চীনের বিখ্যাত অনুবাদক স্যু ইউয়ান ছোংয়ের গল্প
2021-05-17 15:02:01

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনগণের মধ্যে আদান-প্রদান ও বিনিময়ের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। দোভাষী ও অনুবাদকরা এক ভাষার মানুষের সঙ্গে অন্য ভাষার মানুষের ভাব বিনিময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকেন। আজকের অনুষ্ঠানে চীনের বিখ্যাত ইংরেজি অনুবাদক স্যু ইউয়ান ছোংয়ের গল্প তুলে ধরবো।

২০২১ সালের ১৮ এপ্রিল অধ্যাপক স্যু ইউয়ান ছোং বেইজিংয়ে তাঁর শততম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করেন। চীনা যুবকদের কাছে অধ্যাপক স্যু খানিকটা অপরিচিত নাম। তবে, অনেকে চীনের কেন্দ্রীয় টেলিভিশনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ‘আবৃত্তিকার’-এর কারণে তাকে চেনেন।

১০০ বছর আগে তিনি প্রাচীনকালের দাঙ্গাহাঙ্গামার সময় জন্মগ্রহণ করেন। যুদ্ধ চলাকালে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যৌথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং ২৭ বছর বয়সে ফ্রান্সে গিয়ে পড়াশোনা করেন। চীনের সুবিখ্যাত লেখক ছিয়ান চুং শু তাঁর শিক্ষক ছিলেন, চীনের পদার্থবিজ্ঞানী ইয়াং জেন নিং ছিলেন তাঁর সহপাঠী এবং চীনের ইংরেজি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান নিউ ওরিয়েন্টালের প্রেসিডেন্ট ইউ মিন হুং ছিলেন তাঁর ছাত্র। ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার দক্ষ অনুবাদক হিসেবে সারা জীবনে তিনি শতাধিক বই অনুবাদ করেছেন এবং তাঁর অনূদিত বই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্রি হয়েছে। তাঁর অনুবাদের কারণে হ্যামলেট, ম্যাডাম বোভারি এবং রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট চীনা পাঠকদের কাছে পরিচিতি পেয়েছে। তাঁর অনুবাদের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর পাঠকরা প্রাচীনকালে চীনের বিভিন্ন রাজবংশ আমলের সুপরিচিত চীনা কবি লি বাই, তু ফু আর বাই জু ইকে জানতে পেরেছে।

চীনের বিখ্যাত অনুবাদক স্যু ইউয়ান ছোংয়ের গল্প_fororder_xyc

অধ্যাপক স্যু’র শততম জন্মবার্ষিকীর সময় তিনি সংবাদদাতাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তাঁর বাসা খুব বড় নয়। মাত্র ৭০ বর্গমিটারের একটি ছোট আপার্টমেন্ট তিনি বিগত ৪০ বছর ধরে বাস করছেন। বাসার নানান জায়গায় বহু বই জমে আছে। সংবাদদাতাকে দেখে তিনি একটি সুট গায়ে দেন। সব ঠিক করার পর তিনি পুরাতন সোফায় বসে নিজের গল্প বলতে শুরু করেন।

ছোটবেলায় ইংরেজি ভাষা শেখার অভিজ্ঞতা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘শুরুর দিকে ইংরেজি অক্ষর ঠিকভাবে পড়তে পারতাম না। তখন সবসময় ভুল উচ্চারণ করতাম। তাই ইংরেজি ভাষার প্রতি আগ্রহ খুবই কম ছিল। তবে যখন উচ্চবিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে ৩০টিরও বেশি ইংরেজি প্রবন্ধ মুখস্ত করে ফেলি, তখন ইংরেজি ভাষার প্রতি আমার আগ্রহ সৃষ্টি হয়।’ তখন অধ্যাপক স্যু’র চাচা ইংরেজি ভাষায় চীনা অপেরা অনুবাদ করতেন। ইংরেজি ভাষায় চীনা অপেরার প্রদর্শনী ইউরোপ ও আমেরিকায় ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তখন। যুবক স্যু’র চোখে চাচা ছিলের দেবতার মতো। তিনি আরও মনোযোগ দিয়ে ইংরেজি ভাষা শিখতে থাকেন।

