টিকে থাকাতেই নিম্ন আয় ও কাজ হারানো মানুষের ঈদ
2021-05-13 19:33:17

টিকে থাকাতেই নিম্ন আয় ও কাজ হারানো মানুষের ঈদ

সাজিদ রাজু

করোনায় এবার ফিঁকে নিম্ন আয় ও কাজ হারানো মানুষের ঈদ উৎসব। ঈদের আনন্দের চেয়ে পেটেভাতে টিকে থাকাই তাদের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। কিছু মানুষ সরকারি সহযোগিতা পেলেও বেশিরভাগই রয়ে গেছে এর আওতার বাইরে। সরকারি প্রচেষ্টা পর্যাপ্ত নয় জানিয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ব্যাপ্তি বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। সেই সঙ্গে করোনায় নতুন করে দরিদ্র হওয়া মানুষদের নগদ সহায়তা দিতে নিতে হবে বিশেষ কর্মসূচি।

যানবাহনের চিৎকার, মানুষের হইহল্লা আর কড়া রোদ। তবুও মিরপুর ১০ নম্বরের ফুটপাতে ঈদের আগের দিন বসে ঈদের বাজার। চলে কেনাকাটা। প্রচণ্ড গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার এখানকারই এক ব্যবসায়ী মাঝবয়সী আব্দুল জলিল। ভ্যানে করে ঈদের পাজামা-পাঞ্জাবি বিক্রি করছিলেন তিনি। তবে তেমন গ্রাহক নেই। তার মতে করোনায় মানুষের পকেটে পয়সা নাই, এর প্রভাব পড়েছে ঈদ কেনাকাটায়।

টিকে থাকাতেই নিম্ন আয় ও কাজ হারানো মানুষের ঈদ_fororder_shang2

 

“এ বছর যে সমস্যা, সমস্যার কারণে বাজান বেচাকিনি তেমন না আমরা মাল কিন্যা বইয়া আছি। কাস্টমার মাল কেনে না। এই কারণে আমাগোও বড় ধরনের বিপদ। আমাগো প্যাটের ভাত জোগানই কঠিন অইয়া পড়ছে।”

বলছিলেন বিক্রেতা আব্দুল জলিল। যা কিছু বিক্রি হচ্ছে, এসবের ক্রেতা কারা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, সাধারণত নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের মার্কেট হলেও এবার ফুটপাতে ঢুঁ মেরেছেন প্রায় সব শ্রেণির ক্রেতাই। তবে নিজের পরিবারের ঈদ কেনাকাটা নিয়ে তার অস্বস্তির উত্তর।

“ এবছর ঈদের বাজার করার মতো পরিবেশ নাই। তারপরও যে দুই এক টাকার বাজার করবো, বাড়িই যাইতে পারতেছিনা। এখন বাজার কইরাই বা কি লাভ হবে? এই রোডে একটু দোকান দিসি, তাও শপিং মলওয়ালারা তুইল্যা দ্যায়, পুলিশে ধাওয়ানি দেয়। সব কোন রকমে ম্যানেজ কইরা যা দুই এক পয়সা আয়, হ্যায় দিয়া এখনো কোন বাজার করিনাই

এদিকে ঈদে মানুষ গ্রামে ছুটলেও ঢাকামুখী হয়েছেন অনেকে। এদেরই একজন বগুড়া থেকে আসা নিজাম উদ্দিন। ঢাকায় রিকশা চালান নিজাম, রিক্সার গ্যারেজেই থাকা-খাওয়া। তিনি বলছেন, গ্রামে কাজ নেই, এক মাস পর ধান কাটা শুরু হলে তখন গ্রামে ফিরবেন। এ সময়টা রাজধানীতে রিক্সা চালিয়ে কিছু নগদ উপার্জন করবেন। ঈদে বাড়ি না গেলেও পরিবারের জন্য কিছু টাকা পাঠিয়েছেন ঈদের বাজার সদাই করতে।

