চীনের ‘সঙ্কর ধানের জনক’ ইউয়ান লোং পিং
2021-05-28 11:22:00

চীনের ‘সঙ্কর ধানের জনক’ ইউয়ান লোং পিং

চীনের ‘সঙ্কর ধানের জনক’ ইউয়ান লোং পিং_fororder_y1

 

গত শনিবার চীনে ৯১ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন; তাঁর নাম ইউয়ান লোং পিং।

চীনের হুনান প্রদেশের ছাংশা শহরের সিয়াং ইয়া হাসপাতাল ভবনের সামনে, কিছু সবুজ রংয়ের ধান সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কিছু মানুষ ধান সাজিয়ে রেখে এই বৃদ্ধকে শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। কারণ, ধান হল এই বৃদ্ধের সারা জীবনের পরিশ্রম ও গবেষণার বিষয়।

 

তিনি সারা জীবন মাতৃভূমি ও জনগণের চাহিদাককে নিজের দায়িত্ব হিসেবে মাথায় নিয়ে কাজ করেছেন, তিনি মাতৃভূমি ও জনগণের জন্য কাজ করাকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। তিনি সারা জীবন ধানক্ষেতে পরিশ্রম করেছেন, তিনি চীনের বিশাল ভূখণ্ডে নিজের বৈজ্ঞানিক চাষের ফলাফল তুলে ধরেছেন।

তিনি হলেন চীনের ‘সঙ্কর ধানের জনক’ ও বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ইউয়ান লোং পিং। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা তাঁর অসাধারণ জীবন এবং তার অসাধারণ অবদান নিয়ে আপনাদের সঙ্গে আলাপ করবো।

 

২০১৯ সালের ১ অক্টোবর ছিল গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ৭০তম বার্ষিকী। এই বিশেষ দিবসে চীনের জাতীয় গণকংগ্রেস ৪২জন ব্যক্তিকে চীনের রাষ্ট্রীয় পদক এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন চীনের ‘সঙ্কর ধানের জনক’ ইউয়ান লোং পিং।

 

ইউয়ান লোং পিং ১৯৩০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর চীনের বেইজিংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হলেন চীনের সঙ্কর ধান বিশেষজ্ঞ, চীনের সঙ্কর ধান গবেষণা ও উন্নয়ন কাজের প্রতিষ্ঠাতা। তাকে ‘বিশ্বের সঙ্কর ধানের জনক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি হলেন, চীনের রাষ্ট্রীয় সঙ্কর ধান প্রকল্প ও গবেষণা কেন্দ্র এবং হুনান প্রদেশের সঙ্কর ধান গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক মহাপরিচালক, চীনের ইঞ্জিনিয়ারিং একাডেমির একাডেমিশিয়ান।

বলা যায়, তিনি চীনাদের খাদ্য-সংকট সমাধান করেছেন। ‘সঙ্কর ধানের জনক’ ইউয়ান লোং পিং মনে করেন, এটি দেশের প্রতি তাঁর দায়িত্ব। চীনের রাষ্ট্রীয় খাদ্য নিরাপত্তা সম্পর্কে তাঁর এমন দায়িত্বশীল মনোভাব কখনই পরিবর্তিত হয় নি।

 

ইউয়ান লোং পিং চীনের প্রথম সর্বোচ্চ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পুরস্কার, ‘সংস্কারের অগ্রণী’ এবং ভবিষ্যত বিজ্ঞান পুরস্কারসহ বিভিন্ন গৌরবময় খেতাব পেয়েছিলেন। নয়া চীন প্রতিষ্ঠার ৭০ বছর পূর্তিতে তিনি আবারও ‘চীনের রাষ্ট্রীয় পদক’ পান। প্রথম দফা সুপার ধান থেকে চতুর্থ দফায় সুপার ধান উদ্ভাবন করেছেন তিনি। তাঁর গবেষণার পর প্রতি হেক্টর জমিতে ১৬ টন, ১৭ টন ও ১৮ টনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়েছে। চীনের সঙ্কর ধান নিয়ে গবেষণা কাজের মান সবসময় বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ে ছিল। ইউয়ান লোং পিং মনে করেন, নিজের প্রিয় মাতৃভূমি হলো তার সব পরিশ্রমের চালিকাশক্তি।

