গত ২৩ এপ্রিল চীনের প্রেসিডেন্ট এবং কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের (সিএমসি) চেয়ারম্যান সি চিন পিং তিনটি নৌযান ছাংজেং-১৮, তালিয়ান, এবং হাইনানের কমিশনিং অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন।
জাহাজগুলি চীনা গণমুক্তি ফৌজের (পিএলএ) নৌবাহিনীকে হস্তান্তর করা হয়। গত শুক্রবার তাদেরকে দক্ষিণ চীনের হাইনান প্রদেশের সানইয়ার একটি নৌ বন্দরে কমিশনিং করা হয়।
বিকেল সাড়ে তিনটায় অনুষ্ঠানটি শুরু হয়েছিল। প্রায় ২ হাজার ৪০০ অতিথি এতে উপস্থিত ছিলেন।
সি চিন পিং তিনটি জাহাজের প্রত্যেকটির ক্যাপ্টেন ও রাজনৈতিক কমিটির কাছে পিএলএ পতাকা এবং নামকরণের প্রশংসাপত্র হস্তান্তর করেন এবং তাঁদের সাথে গ্রুপ ফটো তুলেন।
গত ২৫ এপ্রিল চীন ও লাওসের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৬০তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে চীনের প্রেসিডন্ট সি চিন পিং এবং লাওসের প্রেসিডেন্ট থোংলুন সিসাউলিথ অভিনন্দন বার্তা বিনিময় করেছেন।
অভিনন্দন বার্তায় প্রেসিডেন্ট সি বলেন, চীন ও লাওস হলো সমাজতান্ত্রিক বন্ধুত্বপূর্ণ সুপ্রতিবেশি এবং দৃঢ় অভিন্ন লক্ষ্যের কমিউনিটি। কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৬০ বছরে দু’দেশ আন্তরিকতার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পাঁচটি নীতি অনুশীলন করে আসছে। ফলে দু’দেশের জনগণের বাস্তব কল্যাণ সাধিত হয়।
তিনি বলেন, দুদেশের সম্পর্ক পারস্পরিক বিনিময়ের এক দৃষ্টান্ত। নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর পর থেকে চীন ও লাওস হাতে হাত রেখে মহামারী প্রতিরোধ করে আসছে।
প্রেসিডেন্ট সি বলেন, চীন লাওসের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেয়। লাওসের সঙ্গে দু’দেশের অভিন্ন লক্ষ্যের কমিউনিটি গঠনকে কেন্দ্র করে উচ্চ পর্যায়ের বিনিময় ঘনিষ্ঠতর করতে, কৌশলগত যোগাযোগ জোরদার করতে এবং বাস্তব সহযোগিতা গভীরতর করতে ইচ্ছুক চীন।
অভিনন্দন বার্তায় নতুন যুগে চীনের বৈশিষ্টসম্পন্ন সমাজতান্ত্রিক খাত উন্নয়নে অর্জিত মহান সাফল্যের জন্য সিপিসিকে অভিনন্দন জানিয়ে থোংলুন বলেন, মহামারী প্রতিরোধ এবং অর্থনীতি ও সমাজের উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মূল্যবান সাহায্য ও ব্যাপক সমর্থনের জন্য চীনকে ধন্যবাদ জানায় লাওস।
একই দিন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও দেশের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং দক্ষিণ চীনের কুয়াং সি চুয়াং জাতির স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল পরিদর্শন করেন।
তিনি কুইলিন শহরের ছুয়ানচৌ কাউন্টির ছাই ওয়ানে নির্মিত সিয়াংচিয়াং যুদ্ধ স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন করেন এবং যুদ্ধে মারা যাওয়া লাল বাহিনীর সৈন্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে পুস্পস্তবক অর্পণ করেন।
এ ছাড়া তিনি মাও চু শান গ্রামের পুনরুজ্জীবন ও তৃণমূল পর্যায়ের প্রশাসনিক কাজকর্মের খোঁজখবর নেন। বিকেলে তিনি লিচিয়াংয়ের ইয়াং সু অংশে চলমান সার্বিক সংস্কার কার্যক্রম ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণসহ বিভিন্ন কাজের খোঁজখবর নেন।
তিনি কুই লিন শহরের ছুয়ান চৌ জেলার ছাই ওয়ান টাউনে লংমার্চের সময় নিহতদের স্মরণে নির্মিত সিয়াং চিয়াং যুদ্ধ মেমোরিয়ালে পুষ্পমাল্য অর্পণশেষে এ নির্দেশনা দেন।
এ সময় লংমার্চের চেতনা বৃহত্তর পরিসরে বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিয়েছেন সি চিন পিং
তিনি বলেন, সিয়াং চিয়াং যুদ্ধ চীনা বিপ্লবের সময় সবচেয়ে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলোর অন্যতম। চীনের লাল বাহিনীর সেনারা কেন তখন নিজেদের জীবন উত্সর্গ করতে ভয় পায়নি? কারণ, তারা দৃঢ় আস্থাশীল ছিল, তাদের কাছে বিপ্লবের আদর্শ ছিল আকাশের চেয়েও উঁচু। কেবল তাদের এ চেতনার কারণেই চীন বিষ্ময়কর জয় অর্জন করে।
সি চিন পিং বলেন, চীনের পরবর্তী একশ বছরের লক্ষ্য ও চীনা জাতির মহান পুনরুত্থানের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চাইলে অবশ্যই জয়ের চেতনা লালন করতে হবে। লাল বাহিনীর লংমার্চ এবং রক্তে-রাঙানো সিয়াং চিয়াংয়ের কথা স্মরণ করলে সবার আত্মা ও চেতনার উন্নতি হবে।
