চীনের শ্রবণ-প্রতিবন্ধীদের প্রশিক্ষণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও সেখানকার শিক্ষার্থীদের গল্প
2021-05-24 18:11:25

প্রতিবন্ধীরা আমাদের সমাজেরই একটি অংশ। যেসব দেশের অবস্থা যত উন্নত, সেসব দেশে প্রতিবন্ধীদের প্রশিক্ষণ ও যত্নের ব্যবস্থা তত ভালো। চীন বিশাল ও জনবহুল দেশ। চীনে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যাও বেশি। আজকের ‘বিদ্যাবার্তা’য় আমরা থিয়ানচিন পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের গল্প তুলে ধরবো।

থিয়ানচিন পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রবণ-প্রতিবন্ধী নৃত্যদল ৩০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি চীনের সর্বপ্রথম ও বিশ্বের চতুর্থ শ্রবণ-প্রতিবন্ধী কারিগরি একাডেমি। ১৯৯১ সাল থেকে থিয়ানচিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুত্ ও মেশিন শাখা একাডেমির প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রশিক্ষণ ক্লাস চালু করে। তখন থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা শুরু হয়।

প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিতে এটি বেইজিংয়ের ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। একাডেমির শিক্ষাকেন্দ্রটি ৫ তলায়। সেখানে দীর্ঘ একটি দেয়ালে বিভিন্ন শ্রেণীর স্নাতক শিক্ষার্থীদের ছবি প্রদর্শন করা হয়। একাডেমির শিক্ষকরা হাসিমুখে শিক্ষার্থীদের সাথে ছবি তোলেন। তাঁদের ছবিগুলোতে দেখা যায়, ধীরে ধীরে তাদের কালো চুল সাদা হয়েছে।

১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চীনের শানসি প্রদেশের থাইকু জেলার শিক্ষার্থী ছেন হুয়া মিং থিয়ানচিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ কারিগরি একাডেমিতে ভর্তি হন। তবে ক্লাসের ১১ জন শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর মধ্যে তিনি একমাত্র ছেলে যে ইশারা ভাষা বুঝতে পারে না। কারণ, জন্মগ্রহণের সময় ছেলে ছেন স্বাভাবিক মানুষ ছিল। তবে ৯ বছর বয়সে মাম্পসে আক্রান্ত হওয়ার কারণে সে শ্রবণশক্তি হারায়। যখন সুস্থ হয়ে ওঠে, তখন থেকেই দেখা যায় যে, সে বাবা-মায়ের কথা পুরোপুরি শুনতে পারে না। আসলে ছোটবেলা থেকে ছেন হুয়া মিং মেধাবী ছাত্র ছিল। তাঁর শ্রবণশক্তি হারিয়ে গেলেও, সে কথা বলতে পারে। তাই আগের স্কুলের পড়াশোনা অব্যাহতভাবে চলছে, চোখ ও হাত দিয়ে কানের অভাব দূর করে সে। সে প্রতিদিন মনোযোগ দিয়ে ক্লাসে শিক্ষকদের লেখা দেখে এবং কোনো বিষয় বুঝতে না পারলে শিক্ষকের সাথে লেখার মাধ্যমে ভাব বিনিময় করে। অনেক পরিশ্রমের ফসল হিসেবে সে পরীক্ষায় ভালো ফল করে এবং কাওখাও পরীক্ষায় পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য চেষ্টা করে। তখন শিক্ষকরা বিশ্বাস করতে পারেননি যে, সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে। কারণ কাওখাও পরীক্ষার প্রতিযোগিতা কঠিন। স্বাভাবিক ছাত্রছাত্রীরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেতে খুব পরিশ্রম করে। সেখানে একজন শ্রবণ-প্রতিবন্ধী হিসেবে সে কিভাবে সফল হবে?

১৯৯২ সালের এপ্রিল মাসে চীনা প্রতিবন্ধী-শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যবস্থা পরীক্ষামূলক চালু হয়। তখন শুধুমাত্র থিয়ানচিন, শানসি, শানতুং, চিয়াংসু এবং চিলিনসহ কয়েকটি এলাকায় শ্রবণ-প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী গ্রহণ করতো। ছাত্র ছেন এ খবর পেয়ে থিয়ানচিনে গিয়ে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষায় অংশ নেয়। যখন সে ভর্তিপত্র হাতে পায়, তখন নিজেই অবাক হয়। ভর্তির পর সে মনোযোগ দিয়ে ইশারা ভাষা শিখতে শুরু করে এবং মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ভালো করে ইশারা ভাষা ব্যবহার করতে সক্ষম হয়।

২০ বছর পর এই ছাত্রই থিয়ানচিন শহরের শ্রবণ-প্রতিবন্ধী পরিষদের মহাপরিচালক নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে কয়েকজন পেশাদার বিশেষজ্ঞ ইশারা ভাষা দিয়ে চীনের জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে চীনাদের মুগ্ধ করেছিলেন।

