গত ২২ মে ৯১ বছর বয়সে চীনের ‘হাইব্রিড ধানের জনক’, চীনের প্রকৌশল একাডেমির বিখ্যাত শিক্ষাবিদ, ইউয়ান লুং পিং মৃত্যুবরণ করেন। এ খবর চীনা নেটিজেনদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সারা দেশ তার মৃত্যুতে শোকাতুর হয়। অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় বলেছেন, প্রতিদিন ভাল খাবেন কিন্তু খাদ্য নষ্ট করবেন না।
ডক্টর ইউয়ানের মৃত্যু বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। জাতিসংঘও তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়েছে। আজকের আসরে ‘হাইব্রিড ধানের জনক’ ইউয়ান লুং পিংয়ের বিরাট অবদান এবং বাংলাদেশের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে আলাপ করব।
কেন চীনে ডক্টর ইউয়ান লুং পিং এতো জনপ্রিয়? কারণ, তাঁর সারা জীবন তিনি ব্যয় করেছেন চীনাদের খাদ্যশস্যের অভাব দূর করতে। শুধু চীন নয়, বিশ্বেও তাঁর অবদান অতুলনীয়। জনাব ইউয়ানের মৃত্যুর পর বিদেশি গণমাধ্যমগুলো তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। ব্রিটেনের ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ পত্রিকায় তাঁর প্রশংসা করা হয়েছে; বলা হয়েছে, ডক্টর ইউয়ানের হাইব্রিড ধান বিশ্বের বহু দেশের মানুষের ক্ষুধা দূর করেছে। জার্মান গণমাধ্যম ইউয়ানের ৯০তম জন্মদিনের সময় তাঁকে ‘বিশ্বের জন্য কল্যাণকর বিজ্ঞানী বীর’ বলে আখ্যায়িত করেছে। তা ছাড়া, বাংলাদেশ, মালিয়েশিয়া, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশের লোক, যারা ডক্টর ইউয়ানের সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়েছেন বা তাঁর অবদান সম্পর্কে জানেন, ডক্টর ইউয়ানের অবদানের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
ইউয়ান লুং পিং ১৯৪৯ সালের অগাস্ট মাস থেকে ১৯৫৩ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত চীনের ছোংছিং মহানগরের সাউথ ওয়েস্ট কৃষি একাডেমিতে পড়াশোনা করেছেন। পরে এর নাম ২০০৫ সালে সাউথওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের কেন্দ্রীয় এলাকায় ডক্টর ইউয়ানের ভাস্কর্য আছে। তাঁর মূর্তির হাতে ধানের শীষ। এ ভাষ্কর্যের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ডক্টর ইউয়ানকে স্মরণ করা হয়। ২২ মে বিকেলে ডক্টর ইউয়ানের মৃত্যুবরণের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী হাতে ফুল নিয়ে ভাষ্কর্যের সামনে শোক প্রকাশ করেন।
আসলে ২০১৬ সালে সাউথওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১১০তম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে ডক্টর ইউয়ান ক্যাম্পাসে ফিরে আসেন। তখন তাঁর বয়স ৮৬ বছর। তিনি বলেন, সাউথওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা তাঁর জীবনে বিজ্ঞানের পথে যাত্রার প্রথম পদক্ষেপ। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভালো করে পড়াশোনা করে দেশের উন্নয়নের নিজের অবদান রাখবে বলে আশা করেন তিনি।
ডক্টর ইউয়ানের ভাষ্কর্যের নিচে কয়েকটি লাইন উত্কীর্ণ আছে। সেগুলো ডক্টর ইউয়ানের একটি স্বপ্ন নিয়ে। তাতে লেখা আছে: ‘দিনের বেলায় যা ভাবি, রাতের স্বপ্নে তা-ই দেখি। আমার স্বপ্নে পরীক্ষামূলক ক্ষেতে সুপার বড় সাইজের ধান দেখেছি, যা জোরঝুমের চেয়েও বড় এবং ঝাড়ুর চেয়ে লম্বা; বিভিন্ন ধানের শস্য বাদামের মতো বড়। কোটি কোটি ধানের শীষ যেন জলপ্রপাতের মতো এবং আমি তার ছায়ায় বসে বিশ্রাম নেই। আশা করি এ স্বপ্ন পূরণ হবে এবং বিশ্বের সকল মানুষের ক্ষুধা দূর হবে।’
