গত ৭ মে ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬০তম জন্মবার্ষিকী। আসলে চীনে ঠাকুর অনেক জনপ্রিয় একজন বিদেশি, যিনি চীনা জনগণের পুরনো বন্ধু হিসেবে স্বীকৃত। প্রায় ৯৭ বছর আগে তিনি তিন বার চীন সফর করেন। তিনি চীনের অনেক জায়গায় ভ্রমণ করেছেন এবং চীনা কবি ও শিল্পীদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেছেন। আজকের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও চীনের মৈত্রীর গল্প তুলে ধরবো।
১৮৬১ সালের ৭ মে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকে তিনি কবিতা ও উপন্যাসসহ বিভিন্ন লেখা রচনা শুরু করেন এবং ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’র কারণে এশিয়ার প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হন। চীনের সাথে সম্পর্ক নিয়ে ঠাকুরের যুবকালের কথা উল্লেখ করতে হয়। ১৮৮১ সালে ২০ বছর বয়সী ঠাকুর একটি লেখা প্রকাশ করেন, যার নাম হল ‘চীনে মৃত্যুর বাণিজ্য’। এতে ব্রিটেনের আফিম চীনে বিক্রির দৃঢ় সমালোচনা ও নিন্দা করা হয়। তিনি শব্দের অস্ত্র নিয়ে চীনা জনগণের পাশে এসে দাঁড়ান। ১৯১৬ সালে জাপান সফরকালে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তৃতায় প্রকাশ্যে তিনি জাপানি বাহিনীর চীনের শানতুং প্রদেশে আগ্রাসনের সমালোচনা করেন। ১৯৫৬ সালে তত্কালীন চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ঠাকুর সম্পর্কে বলেন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু বিশ্বের সাহিত্যে অতুলনীয় অবদান রেখেছেন এমন একজন সেরা কবি নন, বরং চীনা জনগণের প্রতি তাঁর আন্তরিকতা ও ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন, চীনা জাতির স্বাধীনতার সংগ্রামে ঠাকুরের সমর্থন কখনও ভুলে যাবে না চীনারা।
আসলে ঠাকুরের তিনবারের চীন সফর বিংশ শতাব্দীতে চীন ও ভারতের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের পথকে উন্মোচন করেছে। ১৯২৪ সালে তিনি প্রথমবার চীন সফর করেন। তখন প্রায় দেড় মাসের মতো থেকেছিলেন তিনি। ১৯২৫ সালে চীন সফরকালে তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতা সংগ্রহ করে একটি বইও প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান সফরের যাত্রায় দ্বিতীয়বারের মতো শাংহাইয়ে আসেন তিনি এবং ১৯২৯ সালের জুন মাসে ইউরোপ থেকে ফিরে আসার পথে আবার চীনা কবি স্যু জি মো’র বাড়িতে আসেন।
চীনা বন্ধুদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘তোমাদের মহান ভবিষ্যত থাকবে, যখন তোমাদের দেশ বিশ্বে মঞ্চে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম এবং নিজের চিন্তাভাবনা প্রকাশ করতে সক্ষম, তখন এশিয়ার সুউজ্জ্বল ভবিষ্যতও আসবে।’
তাঁর প্রথম চীন সফর চীনা পণ্ডিত লিয়াং ছি ছাও এবং ছাই ইউয়ান পেই’র আমন্ত্রণে হয়েছিল। ১৯২৪ সালের ২১ মার্চ কলকাতা থেকে জাহাজে করে ১২ এপ্রিল সকালে তিনি চীনের শাংহাই শহরের বন্দরে পৌঁছান। তখন চীনের সাহিত্য গবেষণা পরিষদ, যুবক সমিতি ও পত্রিকার সংবাদদাতারা এবং শাংহাইতে অবস্থানরত ভারতীয় নাগরিকসহ ৬০০ জনেরও বেশি লোক ঠাকুরকে স্বাগত জানাতে বন্দরে অপেক্ষা করছিলেন। চীনে পৌঁছার পর তিনি মুগ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘বন্ধুরা, চীনে এলে যেন মনে হয় জন্মস্থানে ফিরে এসেছি। এর কারণ আমিও ঠিক বুঝতে পারি না। আমার ধারণা, চীন ও ভারত পুরনো ও ঘনিষ্ঠ আপন ভাইয়ের মতো।’