টিকে থাকাতেই নিম্ন আয় ও কাজ হারানো মানুষের ঈদ_fororder_shang22

নিজাম উদ্দিন

“এবার ঈদে বাড়ি যাবো না। আসছি ১০ দিন হলো। যাওয়া-আসা কষ্ট, টেকা কম, যাওয়া যায়না। ১০ দিন আগে আসছি যে কামাই করমু। পোলাপানের জন্য দিয়া পাঠাছি ২ হাজার টাকা, যে অল্প কিছু কইরা যে পোলাপানেক (ছেলেমেয়েদেরকে) বুঝ দেয়ার জন্যে, কিছু কাপড়চোপড় কিনে দিও”

 

কিন্তু সরকারির সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার কথা যাদের, সেই বয়স্ক মানুষদের অবস্থা কেমন? মিরপুরের প্রধান সড়ক ধরে এগোতে গিয়ে চোখে পড়লো ঢাকা সিটি করপোরেশনের রাস্তা সংস্কারের একটি প্রকল্পে কাজ করছেন ষাটোর্ধ মাহফুজা বেগম। বয়সের সাথে চুলে পাক ধরেছে, কমেছে কর্মক্ষমতাও। তবুও জীবন বাঁচানোর তাগিদে মাথায় তুলে নিয়েছেন ইট-শুরকির বোঝা। তবুও করোনাকালে পেটেভাতে বেঁচে থাকার সুযোগ মিলছে। এই অল্প টাকায় ঘরভাড়া আর বাজার সদাই করতেই যেখানে নাভিশ্বাস, সেখানে ঈদের আনন্দের প্রসঙ্গই বাতুলতা।

টিকে থাকাতেই নিম্ন আয় ও কাজ হারানো মানুষের ঈদ_fororder_shang222

মাহফুজা বেগম

“অল্প টেহা, ঘরভাড়া দেওন লাগবো। দোকান বিল দেওন লাগবো। আগেই নিয়া খাইয়া থুইছি। এই যে একজনে কাইল একটা কাপড় দিছে, এইডাই পরমু। বাজার করার মতো এতো পয়সা কই পায়াম

না পাওয়ার ক্ষোভ বেশ। কিছুটা রাষ্ট্রের প্রতি, এমন বয়সেও দেখার কেউ নেই বলে। বলছিলেন, কাগজে কলমে রাজধানীর ভোটার হলেও এখানে চেনেন না জনপ্রতিনিধিরা।

সাহায্য করবার লোক নাই। আমরা যে এনো ভুটার (ভোটার) হইছি, ভুট দিসি, কেউ একজনে কইলো না যে এক ছটাক চাইল, এক ছটাক ডাইল দেই, এরা গরীব। কমিশনারের কাছে দুই তিনদিন গেছি, ব্যাটারে পাই না, হ্যার ঘরে চামচারা ভরা।”

অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ বলছিলেন, শুধু ঈদ নয় বরং আগামী তিন থেকে ৪ মাস মানুষ যেন খেয়ে পরে বাঁচতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে সবার আগে। সেই সঙ্গে করোনায় কাজ হারিয়ে নতুন করে যারা দরিদ্র হয়েছেন, দেখভাল করতে হবে তাদেরও।

টিকে থাকাতেই নিম্ন আয় ও কাজ হারানো মানুষের ঈদ_fororder_shang2222

এম এম আকাশ, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

“সরকার যে সাহায্য দিয়েছে, তা ৫০ লক্ষ পরিবারকে অর্থাৎ ২ কোটি মানুষ। পুরনো ৩ কোটি মানুষকেই পুরোপুরি সাহায্য দিতে পারেনি। আর নতুন করে দরিদ্র হয়েছে আরো প্রায় ৩ কোটি মানুষ। এদেরকে সাহায্য পৌছাতে পারেনি। এটাতে ফান্ড লাগবে। নগদ সাহায্য দিতে হবে। যাতে তারা কিনে খেতে পারে, বাঁচতে পারে। অন্তত ৩-৪ মাস।”

–এম এম আকাশ

চলমান করোনা পরিস্থিতিতে বিভিন্ন পেশায় কাজ হারানো প্রায় ১৫ লাখ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা দিয়েছে সরকার। তবে বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় যে ৪০ শতাংশ মানুষ এখন দরিদ্র, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমকে আরো সম্প্রসারিত করার পরামর্শ এ অর্থনীতিবিদের।

যারা দারিদ্র্যের তালিকার বাইরে রয়েছে, তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, জরুরি ভিত্তিতে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ব্যাপ্তি আরো বাড়াতে হবে।”