১৯৩৮ সালে ১৭ বছর বয়সে স্যু ইউয়ান ছোং দক্ষিণ-পশ্চিম যৌথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তখন অধ্যাপক ইয়াং চেন নিং, যিনি পরে পদার্থবিজ্ঞানী স্যু’র সহপাঠীতে পরিণত হন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে তত্কালে চীনের সবচেয়ে সেরা ও শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। চীনের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক লেখক চু জি ছিং, শেন ছুং ওয়েন, নাট্যকার ছাও ইয়ু এবং ইংরেজির অধ্যাপক ছিয়ান চুং শু ছিলেন তেমন ধরনের পণ্ডিত ব্যক্তি। এখানে পড়াশোনার কারণে শেক্সপিয়ার, পুশকিন, গ্যাটে ও তলস্তয়সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুপরিচিত লেখকদের লেখার সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে জানার পর তার ইংরেজি ভাষা শেখার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। অনুবাদকের কাজ সম্পর্কে অধ্যাপক স্যু বলেন, মানুষের জীবনের সবচেয়ে মজার ব্যাপার সৌন্দর্য সৃষ্টি করা ও আবিষ্কার করা। তাই বিভিন্ন বিদেশি ভাষার বাক্য সুন্দরভাবে অনুবাদ করা বা অনুবাদের পর আসল ভাষার চেয়ে আরও সুন্দর তাত্পর্য বের করা অনুবাদকের জন্য বড় কাজ।

১৯৪১ সালে স্যু’র জন্য ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ বর্ষ। জাপানি আগ্রাসী বাহিনী চীনের ওপর আগ্রাসন চালাচ্ছিল। চীনকে সাহায্যের জন্য যুক্তরাষ্ট্র তখন ‘ফ্লাইং টাইগারস’ দল পাঠায়। তখন ইংরেজি অনুবাদকদের প্রয়োজন হয়। সেই সময় তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র স্যুও আবেদন করেন। জনাব সুন ইয়াত সানের জন্মগ্রহণের ৭৫তম বার্ষিকীতে যখন তার ‘গণনীতির চিন্তাধারা’ অনুবাদ করা হয়, তখন সেই অনুবাদকের কথা বিদেশিরা বুঝতে পারেননি। সেই সময়  ছাত্র স্যু অনুবাদ করে বলেন, সুনের চিন্তাধারার অর্থ হল ‘of the people, by the people and for the people’। তাঁর কথা শুনে বিদেশি অতিথিদের সবাই তা বুঝতে পারেন।

চীনের বিখ্যাত অনুবাদক স্যু ইউয়ান ছোংয়ের গল্প_fororder_xyc3

তারপর তিনি তত্কালীন মার্কিন সেনাপতির জন্য সামরিক গোয়েন্দাসংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ইংরেজিতে অনুবাদ করার দায়িত্ব পালন করেন। মাত্র ২০ বছর বয়সে ফ্লাইং টাইগারস পদক লাভ করেন স্যু।

চীনা অনুবাদকদের মধ্যে অধ্যাপক স্যুর নাম সুপরিচিত। তাঁকে নিয়ে বিতর্কও কম নয়। কারণ, তিনি নিয়মিত বিভিন্ন ইস্যুতে বিতর্ক করতেন। বিশেষ করে অনুবাদ নিয়ে। শুধুমাত্র আক্ষরিক অনুবাদ নয়, বরং মূল লেখার অর্থ, কথা ও শৈল্পিক ধারণা সবই সুন্দরভাবে অনুবাদ করতে হবে বলে তিনি বলতেন।