১৪ এপ্রিল চীনা কবি স্যু চি মো এবং আরো কয়েকজন বন্ধুর সাথে হাংচৌ শহরে বেড়াতে যান ঠাকুর। সেখানকার অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য তাঁর মনে গভীর ছাপ ফেলে। তিনি বাচ্চার মতো আনন্দ প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘চমত্কার ওয়েস্ট লেক এবং অসাধারণ হাংচৌ; সময় থাকলে হ্রদের পাশে একটি বাড়ি কিনবো সেখানে থাকতে।’
হাংচৌ লিংইন মন্দিরে বক্তৃতা দিয়েছেন কবিগুরু। তিনি চীনা অপেরার শিল্পী মেই লান ফাংকে বলেন, ‘ভারতে একটি বাচ্চা জন্মগ্রহণের পর দুটি কাজ অতি গুরুত্বপূর্ণ, প্রথমে তার নাম দিতে হবে এবং দ্বিতীয়ত, তাকে অল্প খাবার দিতে হবে। তখন থেকে এ বাচ্চা সমাজের সাথে অপরিবর্তনীয় সম্পর্কে বড় হতে থাকে।’
চীনের সফর সম্পর্কে ঠাকুর বলেন, ‘চীনে আসা পর্যটকের মতো শুধু সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করা নয়, ধর্মপ্রচারকের মতো ধর্মবিশ্বাস বয়ে আনা নয়, বরং চীনের প্রতি আবেগ প্রকাশের জন্য। চীনা হোক, ভারতীয় হোক, আমাদের দুই জাতির মধ্যে হাজার বছরের যোগাযোগ একসময় বন্ধ হয়ে গেছে, আমার আসা এ সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের জন্য।’
৭ মে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। এ উপলক্ষ্যে বেইজিংয়ে অবস্থানরত চীনা কবি ও পণ্ডিতরা ঠাকুরের জন্য বিশেষ উদ্যাপনী অনুষ্ঠান আয়োজন করেছেন। যেমন, জনাব হু শি তাঁকে ১০টিরও বেশি শ্রেষ্ঠ চারুকলার শিল্পকর্ম ও চীনা মাটির উপহার দিয়েছিলেন। পণ্ডিত লিয়াং ছি ছাও তাঁকে ‘জু চেন তান’ চীনা নাম দিয়েছেন এবং চীনের বিখ্যাত অপেরা শিল্পী মেই লান ফাং তাঁর জন্মদিন উপলক্ষ্যে বিশেষ নাটক পরিবেশন করেছেন। মেইকে কৃতজ্ঞতা জানার জন্য পাখায় একটি ছোট কবিতাও রচনা করে দেন ঠাকুর। তাতে লেখা ছিল: ‘অজানা ভাষা দিয়ে পড়ছে ঢাকা তুমি, চিনিতে নারি প্রিয়ে! কুহেলী আছে ঘিরি, মেঘের মতো তাই দেখিতে হয় গিরি।’
ঠাকুর চীন সফরের সময় নিজের জন্য একটি চীনা নামও পেয়েছেন। চীনা উচ্চারণ হল ‘জু চেন তান’। সেই নাম চীনা সাহ্যিতবিদ ও পণ্ডিত লিয়াং ছি ছাও ঠাকুরকে দিয়েছেন। ‘জু’র অর্থ ভারত এবং ‘চেন তান’ হলো ভারতীয় লোকের চীনকে ডাকার উচ্চারণ, দুটি মিলিয়ে চীন ও ভারতের মৈত্রীর প্রতীক।
চীনা কবি স্যু চি মো এবং তাঁর স্ত্রী লু সিয়াও মান ঠাকুরের চীন সফরকালে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ চীনা বন্ধুদের অন্যতম ছিলেন। কারণ কবি স্যু ভালো ইংরেজি জানতেন। ঠাকুরের চীন সফরকালে তিনি সবসময় তাঁর জন্য অনুবাদক হিসেবে কাজ করেছেন। কবি স্যুকে ‘মেধাবী পুরুষ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন ঠাকুর, তাকে ‘সোথমা’ ভারতীয় নামও দিয়েছেন এবং কবি স্যুও তাঁকে সম্মান করে ‘ঠাকুর বাবা’ বলে ডাকেন। চীন থেকে ভারত ফিরে যাওয়ার পরও তিনি কবি স্যুর সাথে সবসময় চিঠিতে যোগাযোগ রাখতেন এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয়বারের মতো চীন সফরের সময়ও কবি স্যুর বাড়িতে থেকেছেন।
