বাসন্তি মেয়ের গল্প; যার জীবন কবিতার মতো
2021-05-21 19:12:53

বাসন্তি মেয়ের গল্প; যার জীবন কবিতার মতো

বাসন্তি মেয়ের গল্প; যার জীবন কবিতার মতো_fororder_huyang

এই জায়গার বাতাসে পাইন গাছের সুগন্ধ ভরে আছে। এই জায়গার ৮৩.৮ শতাংশই বনভূমি। এই জায়গাটি ‘চীনের  বন শহর’ হিসেবে পরিচিত।

হু ইয়াং নামে একটি মেয়ের বাসা এখানে। জায়গাটি হেই লুং চিয়াং প্রদেশের ই ছুন শহর।

এখানে বসন্তকাল যেন আরো দীর্ঘ। পাহাড়ের ছোট নদীতে বরফও দেখা যায়। হু ইয়াং পাহাড়ে গিয়ে বনের সবজি তোলেন, মাঝে মাঝে বনের কাঠবিড়ালকে কিছু খাওয়ান।

হু ইয়াং ১৯৯৫ সালের পর জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি শর্ট ভিডিও প্ল্যাটফর্ম- টিকটকের একজন ব্লগার। প্রতিদিন ৬ লাখেরও বেশি নেট ব্যবহারকারী মোবাইলফোনে তাঁর বনের ‘ধীরগতির জীবন’ উপভোগ করে।

 

নরম কণ্ঠ ও মিষ্টি হাসিমুখের হু ইয়াং যেন- পাশের বাড়ির মিষ্টি মেয়ের মতো। তবে, তাঁর চোখেমুখে কিন্তু দৃঢ় সংকল্পও বোঝা যায়। ২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশের পর হু ইয়াং সহপাঠীদের মত বড় শহরে একটি চাকরি খোঁজার চেষ্টা করেন নি। বরং নিজের জন্মস্থানে ফিরে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

 

হু ইয়াং বলেন, আমি স্বাধীন জীবনকে পছন্দ করি, আমি বিভিন্ন নতুন জিনিস ও বিষয় উপভোগ করতেও পছন্দ করি। চীনে টিকটক খুব জনপ্রিয়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা ভাষা শিখতেন। তাই তিনি ভালোভাবে ভাষা ও অক্ষর দিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেন। এজন্য তিনি একজন ব্লগার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

 

বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন অনেক সহজ, কিন্তু সমাজে প্রবেশের পর হু ইয়াং অনেক নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। তিনি বলেন, বনে অনেক পথ আছে, যেন স্নাতক ছাত্রীর সম্মুখীন অনেক বাছাইয়ের মত, আমি নিজেই কিন্তু একটি কঠিন পথ বাছাই করেছি। আসলে মনে অনেক উদ্বেগ ছিল।

 

হু ইয়াং আরো বলেন, শুরুর দিকে আমি ক্যামেরার সামনে পরিবেশনা করতে জানতাম না। অতি সহজ একটি বাক্য কিন্তু অনেক বার রেকর্ড করতে হতো। শীতের দিনে ভিডিও শুটিং করতে গিয়ে হাত যেন অচল হয়ে যায়।

 

তবে জন্মস্থানের প্রতিটি ঘাস, প্রতিটি গাছ হু ইয়াংকে ভিডিও তৈরি করার অনেক আইডিয়া দেয়। প্রাকৃতিক বন সংরক্ষণ প্রকল্পের স্থিতিশীল উন্নয়ন এবং বনে ব্যবসায়ীক গাছ কাটা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে ই ছুন শহরটি আরো প্রাণচঞ্চল হয়েছে।

 

হু ইয়াং তাঁর ভিডিওতে সবাইকে জানান: তার স্বপ্ন আকাশের শেষে সাদা মেঘের মতো, রাতে তা আগুনের মত লাল হয়ে যায়। বসন্তকালে বুনো সবজি, গ্রীষ্মকালে ব্লুবেরি ও চেরি খেয়ে শেষ করা যায় না। আর শরত্কাল হল মাশরুম তোলার সবচেয়ে উপযোগী ঋতু।

 

হু ইয়াং কাছের সব সৌন্দর্য রেকর্ড করেছেন। একটি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তিনি জন্মস্থানের সৌন্দর্য সবার কাছে তুলে ধরছেন। জন্মস্থানের সুন্দর দৃশ্য ছাড়া হু ইয়াং তাঁর দৈনন্দিন জীবন এবং কৃষি কাজ করার ভিডিও পোস্ট করেন। কৃষকের প্রিয় সস বানানো, ভুট্টা তোলা ইত্যাদি। তিনি দুই শতাধিক শর্ট ভিডিও পোস্ট করেছেন। এভাবে চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাধারণ লোকজনের দৈনন্দিন জীবন সবার কাছে পরিচিত হয়েছে।

