কিংবদন্তির প্রয়াণে কাঁদছে চীন
2021-05-26 09:55:52

গত ২২ মে ছিল চীনা জাতির এক গভীর শোকের দিন। এদিন  চীন তার দুজন সূর্যসন্তানকে হারিয়েছে। তাঁরা ছিলেন সত্যিকারের কিংবদন্তি। বিকেল একটা দুই মিনিটে চাইনিজ হেপাটোবিলিয়ারি সার্জারির জনক ডাক্তার উ মেং ছাও মৃত্যু বরণ করেন, এবং তাঁর পাঁচ  মিনিট পর বিশ্বের হাইব্রিড ধানের জনক ইউয়ান লং পিংও মারা যান।

ডাক্তার উ মেন চাও কেমন মানুষ ছিলেন? আজকের অনুষ্ঠানে আমরা তা জানতে চেষ্টা করব।

১৯২২ সালের ৩১ অগাস্ট উ মেং ছাও ফু চিয়ান প্রদেশের মিন ছিং জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি থুং চি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিত্সা বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৪৯ সালে স্নাতক হন। ১৯৯১ সালে তিনি চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সেসের একাডেমিশিয়ান হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালে জাতীয় সর্বোচ্চ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন। ২০১৯ সালে তিনি অবসরে যান।

২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭৫ বছরের মতো তিনি  চিকিত্সক হিসেবে কাজ করেন। সেসময়ে তিনি ১৬ হাজারের বেশি রোগীকে সুস্থ করেন। তাঁর নাম সাধারণ মানুষের কাছে অপরিচিত হলেও, চিকিত্সা জগত, বিশেষ করে লিভার সার্জারি বিভাগে তাঁর নাম জানেন না এমন মানুষ খুব একটা ছিল না।

তিনি চীনের হেপাটোবিলিয়ারি সার্জারি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তা। তিনি চীনে প্রথম লিভার সার্জারি করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে চীনে লিভার ক্যান্সার সার্জারির সফলতার হার ৫০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯০ শতাংশে পৌঁছায়। তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠি হয় বিশ্বের বৃহত্তম হেপাটোবিলিয়ারি রোগ নির্ণয় ও চিকিত্সা কেন্দ্র এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণালয়। বিশ্বের বৃহত্তম লিভার ক্যান্সার প্যাথোলজি স্পেসিমেন ব্যাংকও তাঁরই অনবদ্য এক অবদান। আর সার্জারি ক্ষেত্রে তাঁর সৃষ্ট অনেক রেকর্ড এখনো কেউ ভাংতে পারেনি।

ছোট বেলায় পরিবারের সাথে মালয়েশিয়া যান উ মেং চাও। কিন্তু ১৯৩৯ সালে তিনি একা একা চীনে ফিরে আসেন। যুদ্ধের সময়ে চীনাদের চিকিত্সা দিতে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিত্সা বিভাগে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর এক শিক্ষক বলেন, নৈতিকতায় বৌদ্ধের মতো না হলে, ডাক্তার হতে পারবে না, প্রযুক্তিতে দেবতার মতো না হলে, ডাক্তার হতে পারবে না। প্রিয় শিক্ষকের এ দীক্ষাকে উ মেং চাও তাঁর আজীবনের বিশ্বাসে লালীত করেন। তাই নৈতিকতা ও প্রযুক্তিতে তিনি উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছান।

তিনি একটানা ১২ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে একজন পুরুষের শরীর থেকে ৬৩ সিএম বড় একটি  টিউমার কেটেছেন এবং পাঁচ ঘন্টা সময় ধরে মাত্র চার মাস বয়সি এক মেয়ে শিশুর সার্জারি করেছেন। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে তিনি বার বার মানুষকে রক্ষা করেছেন। আর ওই চার মাস বয়সি মেয়েটি এখন বড় হয়ে একজন নার্স হয়েছেন।

ছিয়ান্নব্বই বছর বয়স পর্যন্ত তিনি সার্জারি করেন। তিনি বলেন, শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আমি অপারেটিং টেবিলের কাছে থাকতে চাই। বর্তমানে হেপাটোবিলিয়ারি বিভাগের চিকিত্সকদের ৮০ শতাংশই  উ মেং চাওয়ের শিক্ষার্থী।

২০১৮ সালে একটি সাক্ষাত্কারে উ মেং চাও একটি গল্প বলেন। ভাটার সময়ে ছোট ছোট মাছগুলো সৈকতে আটকা পড়ে। তীব্র রোদে মনে হয়, কেবল মৃত্যুই তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এসময় একজন শিশু একটি একটি করে মাছগুলোকে সাগরে ছেড়ে দিতে থাকে। তখন পাশে থাকা একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি শিশুটিকে জিজ্ঞেস করেন, এত বেশি মাছের সবগুলোকে তুমি কি উদ্ধার করতে পারবে? শিশুটি মাছদের উদ্ধার করতে করতে বলে যে, আমি জানি না কতগুলো মাছকে রক্ষা করতে পারবো, তবে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।

উ মেং চাও এ গল্পের মাধ্যমে নিজের বিশ্বাসকে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর জন্য প্রতিটি রোগী ওই মাছের মতো। তিনি সকলকে রক্ষা করতে পারবেন না, তবে কোন সম্ভবনাকেই তিনি পরিত্যাগ করতে পারেন না। তাঁর সাহায্যে কোন কোন মানুষকে বাঁচিয়ে তুলে।

আকাশে ভাসমান তারকারাজির মধ্যে ১৭৬০৬ নম্বর তারকাটির নাম উ মেং চাও রাখা হয়েছে। এ বিশ্বে তিনি আর নেই, তবে তাঁর নাম চিরদিনের মতো থাকবে, তার মনোভাব চিরদিনের মতো থাকবে। তাঁর মতো চিকিত্সকও এ বিশ্বে থাকবে। তাঁর প্রয়াণে চীন হারালো সত্যিকারের একজন কিংবদন্তি। তিনি এখন আকাশের একটি তারকা। তবে, তাঁর আলোতে চীন আরো এগিয়ে যেতে পারবে। (শিশির/এনাম/রুবি)