শিক্ষক ওয়াং মেই লিন শ্রবণ-প্রতিবন্ধী একাডেমির প্রশাসনিক বিভাগের উপপরিচালক। টানা ৭ বছর ধরে তিনি প্রতিবন্ধীদের প্রশিক্ষণ-পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করছেন এবং নিজে ৬ পর্যায়ের মোট ৮৩ জন শ্রবণ-প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম পর্যায়ের ৬ জন শ্রবণ-প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ভর্তি হয় এবং ১৯৯৭ সালের নভেম্বর মাসে থিয়ানচিন পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রবণ-প্রতিবন্ধী একাডেমি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এমন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের তিনি স্বাক্ষী। কেবল স্বাক্ষী নয়, বরং প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য আলাদা রেকর্ডবুক তৈরি করেন, তাদের পড়াশোনার গুরুত্বপূর্ণ দলিল কপি করেন এবং স্নাতকপত্র ও পুরস্কারপত্রসহ বিভিন্ন কাগজপত্র সংরক্ষণ করে বিভিন্ন নোটস লেখেন। ৭ বছরের মধ্যে তিনি মনোযোগ দিয়ে বড় বড় ফাইল তৈরি করেছেন। চলতি বছর ৬৭ বছর বয়সী শিক্ষক ওয়াং অবসর নিয়েছেন। রেকর্ডবুক সম্পর্কে তিনি বলেন, এটি ইতিহাস!

রেকর্ডবুকে ছাত্র ছেন হুয়া মিংয়ের ছবি দেখে শিক্ষক ওয়াং অনেক খুশি। কারণ ছাত্র ছেন তাঁর মনে গভীর দাগ কেটেছে। যখন শ্রবণ-প্রতিবন্ধী কলেজ থেকে স্নাতক হয়, তখন ছাত্র ছেন অন্যান্য স্বাভাবিক ছাত্রছাত্রীর মতো মেশিন মেজর নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়। তবে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করে বলে যে, শ্রবণপ্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা ভালো হলেও স্বাভাবিক ছাত্রছাত্রীদের সাথে লেখাপড়া করা অনেক মুশকিলের ব্যাপার। তখন শিক্ষক ওয়াং তাদের আশা পূরণে অনেক চেষ্টা চালান। অবশেষে ছাত্র ছেনসহ তিন জন শিক্ষার্থী স্বাভাবিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ক্লাসের সময় কারিগরি কলেজের একজন শিক্ষকও তাদের সাথে থাকতেন। তাদের কোনো প্রশ্ন থাকলে শিক্ষক ইশারা ভাষায় তা ব্যাখ্যা করতেন। এ সম্পর্কে ছাত্র ছেন বলেন, “শিক্ষক ওয়াং আমার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ও স্নেহময় একজন মানুষ। তাঁকে ছাড়া আমার উচ্চশিক্ষা গ্রহণ অসম্ভব ব্যাপার ছিল। তিনি সবসময় প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের নিজের সন্তান হিসেবে যত্ন নিতেন। এটা আমাদের জন্য অতি সৌভাগ্যের ব্যাপার।’

৩০ বছর পরে থিয়ানচিন পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ কারিগরি একাডেমি ৪টি বিভাগের কলেজ থেকে ৩টি মাস্টার্স ডিগ্রীর বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। যুবক শিক্ষক ওয়াং সিয়াও  গত ১০ বছর ধরে শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ কোর্সের ক্লাস নিচ্ছেন। বছরে ১০০ জন শিক্ষার্থী গ্রহণ করা হয় এখানে। ফলে শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন হাজার ছাড়িয়েছে। যদিও কাগজে লিখে রাখেননি, তাঁর স্মৃতিতে অনেক ছাত্রছাত্রীর গল্প আছে। তিনি তাদের কয়েকজনের গল্প বলেন।

শিক্ষক ওয়াংয়ের স্মৃতি প্রখর। বিভিন্ন শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের তথ্য তিনি সহজে মনে রাখেন। ইশারা ভাষাও অনেক বেশি জানেন। তাই শ্রবণপ্রতিবন্ধীরা তাঁকে অনেক সম্মান করে। যদিও দৈনিক অফিসের কাজে তাকে অনেক ব্যস্ত থাকতে হয়, তবে ছাত্রছাত্রীদের কেউ অসুস্থ হলে তিনিই তাদেরকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। এ সম্পর্কে শিক্ষক ওয়াং বলেন, ‘শ্রবণপ্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের কারুর যদি শুধু জর হয়, তাহলে অন্যান্য শিক্ষক তাদের নিয়ে হাসপাতালে যেতে পারেন। তবে গুরুতর অসুস্থ হলে আমি তাদের সাথে যাই। না হলে ভুল বোঝাবুঝির কারণে চিকিত্সায় ব্যঘাত ঘটতে পারে।’

