চীনা তরুণ ফেং-এর কৃষিকাজ উন্নয়নের অভিজ্ঞতা
2021-05-07 16:11:22

চীনা তরুণ ফেং-এর কৃষিকাজ উন্নয়নের অভিজ্ঞতা_fororder___172.100.100.3_temp_9500041_1_9500041_1_1_f86abf46-e42f-4fd0-85a8-bc141876983b

‘দর্জি হতে না চাওয়া-বাবুর্চি ভালো-ড্রাইভার নয়’ এটি আসলে চীনে প্রচলিত একটি মজার কথা। এর অর্থ- মানুষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষ হলে ভালো হত। চীনে এমন একজন তরুণ আছে, তিনি এই ঠাট্টাকে কিন্তু সত্যি বাস্তবায়ন করেছেন। আজকের গল্পের প্রধান চরিত্রের নাম ফেং ইং ছিয়াং।

 

ফেং ইং ছিয়াং ২০১১ সালে ছুংছিং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর মেজর সাবজেক্ট লোহা। তবে ফেং ছোটবেলা থেকে গ্রামে বড় হয়েছেন। তাই গ্রাম সম্বন্ধে তাঁর বিশেষ ভালোবাসা ও অনুভূতি আছে। তিনি গ্রামে সুন্দর জীবন কাটাতে আগ্রহী। তাই রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্প প্রতিষ্ঠানে আড়াই বছর কাজ করার পর তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে জন্মস্থানের ছোট গ্রামে ফিরে যান। এই সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে ফেং জানান,

 

ইউরোপ অথবা জাপানের মত উন্নত দেশের তুলনায়, আমাদের দেশের কৃষিকাজ একটু পিছিয়ে রয়েছে। আমি যত আগে এই খাতে প্রবেশ করব, তত বেশি কাজ করতে পারবো।

ফেং-এর পরিবার আগে পোনা মাছ চাষ করত। তাই যখন ফেং গ্রামে ফিরে নিজেই কিছু করতে চান, তখন তিনি পোনা মাছ লালনের কাজ বাছাই করেন। সেই সঙ্গে তিনি কিছু ফল গাছও লাগান। তিনি ভাবেন যে, যদি শুধু এক ধরনের ফল চাষ করা যায়, তাহলে এর আয় খুব কম হয়। আর তার জন্মস্থান ছুংছিং শহরের খুব কাছাকাছি, আঞ্চলিক সুবিধা খুব স্পষ্ট। তাই ফেং সিদ্ধান্ত নেন যে, ফল গাছ চাষ এবং গ্রামীণ পর্যটনকে সংযোগ করবেন। এতে কৃষিকাজের মুনাফা আরো বাড়ানো যাবে। তিনি বলেন,

চীনা তরুণ ফেং-এর কৃষিকাজ উন্নয়নের অভিজ্ঞতা_fororder___172.100.100.3_temp_9500041_1_9500041_1_1_0bc03c05-8851-45ff-9e64-57a4c9e5ec32

আমার ‘উজান চিন্তাধারা’। আমি বাজারের দিক থেকে বিবেচনা করি, তারপর আমার কাজের ডিজাইন করি। কারণ বাজারের চাহিদা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমি প্রথমে সিদ্ধান্ত নেই যে- আমার পণ্য কীভাবে  বিক্রি করা যায়। তারপর সিদ্ধান্ত নেই- আমি কীভাবে উত্পাদন করব। আমি অনেকটা বাজারের জন্য বিশেষভাবে নিজের পণ্য উত্পাদন করছি।

 

বাজারের ওপর গুরুত্বারোপ করার সঙ্গে ফেং কৃষি একাডেমির বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে সাহায্য নেন। যেমন ফল গাছ বাছাই, গাছ চাষের জায়গা, চাষের আয়তন। বিশেষজ্ঞরা এসব বিষয়ে ফেংকে সাহায্য করেন এবং পরামর্শ দেন। ২০১৭ সালের শেষ দিকে ফেং-এর ফল বাগানের আয়তন ১১০ মু-এরও বেশি হয়। ফলের বৈচিত্র্যও অনেক বেশি থাকে। এক বছরের চার ঋতুতে সবসময় পর্যটকের জন্য ফল তোলার সুবিধা থাকে। তিনি বলেন,

এপ্রিল মাসে সবার আগে পাকে চেরি ফল এবং তুঁতগাছের ফল। মে ও জুন মাসে পাকে পিচ ফল। জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে তোলা যায় আঙুর। জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাসে আমাদের বাগান থেকে ড্রাগন ফ্রুট তোলা যায়। অগাস্ট থেকে সেপ্টেম্বর মাসে আমাদের ফল বাগানে এসে প্যাশন ফ্রুট পাওয়া যায়। সেপ্টেম্বর মাস থেকে পরের বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত কমলা তোলার সময়। শীতকালে স্ট্রোবেরি আছে, তারপর এভাবে পরের বছরের এপ্রিল মাস এসে পড়ে। বলা যায়, প্রতি বছরের প্রতি মাসে বিভিন্ন ধরনের ফল পাওয়া যায় এই বাগানে। পর্যটকরা যখন আসে, তখন তাজা ফল খেতে পারেন।