তাই যারা আক্ষরিক অনুবাদ করতে চাইতেন, তারা অধ্যাপক স্যু’র অনুবাদ মেনে নিতেন না। কারণ, তাঁদের দৃষ্টিতে সেটি অনুবাদ নয়, বরং নিজের রচনা। তাই একই গ্রন্থ অধ্যাপক স্যু ও অন্যান্য অনুবাদকরা অনুবাদ করলে, দুই অনুবাদে অনেক পার্থক্য লক্ষ্য করা যেতো। অনেক পাঠক তাঁর অনুবাদ বেশ পছন্দ করেন। তাদের চোখে অধ্যাপক স্যুর অনুবাদের শৈল্পিক ধারণা চমত্কার।

চীনের বিখ্যাত পণ্ডিত ছিয়ান চুং শু অধ্যাপক স্যু’র ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন। স্যুর অনুবাদের তিনি অনেক প্রশংসা করতেন। অনুবাদকের কাজ যেন ছন্দ ও উচ্চারণের শেকল নিয়ে নৃত্য করা, স্যু’র অনুবাদ প্রাণচঞ্চল ও নমনীয়, যা খুবই আশ্চর্যজনক ও চমত্কার ব্যাপার। চীনের শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী ইয়াং চেন নিং স্যুর প্রশংসা করে বলেন, ‘মূল লেখকের লেখার প্রকৃত অর্থ বিকৃত না-করেও তিনি চীনা জাতির সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ বিষয় অন্য ভাষায় তুলে ধরেছেন, যা খুবই কঠিন ব্যাপার।’

যুবকাল থেকে এ পর্যন্ত অধ্যাপক স্যু ১৮০টিরও বেশি গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন। চীনের থাং ও সুং রাজবংশ আমলের কবিতাগুলো তিনি ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেছেন এবং পাশ্চাত্য দেশের বিখ্যাত উপন্যাস ‘লাল ও কালো’, ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’সহ বিভিন্ন লেখা চীনা ভাষায় অনুবাদ করেছেন। দেশি-বিদেশি পণ্ডিতরা অধ্যাপক স্যু’র অনুবাদের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বয়স হওয়ার পর তিনি আরও মনোযোগ দিয়ে অনুবাদের কাজ শুরু করেন। বাড়িতে তার শেল্ফভর্তি বই; সোফার কাছে জানালার পাশেও আছে বই।

২০০৭ সালে তিনি মলদ্বারের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। তখন ডাক্তার বলেছিলেন তিনি সর্বোচ্চ ৭ বছর বেঁচে থাকবেন। তবে ২০১৪ সালে তিনি মারা যাননি। বরং আন্তর্জাতিক অনুবাদ মহলের সেরা পুরস্কার ‘নর্দান লাইটস’ লাভ করেন। ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৪ পর্যন্ত তিনি একমাত্র এশিয়ার অনুবাদক যিনি শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করেন। আন্তর্জাতিক অনুবাদক লীগ মনে করে, অধ্যাপক স্যু চীনা, ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন ভাষার মানুষের মধ্যে যোগাযোগের সেতু গঠন করেছেন, যা খুবই কার্যকর।

অধ্যাপক স্যুর বাড়িতে তার স্ত্রীর সাথে অনেক ছবি আছে। দুঃখজনক ব্যাপার হল ২০১৮ সালে তাঁর স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেন। নিজের প্রেম স্মরণ করে স্যু বলেন, ১৯৫৯ সালে ৩৮ বছর বয়সে তিনি তার স্ত্রীর সাথে পরিচিত হন। পরে দু’জন একসাথে ৬০ বছর কাটিয়েছেন। ম্যাডাম চাও জুন শুধু তাঁর স্ত্রী ছিলেন না, বরং ছিলের নিত্যদিনের সাথী। স্ত্রী তার যত্ন নিতেন, তার বইগুলোরও যত্ন নিতেন এবং তার লেখার সর্বপ্রথম পাঠক ছিলেন।