শিক্ষক ওয়াংয়ের বর্ণনা অনুসারে সংবাদদাতারা কয়েকজন শ্রবণপ্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীর সাক্ষাত্কার নিয়েছেন। মেয়ে লিয়াং ই ফান ২০১৬ সালে চীনের হ্যনান প্রদেশের উচ্চবিদ্যালয় থেকে থিয়ানচিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। অন্যান্য শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের তুলনায় তার মুখের ভাষা খানিকটা স্পষ্ট। তবে উচ্চারণ বেশ স্পষ্ট নয়। শ্রবণপ্রতিবন্ধী ডিজাইন শিল্পকর্ম কার্যালয়ের কর্মী হিসেবে সে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের শিল্প প্রদর্শনীর জন্য ব্যস্ত।

শ্রবণপ্রতিবন্ধী ছাত্র উ জুন ওয়ে প্রকৌশল মেজরের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। স্নাতক হওয়ার পর কর্মসংস্থানের ব্যাপারে আশাবাদী সে। কারণ, তাঁর মেজরের চাহিদা আছে এবং উন্নয়নের সুপ্তশক্তিও আছে।

শ্রবণপ্রতিবন্ধী নারী ওয়াং হুই ২০১৫ সালে শ্রবণ প্রতিবন্ধী একাডেমির কাপড় ডিজাইন বিভাগ থেকে স্নাতক হন। তাঁর জন্মস্থান থিয়ানচিন শহরে। তাই স্নাতক হওয়ার পর তিনি থিয়ানচিনেই থেকে যান। স্থানীয় প্রতিবন্ধী পরিষদের সহায়তায় তিনি নিজের চাকরি পেয়েছেন। এখানে প্রতিবন্ধীদের সহায়তার পাশাপাশি স্থানীয় প্রবীণদের যত্নও নেওয়া হয়। এখানে ১৪০ জনেরও বেশি প্রবীণ আর ৫০ জন প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রী একসাথে বসবাস করে। এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ম্যাডাম থিয়ান লি নিজের উদ্যোগে এ প্রতিষ্ঠান চালু করেন এবং ৪০টিরও বেশি প্রতিবন্ধী-বাচ্চাকে আশ্রয় দেন।

ওয়াং হুই এ প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার সময় ম্যাডাম থিয়ান তাঁকে বললেন, ‘এখানকার বেতন খুবই কম। তুমি কি থাকতে চাও?’ তখন ওয়াং হুই বিনাদ্বিধায় চাকরি গ্রহণ করেন। প্রতিষ্ঠানের প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের কাপড়চোপড় পরিষ্কারের কাজে পরামর্শ দেন তিনি। বাচ্চা ছোট হলেও ধাপে ধাপে স্যুট ইস্ত্রি করা পর্যন্ত শিখে নেয়। বাচ্চাদের কাছে ওয়াং হুই যেন মাতার মতো। এখানকার বাচ্চারা কোনো-না-কোনোভাবে বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী হয়েছে। তবে ওয়াং হুই আন্তরিকভাবে তাদের যত্ন নেন এবং জীবনযাপনে তাদের সহায়তা দেন। তাঁর সাহায্যে প্রতিষ্ঠানের লন্ড্রির দোকান শিগগিরি চালু হবে।  লন্ড্রির দোকানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বাচ্চাদের নৃত্য প্রদর্শনী হবে। এ জন্য বাচ্চাদের প্রশিক্ষণ দেন তিনি। প্রতিবন্ধীদের বাচ্চাদের প্রশিক্ষণ কোর্স নিয়ে তিনি নিয়মিতভাবে ভিডিও শুটিং করেন এবং সোশাল মিডিয়ায় তাদের নৃত্যের চর্চা শেয়ার করেন। কোনো ভঙ্গি ভুল হলে তিনি বারবার ঠিক করার জন্য ধৈর্য সহকারে বুঝিয়ে দেন। যদিও তিনি নিজেই শ্রবণপ্রতিবন্ধী, তবে কখনো অলস বসে থাকেন না। চীনের একটি প্রবাদ আছে, যাতে শিক্ষকদের মোমবাতি সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। শ্রবণপ্রতিবন্ধী একাডেমির শিক্ষকরা ক্ষুদ্র মোমবাতির মতো নিজেদের ভূমিকা পালন করে যাবেন বলে আশা প্রকাশ করেন ওয়াং হুই’র শিক্ষক লি জি কাং।

সুপ্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়,আজকের অনুষ্ঠান শেষ প্রান্তে চলে এলো।আমাদের অনুষ্ঠান শুনতে মিস করলে আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে সক্ষম,আমাদের ওয়েবসাইটের ঠিকানা Bengali.cri.cn,তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি,সবাই ভালো থাকুন,সুন্দর থাকুন,আগামী সপ্তাহে একই দিনে একই সময় আবার কথা হবে,যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)