়, তাহলে তারা আরও জনবহুল এলাকায় প্রবেশ করবে। সেখানে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা আরও কঠিন হবে। পাশাপাশি, শহরে হাতির জন্য উপযুক্ত খাদ্য থাকবে না, তাই হাতিগুলো যদি খাবারের খুঁজে মানুষের বস্তিতে প্রবেশ করে, তাহলে বড় সমস্যা সৃষ্টি হবে।

এশিয়ান হাতিকে স্থলের সবচেয়ে বড় প্রাণী বলে ডাকা হয়। চীনে তারা মূলত ইউন নান প্রদেশের পুএ্য, সিশুয়াংপাননা ও লিনছাং--এ তিনটি জায়গায় বাস করে। এশিয়ান হাতি এশিয়ায় বৃহত্তম স্থলজ মেরুদণ্ডী প্রাণী। তারা বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গত ৩০ বছরের প্রচেষ্টায় প্রদেশে এশিয়ান হাতির সংখ্যা ১৯৩টি থেকে ৩০০টিতে উন্নীত হয়।

পর্যবেক্ষেণ অনুযায়ী, এবার হাতি দলটি পূর্বোত্তরের নির্দিষ্ট একটি দিক অনুসরণ করে এগিয়ে যাচ্ছে। হাতিগুলো কীভাবে দিক শনাক্ত করে, তা জানা যায়নি। তাই কেন তারা এবার এ দিকে যাচ্ছে, তাও জানা যাচ্ছে না।

অধ্যাপক চেন বলেন, হয়তো হাতির নেতার অভিজ্ঞতা কম এবং হারিয়ে গেছে বা সে ভূল দিকে যাচ্ছে। তবে সে ঠিক দিকে যাচ্ছে বলে মনে করছে।

ইউন নান প্রদেশের ১১টি প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকার মধ্যে ১০টি  বন। সংরক্ষণ জোরদার করার সাথে সাথে গাছের ঘনত্ব বাড়ছে সেখানে। ফলে সেখানে হাতির খাবার কমে যায়। তাই হাতিগুলো মাঝে মাঝে সংরক্ষণ এলাকার বাইরে গিয়ে মানুষের গ্রাম বা চাষের জমিতে খাবার খুঁজে। পরিসংখ্যান মতে, তিন ভাগের দুই ভাগ হাতি সংরক্ষণ এলাকার বাইরে যায়।

তাছাড়া, হাতির সংখ্যা বৃদ্ধি হলে তাদের অভ্যাসও পরিবর্তন হয়। তারা দীর্ঘসময়ের জন্য গ্রাম ও চাষের জামির কাছাকাছি যায় এবং ফসলের সময় জানতে পারে। যখন ফসল হয়, তখন তারা এসে ধান ও ভুট্টা খায়। যখন খাবার কম থেকে, তখন তারা কৃষকদের সঞ্চিত লবণ এবং ভুট্টা খায়। এভাবেই হাতিদের মানুষের সাথে বাস করার অভ্যাস গড়ে ওঠে।

কীভাবে এশিয়ান হাতি ও মানুষের মধ্যে সংর্ঘষ কমিয়ে দুপক্ষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়, তা এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর মোকাবিলায় কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। যেমন, সরকার হাতির জন্য বিশেষ ‘ক্যান্টিন’ নির্মাণ করে। পাশাপাশি, কৃষকদের রক্ষায় বেড়া তৈরি করে। সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের বীমা ক্রয় করে সরকার। যদি বন্য হাতি তাঁদের কোন ক্ষয়ক্ষতি  করে, তাহলে বীমার মাধ্যমে আর্থিক ক্ষতিপূরণ পেতে পারে কৃষকরা।

বর্তমানে ইউন নান প্রদেশে একটি কর্মদল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট জেলায় কর্মীদেরকে পাঠানো হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হাতিগুলো নির্দিষ্ট দিকে আরও এগিয়ে যাবে এবং যেখানে তারা পৌঁছাবে সেখানে সতর্কতা ও তাদের মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। (শিশির/এনাম/রুবি)