 

হু ইয়াং বলেন, ছোটবেলায় তিনি দেখেছেন যে- লোকজন গাড়ির মাধ্যমে বনের কাঠ শহরে পাঠাত। পরে এমন দৃশ্য আর দেখা যায় না। এখন আরো বেশি স্থানীয় মানুষ বন চাষ ও পশু পালনের কাজ করছেন।

 

সমৃদ্ধ বনজ সম্পদ এবং জমির কল্যাণে ই ছুনের মানুষ প্রাকৃতিক সুবিধাকে শিল্প ও অর্থনীতির সুবিধায় পরিণত করার চেষ্টা করছে। হু ইয়াং গত বছর থেকে তাঁর ই-কমার্স কাজও শুরু করেছেন, তিনি অনলাইনে তাঁর জন্মস্থানের কৃষিজাত দ্রব্য বিক্রি করছেন।

 

আরো ভালো ও উচ্চ গুণগতমানের পণ্য সরবরাহের জন্য হু ইয়াং মাশরুম চাষ শিখেছেন। হু ইয়াং-এর চেষ্টার ফল পাওয়া শুরু হয়েছে। আস্তে আস্তে হু ইয়াং-এর ভিডিও-এর ফলোয়ারের সংখ্যা আরো বাড়ছে। তিনি আগে এক দিনে শুধু কয়েক কেজি মাশরুম বিক্রি করতেন। এখন প্রতিদিন কয়েকশ’ কেজি মাশরুম বিক্রি করতে পারেন।

 

নেট ব্যবহারকারীরা কমেন্টে নানা কথা লিখেছেন। একজন লিখেছেন, তোমার ভিডিও-এর মাধ্যমে ব্যস্ততার শহুরে জীবনের মধ্যে আমি কিছুটা শান্তি পেয়েছি। কেউ লিখেছেন, তোমার ভিডিও দেখে আমি জন্মস্থানকে মনে করি। অনেক লোক এসব ভিডিও-এর মাধ্যমে হু ইয়াংকে চিনতে পেরেছেন। এর সঙ্গে অনেকেই তাঁর ভিডিও’র মাধ্যমে জন্মস্থানের স্বাদ পাওয়া শুরু করেছে।

 

চীনের হেই লুং চিয়াং প্রদেশে ই-কমার্সের কারণে অনেক গ্রামীণ এলাকা আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। আরো বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা স্নাতকের পর জন্মস্থানে, ছোট ছোট গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। হেই লুং চিয়াং প্রদেশের বাণিজ্য বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালে হেই লুং চিয়াং প্রদেশে গ্রামীণ এলাকার ই-কমার্সের দ্রুত প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বাণিজ্যের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। ২০২০ সালে গ্রামীণ এলাকার অনলাইন বিক্রির পরিমাণ ১৫ বিলিয়ন ইউয়ানেরও বেশি হয়। যা আগের বছরের তুলনায় ২২.৭ শতাংশ বেশি।

 

কবিতার মত প্রকৃতিতে জীবনযাপন করা হল বর্তমানে হু ইয়াং-এর জীবনের বর্ণনা। তাঁর জন্মস্থানে বসন্তকাল এসেছে, তিনি নিজের মনের মতো সুন্দর জীবনও খুঁজে পেয়েছেন।

 

তিব্বতে বিভিন্ন স্থানের যুবকদের স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে

চীনে এমন এক গোষ্ঠীর মানুষ আছেন, তাঁরা চীনের তিব্বতের সুন্দর দৃশ্য ও সংস্কৃতিকে ভালোবাসার কারণে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তিব্বতে এসেছেন। নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন বা আরো সুন্দর জীবন খুঁজে পাওয়ার জন্য তাঁরা জন্মস্থান ত্যাগ করে তিব্বতে বসবাস করছেন। নতুন তিব্বত নির্মাণে তাঁদের অবদানও আছে।

 

তিব্বতের রাজধানীতে বাকুও রাস্তা স্থানীয় বিখ্যাত একটি বাণিজ্য রাস্তা। সেখানে অনেক দোকান আছে, প্রতিটির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যও আছে। এর মধ্যে একটি সংস্কৃতি-বিষয়ক দোকান অনেক পর্যটককে আকর্ষণ করে।

 

লাল ইট দিয়ে তৈরি একটি দেয়ালে তিব্বতের বৈশিষ্ট্যময় ছাগল পালক মেয়ের ছবি আঁকা আছে। এই দোকানের মালিক কু ওয়েই ওয়েই ক্রেতাদের জন্য চুড়ি তৈরি করতে ব্যস্ত আছেন। তাঁর কঠিন ও বলিষ্ঠ হাতে অল্প সময়ের মধ্যে সুন্দর একটি চুড়ি সম্পন্ন করা যায়।