 

চার ঋতুতে বিভিন্ন ফলের ঘ্রাণ পাওয়া যায় এই ফল বাগানে। তবে ফেং এতে থেমে যান নি। ২০১৮ সালে ফেং আবারও নতুন কাজ শুরু করেন। তিনি নিজেই একটি বৈশিষ্ট্যময় প্রাকৃতিক কৃষি খামার নির্মাণ করেন। গ্রামীণ পর্যটন শিল্প উন্মোচন করেন তিনি। তিনি নিজের খামারে থাকার জায়গা নির্মাণ করেছেন। এতে পর্যটকদের অভ্যর্থনা জানাতে পারেন। তিনি বলেন,

চীনা তরুণ ফেং-এর কৃষিকাজ উন্নয়নের অভিজ্ঞতা_fororder___172.100.100.3_temp_9500041_1_9500041_1_1_204414a6-ff9c-43e9-830e-172ec706bf38

আমরা যেটা করি, তা ঐতিহ্যবাহী নয়। আমার ধারণা হল, প্রথমে শিল্প স্থাপন করতে হয়, কৃষি শিল্পের ভিত্তি স্থাপন করতে হয়। তারপর তৃতীয় শিল্প উন্নত করা যায়। এর মাধ্যমে সহজেই পর্যটকদের আকর্ষণ করা যায়। পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা করা যায়।

 

২০২০ সালে করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে গ্রামীণ পর্যটন প্রভাবিত হয়। এক সময় এখানে কোনো পর্যটক ছিল না। তবে ফল বাগানের চাষ কখনই বন্ধ হয় নি। দেশে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আসা এবং বিভিন্ন কাজ ও উত্পাদন পুনরুদ্ধারের পর চেরি ও তুঁতগাছের ফল পাকার সময় হয়। ফল বাগানে এসে ফল তোলা পর্যটকের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। আয়ও অনেক বাড়তে থাকে। এখন ফেং-এর গ্রামীণ পর্যটন শিল্প থেকে প্রতি বছরের আয় হয় ৫০ লাখেরও বেশি ইউয়ান।

 

নিজের কাজের শুরুর সময়, ফেং-এর দলে শুধুমাত্র তিন জন লোক ছিল। এখন তাঁর দলে ২৫জন আছে। ব্যস্ততার সময় আরো বেশি কর্মী যোগ দেয়। আশেপাশের দরিদ্র কৃষকরা তার কাজে অংশ নিতে পারে। তাদের কর্মসংস্থানের সমস্যার সমাধান হয়েছে। ফেং বলেন,

 

আমার কৃষি খামারে এখন ৫টি দরিদ্র পরিবার কাজ করছে। কেউ ফল চাষ করে, কেউ খামারের অন্য কাজ করে। আমি তাদের প্রযুক্তিগত সাহায্য করি, ফল চাষের পর আমি তাদের ফল বিক্রিতেও সাহায্যও করি। যাতে তাদের আয় কিছুটা বাড়ে।

 

ফেং সবসময় চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে ভালোবাসেন। ভবিষ্যত সম্পর্কে তাঁর আরো বড় স্বপ্ন আছে। তিনি আশা করেন, ভবিষ্যতে নিজের কৃষিজ উত্পাদন এবং গ্রামীণ পর্যটনের কাঠামো আরো সুসংহত করতে পারবেন এবং আরো বেশি মানুষের সঙ্গে শেয়ার করতে পারবেন। তিনি বলেন,

 

আমি চাই, আমাদের এই গ্রামকে কৃষি উন্নয়নের ‘দৃষ্টান্ত’ হিসেবে উন্নত করবো। কৃষিকাজকে আরো মানসম্মত করবো, আমার এত বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে আরো বেশি মানুষের কৃষিকাজে সাহায্য করবো। যাতে তারা ভুল না করে। তাদের কাজ আরো সুষ্ঠু হয়।

 

লিউ ভান শান পাহাড়ের নিচে গ্রামের বিরাট পরিবর্তন

‘যেখানে চোখে যায়, সেখানে শুধু ভাঙা বাড়িঘর ও ঘাস, যেন এখানে দীর্ঘদিন ধরে কেউ থাকে না’। কিন্তু এখন পাইপ ওয়াটার, মসৃণ সড়ক, ইন্টারনেট ব্যবস্থা, এই ভিন্ন দুই রকম দৃশ্য দেখা যায়। এটি ২০১৬ সাল ও ২০২০ সালে লি সি গ্রামের দুটি রূপ।

একই জায়গা, ভিন্ন সময়, আকাশ পাতাল পরিবর্তন।

 