এ কথা যেন ডক্টর ইউয়ানের জীবনেরই প্রতিফলন। ২৫ মে সাউথওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত ডক্টর ইউয়ানের স্মরণসভায় চীনের প্রকৌশল একাডেমির শিক্ষাবিদ সিয়াং চুং হুয়াই ডক্টর ইউয়ানের সাথে তার সাক্ষাতের কথা স্মরণ করেন। ডক্টর ইউয়ানের মৃত্যুবরণ সম্পর্কে তিনি বলেন, “এ খবর জেনে মনে অনেক দুঃখ পেয়েছি। প্রতিবার যখন ডক্টর ইউয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসতেন, তখন অবশ্যই তাঁর শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করতেন।’ হাইব্রিড ধানের গবেষণা সম্পর্কে সিয়াং বলেন, ‘ডক্টর ইউয়ান প্রায় ১৮ বছর ধরে হাইব্রিড ধান নিয়ে গবেষণা করে সফলতা পেয়েছেন। তাকে অনেক চ্যালেঞ্জ ও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু তিনি কখনও হাল ছেড়ে দেননি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ডক্টর ইউয়ানের জীবনের ৬০ বছরেরও বেশি সময় কেটেছে হাইব্রিড ধানের গবেষণায়। এটা সবার জন্য অনুপ্রেরণার বিষয়।’
বিজ্ঞান গবেষণায় মনোযোগী এই বিজ্ঞানী ছিলেন পরিশ্রমী ও মিতব্যয়ী। এ সম্পর্কে জনাব সিয়াং বলেন, ‘একবার আমরা একসাথে লাঞ্চ খাই। খাওয়া শেষ করার পর তিনি বাটির পাশে দুটি ভাত দেখতে পেয়ে হাত দিয়ে সেগুলো তুলে নিয়ে মুখে দেন। তিনি কখনও খাবার নষ্ট হতে দিতেন না।’ একবার সাউথওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট তিং চুং মিন তাঁকে জিজ্ঞেস করেন: ‘আপনি হাইব্রিড ধানের গবেষণা করেন। কেন একটি মাত্র শস্যের ওপর এতো গুরুত্ব দিচ্ছেন?’ তখন ডক্টর ইউয়ান বলেন, তিনি ক্ষুধা কী জিনিষ জানেন। কারণ, তার সময় কেটেছে ক্ষুধার মধ্যে। তাই তিনি প্রতিটি শস্যদানার ওপর গুরুত্ব দেন। হাইব্রিড ধান নিয়ে গবেষণার কারণে শস্যদানার প্রতি গভীর আবেগ রয়েছে তার।
গত ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে হাইব্রিড ধান নিয়ে গবেষণায় অনেক ধরনের শ্রেষ্ঠ ধানের বীজ আবিষ্কার করেছেন ডক্টর ইউয়ান। ২০১৭ সালে তিনি ১ কেজি শ্রেষ্ঠ বীজ উপহার হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দেন এবং সাউথওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ও জীববিজ্ঞান একাডেমির ধানদল ছোংছিংতে বীজগুলো বুনে। মাত্র কয়েক মাস পর পরীক্ষামূলক ধানক্ষেতে ব্যাপক ফসল ফলে। ডক্টর ইউয়ানের গবেষণালব্ধ হাইব্রিড ধানের বীজ শুধু উচ্চমানের নয়, বরং বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতেও সক্ষম ছিল। এটা ছিল চমত্কার ও অতুলনীয় সাফল্য।
ডক্টর ইউয়ান অনেক বিজ্ঞানীর জন্য দৃষ্টান্তস্বরূপ। যখন তাঁরা গবেষণায় সমস্যার সম্মুখীন হতেন, তখন তাঁরা সবসময় ইউয়ানের কথা স্মরণ করে নিজেদের উত্সাহ দিতেন। ডক্টর ইউয়ানের মৃত্যু হলেও অনেক চীনা বিজ্ঞানী তাঁর হাইব্রিড ধান গবেষণার কাজ অব্যাহতভাবে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
আসলে খাদ্যশস্য মানবজাতির বেঁচে থাকার ভিত্তি, তা কোনো দেশের আলাদা সম্পত্তি নয়। উন্নত দেশগুলোর উচিত উন্নয়নশীল দেশ বা অনুন্নত দেশগুলোকে সহায়তা দেওয়া। সংশ্লিষ্ট জরিপ থেকে জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে ৪টি দেশের খাদ্যশস্যের উত্পাদন সবচেয়ে বেশি: চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং ব্রাজিল। চীনের কৃষিক্ষেত বিশ্বের ১০ শতাংশ। তবে চীনা লোকসংখ্যা বিশ্বের ২২ শতাংশ। এমন জনবহুল দেশের খাদ্যশস্যের চাহিদা অনেক বেশি। তাই ডক্টর ইউয়ানের হাইব্রিড ধান চীনাদের খাওয়ার সমস্যার সমাধানে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশের আয়তন ১.৫ লাখ বর্গকিলোমিটার এবং লোকসংখ্যা ১৭ কোটিরও বেশি। দেশটিতে নদী ও পুকুর প্রচুর। তাই ধান চাষের জন্য বেশ উপযোগী। তবে কয়েক দশক আগে বাংলাদেশে যে ধান উত্পাদিত হতো, তা দেশের নাগরিকদের চাহিদার মেটাতে সক্ষম ছিল না। প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে ধানের উত্পাদনও কম হতো। ধানের ফলন বাড়াতে তখন ডক্টর ইউয়ানকে আমন্ত্রণ জানায় বালাদেশ সরকার। বাংলাদেশে পৌঁছে তিনি প্রায় দুই সপ্তাহ গবেষণা করেন এবং স্থানীয় ধানের উত্পাদন নিয়ে স্থানীয় কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করেন। কয়েক দিন পর তিনি বাংলাদেশের কৃষি মন্ত্রণালয়ে বক্তৃতা দেন এবং হাইব্রিড ধানের ছবি দেখে সবাই আনন্দের সাথে উল্লাস করে। হাইব্রিড ধান দেখে অনেকে অবাক হয়ে যান।
