আজহার লিমন, ঢাকা: বরা্বরই বাজেটের ৫ শতাংশ বরাদ্দের ঘরে ঘুরপাক খায় স্বাস্থ্যখাত। তার ওপর খরচও হচ্ছে না বিগত অর্থবছরের বরাদ্দের সবটুকু। অথচ সমানতালে বাড়ছে স্বাস্থ্য খাতের ভোক্তা ও সেবাদানকারীর অসন্তোষ। এমন অবস্থায় করোনাকালীন দ্বিতীয় বাজেটে ৭ শতাংশ বরাদ্দের যে চমকের কথা বলছে সরকার -তাতে প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হবে? বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢেলে সাজাতে হবে সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা। আজহার লিমনের প্রতিবেদন।
ডা. উম্মে হুমাইরা কানেতা
ডা. উম্মে হুমাইরা কানেতা। চাকরি জীবনের শুরু থেকেই করোনার জন্য উৎসর্গিত রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি। তার অভিযোগ, করোনা হাসপাতালের সম্মুখ সারির চিকিৎসক হওয়া সত্ত্বেও সম্মানি ভাতার তালিকায় নাম ওঠেনি। ডা. কানেতা বলছিলেন, তার মতো নানাভাবে অধিকারবঞ্চিত হওয়ার এমন অভিযোগ আছে স্বাস্থ্যখাতের মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন শ্রেণির অসংখ্য কর্মীর মাঝে।
তিনি বলেন, “গত ২৫ তারিখ মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন সাক্ষরিত হয়। যেখানে আমার মেডিকেল হসপিটালে ১৫৯ জনের চিকিৎসকের জন্য সম্মানি ভাতা হচ্ছে স্যাংসন হয়েছে। কিন্তু এই ১০০ জনের কেউই কিন্তু আমরা যারা তরুণ চিকিৎসক আছি ৯০ জন আমাদের কেউ ই না। অথচ আমরা ফ্রন্ট ফাইটারদেরও ফ্রন্ট ফাইটার। কারণ একটা রোগী প্রথমেই আমাদের হাতে আসে।”
অথচ গেল অর্থবছরে চিকিৎসকদের জন্য প্রণোদনা ও সম্মানি ভাতা বাবদ বরাদ্দ ছিলো ১০০ কোটি টাকা। এবং সার্বিকভাবে সরকারের স্বাস্থ্য ও সেবা বিভাগ মোট বরাদ্দের মোটামুটি এক তৃতাংশ অর্থ ব্যয় করতে পেরেছে। সরকারের ৫৮ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে এডিপি বাস্তবায়নে ৩৮ নম্বরে অবস্থান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের।
এমন অবস্থায় করোনাকালের দ্বিতীয় বাজেট ঘোষণার প্রেক্ষাপটে আবারও প্রশ্ন উঠেছে কতটা গুরুত্ব পাবে এ মন্ত্রণালয়? এরইমধ্যে গুঞ্জন ছড়িয়েছে, নতুন বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে থাকছে চমক। বিদায়ী অর্থবছরে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকার বরাদ্দ নিয়ে স্বাস্থ্যখাত পেয়েছিলো মোট বাজেটের ৫ দশমিক দুই শতাংশ। কিন্তু অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করে এবার স্বাস্থ্যখাতে বাজেটের ৭ শতাংশের বেশি বরাদ্দের খবর চাউর হয়েছে বাংলাদেশে। কিন্তু এটা কতটা আশাব্যাঞ্জক?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. নাসরিন সুলতানার শঙ্কা, স্বাস্থ্য খাতের নানা অব্যবস্থাপনা আর প্রয়োজন মূল্যায়নের অভাবে এবারও তেমন ব্যতিক্রমী কিছু থাকবে না স্বাস্থ্য বাজেটে।
ড. নাসরিন সুলতানা, চেয়ারম্যান, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
তিনি বলেন, “সরকার যে বাজেট বাড়াচ্ছে, বাড়াটাকে যে খুব স্বাগত করছি তা না। তার কারণ হলো যে বাজেট বরাদ্দ করা হয় কোন বছরই তো সে বাজেট শেষ করতে পারে না। যেখানে বাজেট খরচই করতে পারছি না সেখানে বাজেট বাড়ানো খুব একটা ফলপ্রসূ হবে বলে মনে হয় না। বরং তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন নিড বেইজড বাজেট। বাজেট আসলে কত দরকার। ঢালাওভাবে বাজেট না করে কোথায় কী ধরনের বাজেট দরকার সে নিডটাকে অ্যাসেস করে তারপর বাজেটাকে করা উচিত। এবং কোন খাতে সেটা। আমাদের এমনও খাত আছে যেখানে বাজেট প্রয়োজন কিন্তু বাজেট নেই। আবার কোন কোন খাত আছে বাজেট আছে কিন্তু খরচ করতে পারছে না।”
বাস্তবতাও হলো স্বাস্থ্যখাতের বেশিরভাগ অর্থই ব্যয় হয় নতুন নতুন অবকাঠামো নির্মাণের মত উন্নয়নের পেছনে। অপরদিকে নাগরিক স্বাস্থ্য, পুষ্টিসেবা, ডিজিটালাইজেশন বা গ্রামাঞ্চলে সেবার পৌছেঁ দেওয়ার মত জনস্বাস্থ্য বিভাগে বরাদ্দ শতকরা ১৭ ভাগের বেশি নয়। এমন অবস্থায় উচ্চ চিকিৎসা ব্যয়, সেবার অপ্রতুলতা নিয়ে মানুষের যে অসন্তোষ, সঙ্গে সেবাদানকারী তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের অধিকার, বঞ্চনা নিয়ে যে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, তার সমাধান কোথায়? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ডা. রশিদ-ই-মাহবুব মনে করেন, এর জন্য পুরোনা ধ্যান ধারণা থেকে বের হয়ে এসে ঢেলে সাজাতে হবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে।
রশিদ-ই-মাহবুব, সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
তিনি বলেন, “ম্যানেজমেন্ট এবং সাপ্লাই চেইনটা। এগুলো কিন্তু এখানে যথাপোযুক্ত নেই চাহিদা অনুসারে। নাই বলেই কিন্তু দরিদ্র রোগী বা মধ্যবিত্ত আরও দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং দারিদ্র বিমোচনের জন্য এটাই নজর দেয়া উচিত। সরকার কী করবে জানি না, সরকার কোন দিনই আমাদের জিডিপির একাংশও দেয় নি। যদি এটাকে রিবিল্ড না করে তাহলে যে টাকই দিন না কেন, আমাদের কাছে মনে হয় তা পর্যাপ্ত হবে না। আমরা ব্রিটিশ আমলে একরকম ছিলাম, পাকিস্তান আমলে একরকম বাংলাদেশ আমলে একরকম আছি। এতে পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু পরিবর্তন আর রিফর্মের মধ্যে ডিফারেন্স আছে। এই যে দায়িত্বটা রাজনীতিবিদরা যদি তাদের এজেন্ডাকে ইনক্লুড না করে তাহলে আমরা যতই বলি না কেন এটা হবে না।”
বড় ধরনের পরিবর্তনের জন্য গবেষণায় জোর দিয়েছেন এই দুই বিশেষজ্ঞ। কিন্তু গেল অর্থবছরে ‘সমন্বিত স্বাস্থ্য বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিলে’ বরাদ্দ ৫ কোটি থেকে বাড়িয়ে ১০০ কোটি টাকা করা হলেও এ খাত থেকে ১ টাকাও খরচ করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।