আন্তর্জাতিক ট্যুর গাইড থেকে গ্রামীণ কর্মী: চীনা তরুণ চাং ছেং-এর গল্প
2021-05-15 19:24:48

আন্তর্জাতিক ট্যুর গাইড থেকে গ্রামীণ কর্মী: চীনা তরুণ চাং ছেং-এর গল্প

 

আন্তর্জাতিক ট্যুর গাইড থেকে গ্রামীণ কর্মী: চীনা তরুণ চাং ছেং-এর গল্প_fororder___172.100.100.3_temp_9500041_1_9500041_1_1_f86abf46-e42f-4fd0-85a8-bc141876983b

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের মহামারি নানা শিল্প উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এতে অনেকের জীবন-জীবিকার পথ পরিবর্তন হয়েছে। তরুণ চীনা মানুষ চাং ছেং তাদের মধ্যে একজন।

 

চাং ছেং এর আগে একজন অভিজ্ঞ ট্যুর গাইড ছিলেন। ২০০৭ সালে চাং ছেং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করে চীনের শাংহাই শহরে পর্যটন-সংক্রান্ত পেশায় যোগ দেন। শুরুর দিকে তিনি স্বল্প দূরের দেশীয় ভ্রমণে কাজ করতেন। তারপর তিনি বিদেশ ভ্রমণেও সাহায্য করা শুরু করেন। বিদেশ ভ্রমণে পর্যটক দলের প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে তিনি প্রায় গোটা বিশ্ব ঘুরে দেখেছেন। পর্যটন খাতে প্রায় দশ বছর ধরে কাজ করার পর তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারও বেশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে।

আন্তর্জাতিক ট্যুর গাইড থেকে গ্রামীণ কর্মী: চীনা তরুণ চাং ছেং-এর গল্প_fororder___172.100.100.3_temp_9500041_1_9500041_1_1_0bc03c05-8851-45ff-9e64-57a4c9e5ec32

২০২০ সালের শেষ নাগাদ আকস্মিক করোনাভাইরাস মহামারি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বিদেশ ভ্রমণ বাধ্যতামূলক বন্ধ হয়ে যায়। চাং ছেং-এর পর্যটন কোম্পানির ব্যবসাও একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনাও এতে গুরুতরভাবে প্রভাবিত হয়। তিনি বলেন,

মহামারির কারণে কোম্পানির বৈদেশিক পর্যটন একদম বন্ধ হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন দেশে বার বার মহামারির সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। এর আগে আমরা কিছু দেশীয় ভ্রমণের রুট তৈরি করেছিলাম, কিন্তু তা বাজারে ততটা ভালো মুনাফা করতে পারে নি। এদিকে আমার জন্মস্থানে অনেক দ্রুত উন্নয়ন ও পরিবর্তন হয়েছে। আমার বাবা-মা, আমার আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুরা সবাই আমাকে জন্মস্থানে ফিরে কিছু একটা কাজ করার পরামর্শ দিয়েছিল। অবশেষে আমি সাংহাই ছেড়ে আমার জন্মস্থান- চিয়াংসি প্রদেশের ই ছুন শহরে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।

 

গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে চাং ছেং ই ছুন সরকারের একটি ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে একজন সরকারি কর্মী হিসেবে কাজে যোগ দেন। এরপর তিনি আবারও ই ছুন শহরের বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকদের জন্য আয়োজিত একটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এতে পাস করে গ্রামের একজন দারিদ্র্যবিমোচন কর্মী হন। চাং ছেং আবারও এমন পরীক্ষায় পাস করেন।

 

২০২১ সালের ১ জানুয়ারি, চাং ছেংকে ই ছুন শহরের ওয়েন থাং থানার সুই খৌ গ্রামের একজন দারিদ্র্যবিমোচন কর্মী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।

 

সুই খৌ গ্রামটি ওয়েন থাং থানার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। নীল আকাশ ও সাদা মেঘের নিচে, সবুজ পাহাড় ও পরিচ্ছন্ন নদীর মাঝে এই সুন্দর ছোট গ্রামটি যেন ব্যস্ততামতয় শহুরে জীবন থেকে অনেক দূরে রয়েছে! তবে দীর্ঘ সময় ধরে দূরবর্তী এলাকায় অবস্থান, দুর্বল সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা, বাইরের সঙ্গে কম তথ্য বিনিময় ইত্যাদি নানা কারণে সুই খৌ গ্রামটি অনুন্নত পাহাড়ি গ্রাম হিসেবে পরিচিত ছিল। কৃষকরা আগে বাঁশ কেটে বিক্রি করা এবং পাহাড়ে জুম চাষ করার মাধ্যমে জীবনযাপন করত। অনেক কৃষক গ্রামের বাইরে কাজ করত। আর যারা গ্রামে থাকত, তারা বয়স্ক ও ছোট শিশু।

আন্তর্জাতিক ট্যুর গাইড থেকে গ্রামীণ কর্মী: চীনা তরুণ চাং ছেং-এর গল্প_fororder___172.100.100.3_temp_9500041_1_9500041_1_1_204414a6-ff9c-43e9-830e-172ec706bf38

