মুদ্রার ডিজিটাইজেশনের পথ ধরে বিশ্বে নতুন এক বিপ্লব হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সেই বিপ্লবের পদধ্বনি শোনা গেছে। বিশ্বব্যাপী ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার শুরু হয়েছে। এবার বিশ্বের অন্যতম অর্থনীতির দেশ চীন তার মুদ্রার ডিজিটাল সংস্করণ পরীক্ষামূলকভাবে চালু করল। ডিজিটাল ইউয়ান একদিন বিশ্ব বাণিজ্যের পুরো গতিপথ পরিবর্তন করে দেবে। সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী মার্কিন ডলারের আধিপত্য রোধ করবে। সম্প্রতি চীনের ডিজিটাল ইউয়ানের সীমিত আকারে পরীক্ষা করা হয়েছে। চীনা কর্মকর্তারা আশা করছেন, ২০২২ সালের বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের আগেই তা সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে যাবে।
এক্ষেত্রে মার্কিন মুদ্রা- ডলারের ভবিষ্যত কী হবে। এ বিষয়ে দেশটি কঠোর নজর দিচ্ছে। সম্প্রতি এক মার্কিন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তারা ডিজিটাল ইউয়ানকে বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রার হিসাবে ডলারের সম্ভাব্য হুমকি হিসাবে দেখছেন। তারা মনে করছেন যে, এটি চীন ও অন্যান্য দেশকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যেতে সাহায্য করবে। এমনকি তারা এর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য ডিজিটাল ডলারের কথাও বিবেচনা করছেন!
সহজভাবে বললে, ডিজিটাল ইউয়ান অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো নয়। এখনও ক্রিপ্টোকারেন্সি অনেক অস্থির ডিজিটাল মুদ্রা হিসাবে বিরাজ করছে। ক্রিপ্টোকারেন্সি কোনো দেশ বা ব্যাংকের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত একটি মুদ্রা। অন্যদিকে ডিজিটাল ইউয়ানের সব চরিত্র ও কাজ সাধারণ মুদ্রার মতোই। এটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা পরিচালিত হয় এবং নগদ টাকা ও কয়েনের পাশাপাশি ব্যবহার করা যায়। যখনই কোনও ডিজিটাল ইউয়ান তৈরি হয়, তখন এটি মূলত একটি স্পর্শ করা যায়- এমন ইউয়ানকে প্রতিস্থাপন করে।
আমরা মনে করছি, ডিজিটাল ইউয়ানের আবির্ভাব চীনা মুদ্রার আন্তর্জাতিকীকরণের আরও একটি শক্তিশালী পদক্ষেপ। এর গুরুত্ব তা বর্তমানের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।
বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রায় ৯০% ডলারের লেনদেন হয়। বিশ্বব্যাপী সব দেশের কেন্দ্রীয়-ব্যাংক রিজার্ভের ৬০ শতাংশের বেশি ডলারে জমা করে এবং বৈশ্বিক ঋণের প্রায় ৪০% ডলারের মাধ্যমে জারি করা হয়। এ সবই মার্কিন মুদ্রা ডলারের বিরাট সুবিধা।
ডলারের বিস্তৃত ব্যবহারের মাধ্যমে মার্কিন সরকার আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার উপর দৃঢ়ভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এ কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে একতরফা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুবই সহজ হয়। যেমন সিরিয়া, ইরান, কিউবা এবং অন্যদের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। চাইলেও এ নিষেধাজ্ঞা অবজ্ঞা করা যায় না।
মার্কিন ডলারের সর্বব্যাপী ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্কিং খাতে এর দৃঢ় অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দারুণ সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করে দিয়েছে। গত ৫ এপ্রিল ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একটি প্রবন্ধে ওয়াশিংটনের জন্য ডলারের রাজত্ব করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, “ডলারের বিরুদ্ধে হুমকিসহ যে কোনও কিছু জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যু।” এই নিবন্ধে ডিজিটাল ইউয়ানকে" আমেরিকান শক্তির স্তম্ভকে কাঁপিয়ে দিতে পারে- এমন শক্তি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
আসলেই ডিজিটাল ইউয়ান এর ব্যাপক ব্যবহার আমেরিকান শক্তির স্তম্ভকে কাঁপিয়ে দেবে। বিশ্বের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা অবৈধ নিষেধাজ্ঞার শিকার। এসব দেশ ওয়াশিংটনের আর্থ-রাজনৈতিক চাপ থেকে মুক্তির পথ খুঁজছে।
ইতোমধ্যে, রাশিয়া, ইরান ও ভেনিজুয়েলা-সহ মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি দেশগুলির পণ্য ক্রয়ের জন্য চীন এর ক্রস-বর্ডার আন্তঃব্যাঙ্ক পেমেন্ট সিস্টেম চালু করেছে। যা আন্তর্জাতিক সুইফট (SWIFT ) এর প্রতিদ্বন্দ্বী। ডিজিটাল ইউয়ান এই জাতীয় লেনদেনের সুবিধা দেবে এবং তা সম্প্রসারিত করবে। চাপে থাকা দেশগুলোকে ডলার থেকে সরে যেতে এবং ওয়াশিংটনের হস্তক্ষেপ ছাড়াই প্রকৃত মুক্ত বাণিজ্যে সহায়তা দেবে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রার রূপান্তর রাতারাতি ঘটে না। এজন্য পর্যাপ্ত সময়ের প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক আধিপত্য, গভীর ও তরল মূলধনের বাজার এবং স্থির শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কারণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় রিজার্ভ মুদ্রা মার্কিন ডলার। এখন পর্যন্ত এর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
তারপরও ডিজিটাল ইউয়ান চীনের একটি চমকপ্রদ পদক্ষেপ। আন্তর্জাতিক ব্যাংকিংয়ে এর ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব এবং ওয়াশিংটনের ডলারের আধিপত্য থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।
মোহাম্মদ তৌহিদ, সিএমজি বাংলা।