চীনের বিখ্যাত অনুবাদক স্যু ইউয়ান ছোংয়ের গল্প_fororder_xyc2

তিনি বলেন, ‘যখন আমি কম্পিউটারের সামনে বসে অনুবাদরন কাজ করতাম, তখন স্ত্রী কখনও আমাকে বিরক্ত করতো না।’ ৮৫ বছরে স্ত্রী মাত্র একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ডিনার সার্ভ করবো? এখন ৫টা বাজে।’ তখন তিনি উত্তর দেন, ‘একটু পরে।’ ফলে সেদিন ৭টার পরে ডিনার খাওয়া শুরু হয়নি। তবে স্ত্রী চুপচাপ রুমে বসে তাঁর জন্য অপেক্ষা করেন, কখনও অভিযোগ করেননি।

যদিও অধ্যাপক স্যুর বয়স স্ত্রীর চেয়ে ১২ বছর বেশি ছিল, তবে তাঁর স্ত্রীর চোখে তিনি বাচ্চার মতো ছিলেন। তাই তাঁকে যত্ন নিতে কোনো অভিযোগ করতেন না। স্ত্রী সবসময় অন্যদের বলতেন, জনাব স্যু নান্দনিক, সারা জীবন সৌন্দর্য খুঁজে বেড়ান। যেমন, বাইরে গেলে অবশ্যই সুট, জুতা, টুপি ও সানগ্লাস পরবেন। ১০০ বছর বয়সেও তিনি পোশাকের ব্যাপারে সচেতন আছেন।

৯৭ বছর বয়সে স্যু স্ত্রীকে হারান। তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুবরণের দ্বিতীয় দিনে স্যু’র ছাত্র তাঁকে দেখতে যান। সেই সময় তিনি আগের মতো মনোযোগ দিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসে অনুবাদের কাজ করছিলেন। সারা রাত ঘুমাতে পারেননি। তখন তিনি স্ত্রীর ছবি দেখে বলেন, ‘আমার জন্য চিন্তা করো না। অনুবাদের দুনিয়ায় ব্যস্ত থাকলে আমি সাহসের সাথে বেঁচে থাকবো।’

বয়স্ক হলেও তিনি সুশৃঙ্খল জীবন কাটান।  সকাল ৮টায় ঘুম থেকে জেগে উঠার পর বই পড়েন এবং বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত অনুবাদের কাজ করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে রাত ও দিনের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। শুধু অনুবাদ করা বা না-করার পাথর্ক্য। জীবনকে দীর্ঘ করার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি রাতের সময় কাজ করা।’

৪০ বছর আগে তিনি ‘অনুবাদ শিল্প’ নামের বইতে লিখেছেন, চীনা সাহিত্য-অনুবাদকদের উচিত নিজের দায়িত্ব পালন করা, বিদেশি সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ বিষয় চীনা ভাষায় তুলে ধরা এবং সেই সাথে চীনা সংস্কৃতির সেরা বিষয় অন্য ভাষায় বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। সিসিটিভি’র সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ‘আবৃত্তিকার’-এ তিনি ‘শেক্সপিয়ার রচনাবলী’ অনুবাদ সম্পর্কে বলেন, শেক্সপিয়ারের শ্রেষ্ঠ লেখাগুলোর সবই অনুবাদ করেছি। বাকিগুলো ভালো লাগে নাই, তাই আর অনুবাদ করবো না।’

চীনা জাতির মহান পুনরুত্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘চীনা সভ্যতা অনেক সমৃদ্ধ। তাই জাতীয় সংস্কৃতির মূল্য ও আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে।’

সুপ্রিয় বন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা এখানে শেষ হয়ে এলো। আমাদের অনুষ্ঠান যারা মিস করেছেন, তারা আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন। ওয়েবসাইট ঠিকানা www.bengali.cri.cn,ফেসবুকে CRIbangla মাধ্যমে চীন ও বিশ্ব সম্পর্কে আরও অনেককিছু জানতে পারেন। তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন, আগামী সপ্তাহে আবার কথা হবে,যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)