লি লুং জুন হলেন চীনের নিংসিয়া হুই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের কু ইউয়ান শহরের ফেং লিং গ্রামের সিপিসি শাখার সম্পাদক। কুই ইউয়ান শহরটি পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত। সেখানে দশ বছরের মধ্যে নয় বছর খরা থাকে। লি সি গ্রাম পাহাড়ি এলাকার এক চরম গরীব গ্রাম ছিল। দীর্ঘসময় ধরে নাজুক ভৌগোলিক অবস্থা, আবহাওয়া, যোগাযোগ অবস্থা বিভিন্ন কারণে অর্থনীতির উন্নয়ন খুব ধীর গতিতে হয়েছিল। বাড়িঘর ও সড়ক কখনই মেরামত করা হয় না। তরুণ-তরুণীরা জীবনযাপনের জন্য সবাই গ্রাম ত্যাগ করে বাইরের শহরে চলে যায়। এর ফলে গ্রামটি আরো দুর্বল হয়ে পড়ে।

 

২০১৬ সালে লি লুং জুন এই গ্রামের সিপিসির শাখা সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি মনে করেন, মূল থেকে গ্রামের সমস্যা সমাধান করতে হলে প্রথমে গ্রামীণ শিল্পকে সমৃদ্ধ করা দরকার।

 

তবে, লি সি গ্রামের প্রাকৃতিক অবস্থা নাজুক। কীভাবে বৈশিষ্ট্যময় শিল্পের চর্চা করা যায়? এটি বিরাট চিন্তার বিষয়। এ বিষয়টি গ্রামের কিছু কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

 

অতীতে, স্থানীয় লোকজন ভিনেগার, তেল ও ময়দা খেতো।  তারা নিজেরাই তা উত্পাদন করত। অর্থনীতি উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যপণ্যের বাজার আরো বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে। দোকানে গিয়ে ভিনেগার কেনা সহজ ও সস্তা হয়ে যায়। আস্তে আস্তে গ্রামে হাতে তৈরি ভিনেগার ও তেলের কাজ ভুলে যায় মানুষ।

 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লোকজনের জীবনযাপনের মান অনেক উন্নত হয়েছে। অনেক ঐতিহ্যবাহী স্বাদের খাবার খুব পছন্দ করেন চীনারা। এমন সুযোগে, লি সি গ্রামের ভিনেগার কারখানা, তেলের কারখানা এবং ময়দা কারখানা স্থাপন করা হয়। এর মাধ্যমে স্থানীয় অবস্থার সঙ্গে উপযোগী বৈশিষ্ট্যময় শিল্প স্থাপন করা সম্ভব হয়। আগে বাইরে যাওয়া আরও অনেক গ্রামবাসী এখন আবার গ্রামে ফিরে এসেছেন।

 

ছি কুও সি গ্রামে ফিরে যাওয়া লোকজনের অন্যতম। আগে তিনি প্রতি বছর বাইরে কয়েক মাস ধরে কাজ করতেন। এখন ভালো মানের হাতে তেল তৈরির প্রযুক্তি দিয়ে তিনি গ্রামের তেল কারখানার একজন প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করছেন।

 

ছি কুও সি বলেন, আগে আমি কখনই কল্পনা করতে পারি নি যে, ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে হাতে তৈরি তেল দিয়ে আয়-রোজগার করা সম্ভব। এখন আমি গ্রাম থেকে বের না হয়ে প্রতি বছর ৩০ হাজারেরও বেশি ইউয়ান উপার্জন করি। যা স্থিতিশীল ও অনেক সুবিধাজনক। যা বাইরের শহরে কাজ করার চেয়েও ভালো।

 

বাজারের চাহিদার উপযোগী, লি সি গ্রামের উত্পাদিত ভিনেগার, তেল ও ময়দাসহ বিভিন্ন পণ্য খুব তাড়াতাড়ি ক্রেতাদের পছন্দ হয়েছে। আর এর দাম যন্ত্রে তৈরি তেলের চেয়েও বেশি। গ্রামের বৈশিষ্ট্যময় শিল্পের উন্নয়ন অনেক দ্রুত হচ্ছে।

 

লি সি গ্রামের সিপিসি শাখার প্রধান ছি ইয়ুং সিন জানান, গত বছরের শেষ নাগাদ, লি সি গ্রামের মোট আয় হয় ৬.৪ লাখ ইউয়ান। টানা তিন বছর ধরে গ্রামবাসীদের মুনাফা বিতরণ করা হতো। তা একদিকে কৃষকদের আয় বাড়িয়েছে, অন্যদিকে সবাইকে আরো ভালোভাবে উন্নয়নের জন্য উত্সাহ দিয়েছে। এখন সবাই গরু লালন-পালনের কাজ শুরু করেছে। বর্তমানে লি সি গ্রামের মাথাপিছু আয় ২০১৬ সালের প্রায় ৬৮০০ ইউয়ান থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০.৫ হাজার ইউয়ান।

 

শিল্প উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারি সমর্থন নীতির কারণে লি সি গ্রামের চেহারার বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। মাটির বাড়িঘর আর দেখা যায় না, সড়ক মজবুত হয়েছে, কৃষকের বাসায় পানির পাইপ চলে গেছে। লি সি গ্রাম এখন একটি আধুনিক সুন্দর গ্রামে পরিণত হয়েছে।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)