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ব্যাপকভাবে গ্রাম পুনরুদ্ধার কৌশল বাস্তবায়ন করছে। স্থানীয় সরকারের সমর্থন এবং কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যের চেষ্টায়, সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের এই সুই খৌ গ্রামের অনেক কৃষক নিজেদের বাড়িকে পর্যটকদের অভ্যর্থনা জানাতে ‘গ্রামীণ হোটেলে’ রূপান্তর করেছেন। প্রতি বছর গ্রামটি ১০ লাখেরও বেশি পর্যটককে অভ্যর্থনা জানায়। এতে গ্রামের আয় হয়েছে তিন কোটি ইউয়ান। সুই খৌ গ্রামটি ‘দেশের গ্রামীণ পর্যটনের প্রধান গ্রাম’, ও ‘চীনের শ্রেষ্ঠ পর্যটন গ্রামের’ পুরস্কারও পেয়েছে।

 

গ্রামীণ পর্যটন হল গ্রামে চাং ছেং-এর কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তিনি এর আগে পর্যটন খাতের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এবার গ্রামের উন্নয়নে তিনি তা কাজে লাগানোর সুযোগ পেয়েছেন। তিনি গ্রামের বাস্তব অবস্থা অনুযায়ী গ্রাম পরিচালনা করেছেন, অল্প কয়েক মাসের মধ্যে তাঁর কাজে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে। তিনি গ্রামে করোনাভাইরাস মহামারি প্রতিরোধের জরুরি মোকাবিলা ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব দেন এবং গ্রামে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণে সাহায্য করেন; যা ব্যাপক মানুষের আস্থা ও প্রশংসা পেয়েছে।

চাং ছেং বলেন,

সুই খৌ গ্রাম এমন এক সুন্দর জায়গা যেখানে সবুজ পাহাড় ও পরিচ্ছন্ন নদনদী দেখা যায়। নতুন যুগের একজন তরুণ মানুষ হিসেবে, এখানে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করছি। একই সঙ্গে গ্রাম পুনরুদ্ধারে কিছু অবদান রাখতে পারছি। এজন্য আমি সত্যিই খুব আনন্দিত।

 

৩০ বছর পর আবার চীনে হাজির হওয়া আনন্দের ব্যাপার—ফরাসি ফটোগ্রাফার ও একজন চীনা মা-এর গল্প

 

আঁকাবাঁকা পাথুরে পথে ৩২ বছর আগে চীনের সংখ্যালঘু তুং জাতির নারী ইয়াং নাই ছুই চিয়ানের একটি ছবি তুলেছিলেন ফরাসি ফটোগ্রাফার ইয়ান লেই। ছবির নারীর মুখে কিছু বিস্ময় দেখা যায়, আবার কিছুটা অতিথিপরায়ণ মনোভাবও বোঝা যায়।

 

৩২ বছর পর ছবির প্রধান চরিত্রের সঙ্গে আবার দেখা করেন ফরাসি ফটোগ্রাফার ইয়ান লেই। তবে এবার তারা অনলাইন ভিডিওতে কথা বলেন। তখন চীনা নারী ইয়াং নাই ছুই চিয়ান চীনের কুয়াং সি চুয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে নিজের চা বাগানে চায়ের পাতা তুলছিলেন। ইয়ান লেই বলেন, যে জিনিস আমাদেরকে সংযুক্ত করতে পারে তা হল ৩২ বছর আগের সেই মুহূর্ত!

 

যদিও করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে তারা দু’জন সরাসরি সাক্ষাত করেন নি, তারপরও সহজ ফোনালাপ ও শুভেচ্ছার মাধ্যমে তাদের মধ্যে দূরত্ব অনেকটা দূর হয়ে যায়।

 

চীনা নারী ইয়াং নাই ছুন চিয়ানের বর্তমান বয়স ৫৬ বছর। তাঁর বাসা কুয়াং সি চুয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের তু থুং থানার থাং ছাও গ্রামে। তিনি তুং জাতির সাধারণ এক নারী। ৩২ বছর আগে ইয়াং লেই যখন তাঁর ছবি তোলেন, তখন তিনি নিজের বাড়ির পথে ফিরছিলেন। তিনি শিশুদের নিয়ে বাসায় যেতেন। শিশুরা কাঁধের ঝুলানো বাঁশের ঝুড়িতে বসে থাকত। ইয়ান লেন এই ছবিকে তাঁর তুং জাতির জীবন-সংক্রান্ত বই ‘গানের সমুদ্রের’ প্রচ্ছদ হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

ইয়ান লেই হলেন গভীর পাহাড়ে তুং জাতির আবাসিক এলাকায় যাওয়া প্রথম দফার বিদেশি মানুষ। ইয়াং নাই ছুন চিয়ান এবং তাঁর দু’ছেলেও সেই প্রথমবারের মত বিদেশি মানুষের মুখ দেখতে পেয়েছিলেন। ইয়াং নাই ছুন চিয়ান তখনকার কথা স্মরণ করে বলেন, তখন আমার দুই ছেলে কিছুটা ভয় পেয়েছিল। এর আগে আমরা কখনোই কোনো বিদেশি মানুষ দেখি নি।

