প্রায় ৩০ বছর পর ২০২০ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রকাশিত পূর্বাভাসে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়। ২০২০ সালে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা কমপক্ষে ৮.৩ কোটি বেড়েছে। কিন্তু চীনে গ্রীষ্মকাল ও শরতের শুরুর দিকের ফলন ভালো হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ হলো হাইব্রিড ধান।
পাশ্চাত্য দেশগুলোর পন্ডিতদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন ইউয়ান লং ফিং। তিনি বলেন, তাঁরা খাদ্য উত্পাদন বাড়াতে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির বিপুল সম্ভাবনান অবমূল্যায়ন করেছেন। ইউয়ান মনে করেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে খাদ্যশস্যের উত্পাদনের পরিমাণ অনেক বেড়েছে।
২০১৯ সালের অক্টোবরে চীনা রাষ্ট্রীয় পরিষদের তথ্য কার্যালয়ের প্রকাশিত ‘চীনের খাদ্য নিরাপত্তা’ শীর্ষক শ্বেতপত্রে বলা হয়, ২০১৭ সালে চীনে প্রতি হেক্টর জমিতে ধানের ফলন ৬৯১৬.৯ কেজিতে পৌঁছায়, যা ১৯৯৬ সালের চেয়ে ১১.৩ শতাংশ বেশি এবং বিশ্বের গড় মানের চেয়ে ৫০.১ শতাংশ বেশি। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীন ব্যাপকভাবে উচ্চমানের খাদ্য উত্পাদন করে আসছে। হাইব্রিড ধানের উত্পাদনের পরিমাণ সাধারণ ধানের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি। প্রতিবছরে যে পরিমাণ খাদ্য বেশি উত্পাদিত হচ্ছে, তা দিয়ে ৭ কোটি মানুষের খাওয়ার সমস্যা দূর হতে পারে।
গত শতাব্দীর ষষ্ঠ দশক থেকে চীন সার্বিকভাবে খাদ্যশস্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নব্যতাপ্রবর্তনের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে শুরু করে। ইউয়ান লং ফিংয়ের প্রতিনিধি হিসেবে ধান উত্পাদন ক্ষেত্রের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কর্মীরা হাইব্রিড ধান গবেষণার ক্ষেত্রে নব্যতাপ্রবর্তন করতে থাকেন।
১৯৯৬ সালে চীন ‘সুপার ধান’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে। পরে মৌলিক তত্ত্ব ও জাত নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি অর্জিত হয়। ২০০০, ২০০৪, ২০১১ ও ২০১৪ সালে প্রতি মু জমিতে যথাক্রমে ৭০০, ৮০০, ৯০০ ও এক হাজার কেজি ধান উত্পাদিত হয়।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্ব বিখ্যাত্ একাডেমিক জার্নাল ‘নেচার প্ল্যান্টস’-এ ((Nature Plants) প্রকাশিত সম্পাদকীয়ে বলা হয়, চীন উদ্ভিদ ও জীববিজ্ঞান গবেষণা ক্ষেত্রে বিশ্বে নিজের একটি অসামান্য অবস্থান সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে, ধানের উত্পাদনসংশ্লিষ্ট বিজ্ঞান, জেনেটিক্স ও জনসংখ্যার জিনোমিক্স গবেষণা খাতে চীনের অবস্থান বিশ্বের শীর্ষস্থানে। ২০১৭ সালের অগাষ্ট মাসে মাদাগাস্কারের কৃষি, পশুপালন ও মৎস্য মন্ত্রণালয়ের উদ্ভিদ সুরক্ষা বিভাগের পরিচালক ইউয়ান লং ফিংকে একটি উপহার দেন। উপহার হলো সেদেশের ২০ হাজার আরিয়ারির মুদ্রা। মুদ্রায় ইউয়ানের গবেষণাকৃত হাইব্রিড ধানের ছবি আছে।
পরিচালক বলেন, ধান হলো মাদাগাস্কারের প্রধান খাদ্যশস্য। চীনের হাইব্রিড ধান সেদেশে ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়। এর মাধ্যমে সেদেশের জনগণ ক্ষুধা থেকে মুক্তিলাভ করে।
২০১০ সালে তখনকার বিশ্ব খাদ্যশস্য পরিকল্পনা বিভাগের নির্বাহী মহাপরিচালক জোসেট্ট শিরান বলেছিলেন, ‘যখন আমি বিভিন্ন দেশ সফর করতাম, তখন মানুষ আমার কাছে জানতে চাইত যে, আমার জীবদ্দশায় বিশ্ব ক্ষুধামুক্ত হবে কি না। আমি উত্তরে বলতাম, চীন হলো আমার উত্তর।’
যদিও প্রতিবছরে চীনের খাদ্যশস্যের ফলন ভালো হয়, তবুও উদ্বেগ পিছু ছাড়ে না। ‘চীনের খাদ্য নিরাপত্তা’ শীর্ষক শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা সুরক্ষার কাজে কখনো শিথিলতা দেখানো চলবে না। খাদ্যশস্য নিরাপত্তার বিষয়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)-এর ১৯তম কেন্দ্রীয় কমিটির পঞ্চম পূর্ণাঙ্গ সম্মেলনের ইস্তাহার ও চতুর্দশ পাঁচসালা পরিকল্পনার প্রস্তাবেও এমন কথা লেখা হয়েছে।
ইউয়ান লং ফিং মনে করেন, চীনের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু চাষের জমি কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে।
গত অক্টোবরে ইউয়ান লং ফিংয়ের নেতৃত্বাধীন গবেষণা দল ও চিয়াংসু প্রদেশের কৃষি প্রযুক্তি উন্নয়ন স্টেশনের যৌথ গবেষণায় লবণাক্ত মাটিতে চাষ করার উপযোগী ধান প্রতি মু জমিতে উত্পাদনের পরিমাণ ছিল ৮০২.৯ কেজি। এটি লবণাক্ত মাটিতে ধান উত্পাদনের ক্ষেত্রে একটি বিশ্ব রেকর্ড।
বর্তমানে চীন সমুদ্রে ধান চাষ করার জন্য গবেষণা করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গবেষণা সফল হলে শুধু চীনের ধান চাষের ক্ষেত্র বাড়বে না, বরং বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের সমুদ্রেও ধান চাষ করা যাবে।