 

কু ওয়েই ওয়েই বলেন, তিব্বতে আসার শুরুর দিকে, স্থানীয় ভৌগলিক অবস্থা এবং আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে আমার অনেক সময় লেগেছে, শুরুতে কিছুটা অসুস্থতাও ছিল, তবে এখন অভ্যস্ত হয়েছি। কু ওয়েই ওয়েই তিব্বতে পাঁচ বছর ছিলেন। এখন তিব্বত যেন তাঁর দ্বিতীয় জন্মস্থানের মত।

 

কু ওয়েই ওয়েই-এর চুল ছোট। একাই দোকানে থাকেন। তাঁর মুখ দেখে বোঝা যায় তিনি কিছুটা ক্লান্ত। কিন্তু ক্রেতা দোকানে আসলে তাঁর সব ক্লান্তি চলে যায়। চীনের শ্রম দিবসের ছুটি থেকে এখন পর্যন্ত তিনি প্রতিদিন রাত দুইটা-তিনটার সময় ঘুমাতে যান। কারণ, রাতে চুড়ি তৈরি করতে হয়, যাতে দিনে তা বিক্রি করা যায়।

 

৪০ বর্গমিটারের ছোট দোকানে তিব্বতের বৈশিষ্ট্যময় অনেক পণ্য আছে। খুব পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন, কোনো ধূলি নেই। কু ওয়েই ওয়েই বলেন, এই পাঁচ বছরে ব্যবসা অনেক সুষ্ঠু হয়েছে, তিব্বতের পর্যটন শিল্পের দ্রুত উন্নয়নের কল্যাণে আমি বেশি মুনাফা পাচ্ছি।

 

সিপিসির অষ্টাদশ জাতীয় কংগ্রেসের পর থেকে তিব্বত ‘বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয়  স্থান’ হিসেবে নির্মাণ করার লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যময় পর্যটন প্রকল্প উন্নয়ন করেছে। যেমন ঘোড়া-দৌড় প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। এতে বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ এখানে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ পাচ্ছে।

 

এদিকে হ্য পেই প্রদেশের যুবক কুও চিয়াং সিয়াও ২০১০ সালে তিব্বতে এসে একটি মদ তৈরির কারখানা স্থাপন করেছেন। তিনি বলেন, এর আগে তিনি অনেক দিন চাকরি করেছিলেন, তাই তাঁর কিছু অর্থ ছিল। ২০১৮ সালে তিনি তিব্বতের বিশেষ বার্লি শস্য দিয়ে হুইস্কি তৈরি করার চেষ্টা শুরু করেন।

 

তিব্বতে থাকা ও তিব্বতের বিশেষ হুইস্কি তৈরি করা হল কুও চিয়াং-এর স্বপ্ন। তিনি তিব্বতের প্রতি খুব কৃতজ্ঞ বোধ করেন। তিনি বলেন, তিব্বত আমাকে উন্নয়নের সুযোগ দিয়েছে, আমি এখানে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারি।

 

অন্যদিকে সুয়েই চেন নিং নামে একজন যুবক তিব্বতের রাজধানী লাসায় একটি পেট হাসপাতাল স্থাপন করেছেন। তিনি বলেন, তিব্বত যদিও মালভূমি, তবে এখানে সুযোগ আছে, চেষ্টা করলে সবখানে সুযোগ পাওয়া যায়।

 

বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সময় সুয়েই চেন নিং লাসা ভ্রমণ করেন, আবার এসে তিনি দেখেন, শহরের বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। উঁচু ভবন অনেক বেশি হয়েছে, রাস্তাঘাট খুব চওড়া ও পরিষ্কার, জীবনের অবকাঠামো সবই আছে।

 

শুরুর দিকে সুয়েই চেন নিং লাসার এক পশুর হাসপাতালে ডাক্তার হিসেবে কাজ করেছিলেন। কয়েক মাস কাজের মাধ্যমে তিনি স্থানীয় পশু-পাখির বাজার সম্বন্ধে ভালো জানতে পারেন। জীবনযাপনের মান উন্নয়নের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের পশুর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। পশু-পাখির হাসপাতালের চাহিদাও অনেক বেড়েছে। এর ফলে সুয়েই চেন নিং একটি পশু-পাখির হাসপাতাল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন।

 

তিনি বলেন, অনেক মানুষ পশু-পাখিকে নিজের পরিবারের সদস্য হিসেবে দেখে, বিশ্বাস করি। অদূর ভবিষ্যতে তিব্বতের গৃহপালিত পশু-পাখি শিল্প অনেক সমৃদ্ধ হবে।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)