 

৫৯ বছর বয়সী ফরাসি ফটোগ্রাফার ইয়ান লেই ১৯৮৫ সালে প্রথমবারের মতো চীনে আসেন। সেই সময় চীনের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক তৈরি হয়। ক্যামেরা দিয়ে চীনকে দেখা এবং চীনের জাতীয় বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হল তাঁর বিশেষ পদ্ধতি। তিনি বলেন, আমি চীন ও চীনের মানুষের জীবন সম্পর্কে জানতে অনেক আগ্রহী। আমি ক্যামেরার মাধ্যমে সব কিছু তুলে ধরতে চাই, যাতে আরো বেশি মানুষ চীন সম্পর্কে জানতে পারে।

 

ইয়ান লেই বন্ধুর কাছ থেকে জানতে পারেন যে, চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তুং জাতি অধ্যুষিত এলাকা আছে। তাই ১৯৮৮ সাল থেকে তিনি চারবার কুয়াংসি ও কুই চৌ প্রদেশের তুং জাতি অধ্যুষিত এলাকায় যাতায়াত করেন, ক্যামেরা দিয়ে সেখানকার রীতিনীতি ও স্থানীয় লোকজনের জীবন রেকর্ড করেন।

প্রথমবারের মতো কুয়াং সি’র তুং জাতি অধ্যুষিত এলাকা পরিদর্শনের কথা স্মরণ করে ইয়ান লেই বলেন, আমি ও আমার বন্ধু একটি এসইউভি গাড়ি চালিয়ে সেখানে যাই। সড়ক খুব ভাঙা হওয়ায়, এক কিলোমিটার দূরত্ব পার হতে আমাদের সারা দিন লেগে যায়। তখন জেলায় শুধু ছোট একটি জরাজীর্ণ হোটেল ছিল, দোকান-পাট খুব কম, গাড়িও খুব একটা দেখা যাচ্ছিল না।

 

তখন জেলার অবকাঠামো খুব খারাপ ছিল। ইয়ান লেই-এর ভ্রমণ ছিল অনেক কষ্টকর। তবে সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীবন তাঁর মনে গভীর ছাপ ফেলে।

ইয়ান লেই বলেন, সেখানে অনেক কাঠের সেতু ও বাড়িঘর আছে, সিড়ির মতো ধাপে ধাপে জুম চাষ করতে দেখা যায়- যা দারুণ আকর্ষণীয়। স্থানীয় লোকজন সবসময় জাতীয় পোশাক পরে থাকেন ও স্থানীয় বাদ্যযন্ত্র বাজান।

 

তিনটি ক্যামেরা দিয়ে ইয়ান লেই স্থানীয় তুং জাতির মানুষের ছবি তোলেন। তিনি তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি বলেন, সবাই আমাদের সঙ্গে খুব ভালো আচরণ করেছিল। তাঁর অনেক ছবি আন্তর্জাতিক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় এবং তিনি অনেক পুরস্কারও পান।

 

এরপর ইয়ান লেই বেশ কয়েকবার সেখানে যান। স্থানীয় পরিবর্তন তাকে অনেক অবাক করে দেয়। তিনি বলেন, আগে অনেক বাড়িতে বিদ্যুত্ ছিল না, সিমেন্টের পথ ছিল না। জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় নানা সামগ্রীর অভাব ছিল। কিন্তু এখন সেখানে অনেক নতুন সড়ক তৈরি হয়েছে, যোগাযোগব্যবস্থা আগের চেয়ে অনেক সুবিধাজনক হয়েছে। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাও বেড়েছে, দোকানে সবকিছু পাওয়া যায়, সবখানে উঁচু উঁচু দালান-কোঠা দেখা যায়। এ জেলাটি দেখতে আধুনিক বড় শহরের মতো।

 

২০১৯ সালে ইয়ান লেই আবারও থাং ছাও গ্রামে যান। তুং জাতির নারী ইয়াং নাই ছুন চিয়ানের বাসস্থান আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। টিভি, ফ্রিজার, ওয়াশিং মেশিন....সবকিছু আছে। দুই ছেলে এখন বড় হয়েছে ও ভালো চাকরি করে। কয়েক বছর আগে জেলায় দ্রুত গতির ট্রেনলাইন সংযুক্ত হয়। এতে যোগাযোগ আরো সুবিধাজনক হয়েছে। বর্তমানে বাইরের বিশ্বের সঙ্গে তুং জাতির বিনিময় ও যোগাযোগ আরো বেড়েছে।

 

ইয়ান লেই আরো আবিষ্কার করেন যে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় সরকার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিও খুব ভালোভাবে সংরক্ষণ করেছে।

তিনি বলেন, চীনের উন্নয়ন ও পরিবর্তন বিস্ময়কর। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে তিনি নিজের মেয়েকে নিয়ে আবারও চীনে আসবেন, আরো অনেক ছবি তুলবেন।

 

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)