চীনের ‘সঙ্কর ধানের জনক’ ইউয়ান লোং পিং_fororder_y2

দেশের জন্য অবদান রাখার জন্য কৃষিকে বাছাই করা সিদ্ধান্ত

ইউয়ান লোং পিং গোলযোগের যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ছোটবেলায় তিনি পরিবারের সঙ্গে নিরাপদ স্থানের লক্ষ্যে বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়িয়েছেন। তিনি গভীরভাবে অনুভব করেন যে, নিজের দেশকে আগে শক্তিশালী করতে হবে। নয়া চীন প্রতিষ্ঠার আগে, ইউয়ান লোং পিং দেখেছেন, অনাহারে রাস্তার পাশে মানুষের মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। তিনি খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন। আগে ইউয়ান লোং পিং-এর ক্রীড়া অথবা সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে দেশের জন্য অবদান রাখার ইচ্ছা পোষণ করতেন। তবে, এ অবস্থা দেখে তিনি কৃষিকে বাছাই করেন। কারণ, তিনি চীনাদের খাবার সমস্যা সমাধান করতে চান। তিনি আশা করেন, চীনারা আর ক্ষুধার্ত থাকবে না।

 

১৯৫৩ সালে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিম কৃষি ইন্সটিটিউট (বর্তমানের দক্ষিণ-পশ্চিম বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পর ইউয়ান লোং পিং হুনান প্রদেশের আনচিয়াং কৃষি স্কুলে কাজ করতে শুরু করেন। তিনি বলেন, নয়া চীনের প্রথম দফা কৃষিবিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছাত্র হিসেবে, আমি সিদ্ধান্ত নেই যে, চীনের খাদ্য উত্পাদনের পরিমাণ বাড়ানোর চেষ্টা করবো এবং যাতে চীনারা আর ক্ষুধার্ত না-থাকে।

 

১৯৫৬ সালে ইউয়ান লোং পিং তার শিক্ষার্থীদের নিয়ে কৃষিক্ষেত্রে পরীক্ষা শুরু করেন। তিনি আবিষ্কার করেন যে, ভিন্ন ধানের সঙ্করীকরণের বিশেষ সুবিধা আছে। তিনি মনে করেন, এটাই হলো ধান উত্পাদনের পরিমাণ বাড়ানোর গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। তখন থেকেই সঙ্কর ধান চাষ করার চেতনা তার মাথায় ঢুকে যায়।

১৯৬৬ সালে ইউয়ান লোং পিং ‘ধানের পুং বন্ধ্যাত্ব’ নামে গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তখনই মূলত চীনের সঙ্কর ধান নিয়ে গবেষণা শুরু হয়।

গবেষণার সময়ের কথা স্মরণ করে ইউয়ান লোং পিং বলেন, তখন তিনি কয়েক মাসের খাবার নিয়ে কয়েক দিনের ট্রেন করে চীনের ইয়ুননান, হাইনান ও কুয়াংতুং প্রদেশসহ বিভিন্ন জায়গায় চলে যেতেন। শুধুই ধানের জন্য উপযোগী সূর্যের আলো খুঁজতেন তিনি। তিনি বলেন, এ যেন ‘সূর্যের পিছে যাযাবর পাখির মতো ছুটে চলা’।

চীনের ‘সঙ্কর ধানের জনক’ ইউয়ান লোং পিং_fororder_y3

সুপার ধান জনপ্রিয়করণ

১৯৭৩ সালে ইউয়ান লোং পিং-এর গবেষণায় সঙ্কর ধান প্রথমে চীনের হুনান প্রদেশে চাষ করা হয়। এরপর সারা চীনে তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তখন ৬৬৬ বর্গমিটার (অর্থাত্ চীনের হিসাবে এক মু ) জমিতে ধান উত্পাদন অনেক বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৬ সালে ২৩১ কেজি, ১৯৮৪ সালে ৩৫৮ কেজি, ১৯৯৮ সালে তা বেড়ে ৪২৪ কেজিতে উন্নীত হয়।  