চীন সফরকালে কবি স্যু’র সহায়তায় চীনের অনেক জায়গায় বেড়াতে গেছেন এবং ছিং রাজবংশ আমলের শেষ রাজা পু’ই ও আঞ্চলিক সেনাবাহিনীর কমান্ডারের সাথে সাক্ষাত্ করেছেন ঠাকুর। শানসি, শাংহাই ও বেইজিংয়ের বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দিয়েছেন তিনি। চীনা ছাত্রছাত্রীরা ক্যাম্পাসে বা থিয়াটারে তাঁর বক্তৃতা শুনেছেন। মে মাসের শেষ দিকে প্রথমবারের চীন সফর শেষ করে স্বদেশে ফিরে যান ঠাকুর।
১৯২৮ সালের অক্টোবর মাসে কবি স্যু চি মো ইউরোপে ভ্রমণ করতে যান। চীনে ফিরে আসার পথে তিনি ভারতে যান এবং ঠাকুরের সাথে দেখা করেন। কবিগুরুর দ্বিতীয়বারের চীন সফরও হয়েছিল কবি স্যু-র আমন্ত্রণে।
১৯২৯ সালের মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানে যাওয়ার পথে তিনি অল্প দিনের মতো শাংহাইয়ে ছিলেন। তবে সেই সময় চীনের অবস্থা অনেক বদলে গেছে। শান্তিপূর্ণ ও স্নেহময় চিন্তাধারা চীনে আর জনপ্রিয় নয়। তাই আত্মার দিক ও শারীরিক দিকে তাঁর জন্য অনেক ক্লান্তির ব্যাপার ছিল। সেই সময় তিনি স্যুকে বলেন, এবারের সফরকালে শুধু বাসায় থাকবেন, শান্তিপূর্ণভাবে সময় কাটাবেন, কোনো বক্তৃতা আর দিতে চান না। মাত্র ৩ দিনের সফরে তিনি কবি স্যু’র স্ত্রীর জন্য কয়েকটি কবিতা লেখেন এবং স্যু’র নোটবুকে চীনা ব্রাশ দিয়ে নিজের জন্য ছবি আঁকেন।
১৯২৯ সালের ১১ জুন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানে সফর শেষ করে তিনি আবার শাংহাইয়ে আসেন। এবার মাত্র দু’দিন বিশ্রাম নেন। স্বদেশে যাওয়ার সময় তিনি স্যুটকেস থেকে একটি বেগুনী রঙয়ের পাঞ্জাবী উপহার হিসেবে প্রিয় চীনা কবি স্যু চি মো বা সোথমাকে দিয়েছিলেন। তখন চোখে অশ্রু নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বয়স্ক হয়েছি, জীবনে আবার চীনে আসার সম্ভাবনা নেই এবং হয়তো আবার দেখার সুযোগও থাকবে না। তাই এ কাপড় স্মৃতি হিসেবে তোমাদের সাথে থাকবে!’
তখন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি আর চীনে আসেননি এবং কবি স্যু’র সাথেও দেখা করা হয়নি তার। তবে ভারত ও চীনের মৈত্রীর উন্নয়নে তাঁর অবদান চীনাদের মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। তাঁর চীন সফর সম্পর্কে তিনি একটি কবিতাও রচনা করেছেন, কবিতার নাম জন্মবাসরের ঘটে।
জন্মবাসরের ঘটে
নানা তীর্থে পুণ্যতীর্থবারি
করিয়াছি আহরণ, এ কথা রহিল মোর মনে।
একদা গিয়েছি চিন দেশে,
অচেনা যাহারা
ললাটে দিয়েছে চিহ্ন 'তুমি আমাদের চেনা' ব'লে।
খসে পড়ে গিয়েছিল কখন পরের ছদ্মবেশ;
দেখা দিয়েছিল তাই অন্তরের নিত্য যে মানুষ;
অভাবিত পরিচয়ে
আনন্দের বাঁধ দিল খুলে।
ধরিনু চিনের নাম, পরিনু চিনের বেশবাস।
এ কথা বুঝিনু মনে,
যেখানেই বন্ধু পাই সেখানেই নবজন্ম ঘটে।
আনে সে প্রাণের অপূর্বতা।
বিদেশী ফুলের বনে অজানা কুসুম ফুটে থাকে—
বিদেশী তাহার নাম, বিদেশে তাহার জন্মভূমি,
আত্মার আনন্দক্ষেত্রে তার আত্মীয়তা
অবারিত পায় অভ্যর্থনা॥
সুপ্রিয় বন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা এখানে শেষ হয়ে এলো। আমাদের অনুষ্ঠান যারা মিস করেছেন, তারা আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন। ওয়েবসাইট ঠিকানা www.bengali.cri.cn,ফেসবুকে CRIbangla মাধ্যমে চীন ও বিশ্ব সম্পর্কে আরও অনেককিছু জানতে পারেন। তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন, আগামী সপ্তাহে আবার কথা হবে,যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)