ডক্টর ইউয়ান যখন বাংলাদেশ সফর করেন, তখন প্রতি হেক্টরে ধান উত্পাদনের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩০০০ কেজি। ডক্টর ইউয়ানের হাইব্রিড ধান হেক্টরপ্রতি উত্পাদন হয় ১৩৫০০ কেজি এবং বর্তমানে হাইব্রিড ধানের হেক্টরপ্রতি উত্পাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮০০০ কেজিতে। বক্তৃতায় ডক্টর ইউয়ান তাঁর হাইব্রিড ধান গবেষণার অভিজ্ঞতাও বিনিময় করেন, যা বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের মনে গভীর ছাপ ফেলে। ডক্টর ইউয়ানের হাইব্রিড ধানের প্রযুক্তি দিয়ে বাংলাদেশের কৃষিক্ষেতে নতুন ধান লাগানো হয় এবং কয়েক দশক পর স্থানীয় খাদ্যশস্যের উত্পাদন ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। এখন শুধু দেশের চাহিদা মেটানো নয়, বরং প্রতিবেশী দেশে চাল রফতানিও করে বাংলাদেশ। বস্তুত ডক্টর ইউয়ানের হাইব্রিড ধান শুধু বাংলাদেশে জনপ্রিয় নয়, বরং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেও ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়েছে ও হচ্ছে। ১৯৮০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ডক্টর ইউয়ানের গবেষকদল বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশের ১৪ হাজারেরও বেশি প্রযুক্তিকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এখন ভারত, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়াসহ ৪০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলে হাইব্রিড ধান পাওয়া যায়। সেখানে প্রতি হেক্টরে উত্পাদন পরিমাণ সাধারণ ধানের চেয়ে দুই টনেরও বেশি।
২০১৭ সালের ১১ মে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা চীন সফরে আসেন। তাঁরা ডক্টর ইউয়ানের সাথে দেখা করার সুযোগ পান। বর্তমানে বাংলাদেশে চীনের ১৬০টিরও বেশি ধরনের ধান নিবন্ধিত হয়েছে এবং বাংলাদেশে চীনের হাইব্রিড ধানের চাষের জমির আয়তন ৯ লাখ একরে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর বাংলাদেশকে নতুন হাইব্রিড ধানের প্রযুক্তি-সহায়তা দেয় চীন এবং বাংলাদেশের কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি উন্নয়ন কোম্পানি (বিএডিসি) আর ধান গবেষণা ইনস্টিডিউট (বিআরআরআই)-এ প্রশিক্ষণ কোর্সও পরিচালনা করে।
ডক্টর ইউয়ানের মৃত্যুর খবর পেয়ে বাংলাদেশের অনেক পত্রিকা লিখেছে এ মৃত্যু দু’দেশের জন্য বড় ক্ষতি। বাংলাদেশের একজন গবেষক সোশ্যাল মিডিয়ায় ডক্টর ইউয়ানের সাথে তোলা ছবি পোস্ট করেছেন এবং ইউয়ানকে স্মরণ করেছেন। তিনি লিখেছেন: ইউয়ান বাংলাদেশের চিরদিনের বন্ধু, তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক জানাই।
আশা করি ভবিষ্যতে আরও বেশি গবেষক ডক্টর ইউয়ান লুং পিংয়ের মতো হাইব্রিড ধান নিয়ে গবেষণায় আরো বেশি সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হবেন। যখন আমরা ভাত খাই, তখন ইউয়ানের কথা স্মরণ করি।
সুপ্রিয় বন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা এখানে শেষ হয়ে এলো। আমাদের অনুষ্ঠান যারা মিস করেছেন, তারা আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন। ওয়েবসাইট ঠিকানা www.bengali.cri.cn,ফেসবুকে CRIbangla মাধ্যমে চীন ও বিশ্ব সম্পর্কে আরও অনেককিছু জানতে পারেন। তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন, আগামী সপ্তাহে আবার কথা হবে,যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)