১৯৯৬ সালে চীনের কৃষি মন্ত্রণালয় সুপার ধান পরিকল্পনা উত্থাপন করে। ইউয়ান লোং পিং-এর বিজ্ঞান গবেষণাদল সাফল্যের সঙ্গে সুপার ধান পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। এখন সুপার ধান পরিকল্পনার পঞ্চম ধাপের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করেছে। তা হল- ৬৬৬ বর্গমিটার জমিতে ধানের উত্পাদন ৭০০ কেজি, ৮০০ কেজি, ৯০০ কেজি, ১০০০ কেজি এবং ১১০০ কেজি।

 

পরিশ্রমী পদক্ষেপ থামানো যায় না: যথেষ্ট খাবার থেকে ভালো খাবার এবং স্বাস্থ্যকর খাবারের লক্ষ্য বাস্তবায়ন

এখন সঙ্কর ধান উত্পাদনের পরিমাণ পরীক্ষামূলকভাবে প্রতি হেক্টর জমিতে ১৮ টনে উন্নীত হয়েছে। তবে ইউয়ান লোং পিং এতে সন্তুষ্ট হন নি। তিনি বলেন, আগামীতে প্রতি হেক্টর জমিতে ১৯ টন এবং ২০ টনের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে হবে।

‘যথেষ্ট খাবারের’ সমস্যা সমাধানের পর ইউয়ান লোং পিং ‘ভালো খাবার’ এবং ‘স্বাস্থ্যকর খাবারের’ ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাঁর নেতৃত্বে, এক যুগ ধরে চাষ করা সুপার ধান আগের উত্পাদনের পরিমাণের চেয়ে বেশি পরিবেশবান্ধব হয়েছে।

 

তাঁর ৯০ বছর বয়সের জন্মদিনে ইউয়ান লোং পিং বলেন, তার দু’টি স্বপ্ন আছে। একটি হলো ‘ধানের নিচে বসে ঠান্ডা বাতাস উপভোগ করা’, আরেকটি হল ‘সারা  বিশ্বে সঙ্কর ধান জনপ্রিয় করা’।

ইউয়ান লোং পিং স্বপ্নে দেখেছিলেন, তার পরীক্ষামূলক ক্ষেতে সুপার সঙ্কর ধান মানুষের চেয়েও লম্বা হয়েছে। তিনি ও তার সহকারীরা ধান গাছের নিচে বসে ঠান্ডা বাতাস উপভোগ করেছেন।

আরেকটি স্বপ্ন হল- সারা বিশ্বে সুপার সঙ্কর ধান জনপ্রিয় করা এবং বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তায় অবদান রাখা। তিনি বলেন, ‘বিশ্বে ১৬ কোটি হেক্টর ধান চাষের ক্ষেত আছে। যদি এর অর্ধেক ক্ষেতে সুপার সঙ্কর ধান চাষ করা যায়, প্রতি হেক্টরে ধানের উত্পাদন ২ টন বৃদ্ধি পেলে প্রতি বছর আরো ৫০ কোটি মানুষের খাবার সমস্যা সমাধান করা যাবে। ইউয়ান লোং পিং-এর মতে, সঙ্কর ধান উন্নত করার মাধ্যমে বিশ্বের খাদ্যাভাব সমাধানে বিরাট অবদান রাখা যাবে। জানা গেছে, ১৯৭৯ সালে চীনের সঙ্কর ধান প্রথমবারের মতো বিদেশে পাঠানো হয়। সঙ্কর ধান বিশ্বের কিছু দেশ ও অঞ্চলে গবেষণা ও জনপ্রিয় হয়েছে। বিদেশে ৭০ লাখেরও বেশি হেক্টর জমিতে এই ধান চাষ করা হচ্ছে।

 

এখন এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০১৯ সালে ইউয়ান লোং পিং-এর নেতৃত্বে চীনের বিশেষজ্ঞরা মাদাগাস্কারে পাঁচ হেক্টর জমিতে সঙ্কর ধান চাষ করেন। প্রতি হেক্টর জমিতে ধান উত্পাদন হয় ১০.৮ টন। যা স্থানীয় সাধারণ ধান উত্পাদন তুলনায় তিন গুণ বেশি হয়েছে। এই পদক্ষেপ আফ্রিকার খাদ্য সমস্যা সমাধানে নতুন আশা সৃষ্টি করেছে। আফ্রিকার মানুষ চীনের সুপার সঙ্কর ধানকে ‘পূর্বের অসাধারণ ধান’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

 

 

বিশ্ব খাদ্য তহবিলের চেয়ারম্যান ইউয়ান লোং পিং-এর ৯০ বছর বয়সের জন্মদিনে লেখা এক অভিনন্দনবাণীতে বলেন, ২০০৪ সালে গৌরবান্বিত হয়ে আমরা আপনাকে বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার প্রদান করেছিলাম। যাতে সঙ্কর ধানের জনক হিসেবে আপনার অতুলনীয় সাফল্যের মূল্যায়ন করা যায়। তারপর ১৫ বছর পার হয়ে গেছে। ১৫ বছরে আপনি এখন ধান গবেষণা ক্ষেত্রে নতুন সাফল্য অর্জন করছেন এবং মানবজাতির কল্যাণ করে যাচ্ছেন।

এটা হলো ‘সঙ্কর ধানের জনককে’ এই বিশ্বের পক্ষ থেকে জানানো সম্মান ও স্বীকৃতি।

 

চরম প্রতিকূল পরিবেশে ধান চাষের সফলতা

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আরেকটি পরীক্ষা চালানো হয়। তা হলো- লোনা পানিতে ধান চাষ। বলাই বাহুল্য, এই পরীক্ষাও সফল হয়। যা চীনের ‘সঙ্কর ধানের জনক’ ইউয়ান লোং পিংয়ের প্রযুক্তি দলের সর্বশেষ চেষ্টা ‘সমুদ্রের পানিতে ধান উত্পাদন’।

তিনি ও তাঁর দল ৬৬৬ বর্গমিটার জমিতে ৬২০.৯৫ কেজি ধান উত্পাদন করতে সক্ষম হন।

 

২০১৮ সালের মে মাসে ইউয়ান লোং পিং-এর দল মরুভূমিতে ধান চাষের পরীক্ষা করেন ও তা সফল হয়। এতে প্রতি ৬৬৬ বর্গমিটার জমিতে ৫শ কেজি ধান উত্পাদিত হয়। এর মাধ্যমে বিশ্বে প্রথমবারের মতো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মরুভূমিতে ধান চাষ করা হয়। এটি মরুভূমি অঞ্চলে খাদ্য উত্পাদানের সামর্থ্য বাড়ায় এবং বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা ও মরুভূমির প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নয়নে ‘চীনের অবদান’।  

ভবিষ্যত সম্পর্কে ইউয়ান লোং পিং বলেন, আমি আশা করি ১০০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারবো। আমি চীনের ভবিষ্যত্ নিয়ে খুব আশাবাদী। আমি দেশের সমৃদ্ধির জন্য অনেক বেশি অবদান রাখতে চাই।

 

কিন্তু, তাঁর এই আশা পূরণ হয় নি। একজন বিজ্ঞানী, কেন সারা বিশ্বের জনগণের কাছে শ্রদ্ধা পান? যদি আপনি আফ্রিকার দ্বীপ দেশ মাদাগাস্কারের নতুন মুদ্রা দেখেন, তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন, এতে আঁকা আছে নতুন সঙ্কর ধান। এই ধান ২০ লাখ মানুষের দেশের দুর্ভিক্ষের ইতিহাস মুছে দিয়েছে। এই ছোট দেশটির ধান আমদানির ইতিহাস শেষ হয়েছে।

 

সঙ্কর ধান, বিশ্বের খাদ্য সংকট সমাধানের ‘চীনা প্রস্তাবে’ পরিণত হয়েছে। সারা বিশ্বের জনগণ এখন যথেষ্ঠ খাবার খেতে পারছে। এটি হল চীনের কৃষি বিজ্ঞানীদের বৈজ্ঞানিক চেতনার ফসল।

সঙ্কর ধান উন্নত করা, সারা বিশ্বের জনগণের কল্যাণ করা—এটাই ছিল ইউয়ান লোং পিংয়ের সারা জীবনের স্বপ্ন।

মৃত্যুর আগে তিনি তা বাস্তবায়ন করে গেছেন।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)