গত ২৬ এপ্রিল বিকেলে চীনের কুয়াংসি চুয়াং জাতির স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের লিউচৌ শহর পরিদর্শন করেন চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। এসময় তিনি লিউচৌ শিল্প গ্রুপ লিমিটেড কোম্পানি, স্থানীয় লুওসি রাইস নুডলস কারাখানাসহ বিভিন্ন স্থাপনা ঘুরে দেখেন।
১৯৫৮ সালে লিউচৌ শিল্প গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি চীনের শক্তিশালী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম এবং সারা বিশ্বে ২০টির বেশি শাখা রয়েছে এর। লিউচৌ লুওসি রাইস নুডলস বিশ্বে জনপ্রিয় চীনা খাবারগুলোর অন্যতম। বিশ্বের ২০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলে এই নুডলস বিক্রি হয়।
গত ২২ এপ্রিল সন্ধায় চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং শীর্ষ নেতৃবৃন্দের জলবায়ু সম্মেলনে ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে যোগ দেন এবং এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। এর পর, চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের এক প্রেস ব্রিফিং আয়োজন করে। প্রেস ব্রিফিংয়ে উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাও ছাও সু সম্মেলনের ফলাফল ব্যাখ্যা করেন।
তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট সি’র ভাষণে মানব ও প্রাকৃতিক জীবনের অভিন্ন কমিউনিটি গড়ে তোলার চীনা আগ্রহ ফুটে উঠেছে। চীন গভীরভাবে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের প্রাকৃতিক সভ্যতার ধারণা কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মানব ও প্রাকৃতিক জীবনের অভিন্ন কমিউনিটি গড়ে তুলবে।
ভাষণে প্রেসিডেন্ট সি প্রথমবারের মতো মানব ও প্রাকৃতিক জীবনের অভিন্ন কমিউনিটির ধারণার সমৃদ্ধ অভিব্যক্তি এবং মূল বিষয় ব্যাখ্যা করেছেন। এতে মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থান, সবুজ বিকাশ, নিয়মতান্ত্রিক শাসন, মানুষের জীবনকে অগ্রাধিকার দেওয়া, বহুপক্ষবাদ এবং যৌথ তবে ভিন্ন দায়িত্বের নিয়ম মেনে চলার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
মাও চাও সু বলেন, ভাষণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি মানবজাতির প্রতিক্রিয়া, মানব ও প্রকৃতির মধ্যকার সম্পর্ককে সঠিকভাবে পরিচালনা, এবং সমগ্র মানবজাতির জন্য টেকসই উন্নয়ন অর্জনে প্রেসিডেন্ট সি’র দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে। এতে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশদূষণ মোকাবিলায় চীনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে। এই সম্পর্কে তিনি বলেন, “মানুষ ও প্রকৃতির সুরেলা সহাবস্থান নিশ্চিত করা থেকে শুরু করে, মানব ও প্রকৃতির অভিন্ন কমিউনিটি গড়ে তোলার যৌথ দায়িত্ব পালন করতে আন্তর্জাতিক সামজের প্রতি আহ্বান জানান প্রেসিডেন্ট সি। এতে ভবিষ্যতের প্রতি, ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রতি চীনা প্রেসিডেন্টের দায়বদ্ধতা ফুটে উঠেছে। ভাষণে বৈশ্বিক পরিবেশ প্রশাসন জোরদারে ‘চীনা প্রস্তাব’পেশ করেছেন তিনি। গত বছর চীন ঘোষণা করেছিল যে, ২০৩০ সালের পর থেকে চীনে কার্বন নিঃসরণ ক্রমাগত কমতে শুরু করবে এবং চীন ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন-নিরপেক্ষতা অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা
চালাবে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রেসিডেন্ট সি তাঁর ভাষণে একাধিক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছেন; যেমন, কার্বন পিকিং অ্যাকশন পরিকল্পনা প্রণয়ন, কয়লাশক্তি প্রকল্পগুলিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, অ-কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রিনহাউস গ্যাসের নিয়ন্ত্রণকে জোরদার করা এবং অনলাইন লেনদেন বাড়ানো।”
মা চাও সু বলেন, এই ধারাবাহিক নতুন পদক্ষেপগুলো বাস্তবধর্মী, যার মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় চীনের দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ফুটে উঠেছে। এই সম্পর্কে তিনি বলেন,“সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ অনুসারে, চীনের কার্বন-নিরপেক্ষতার প্রতিশ্রুতি পূরণ হলে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ০.২ থেকে ০.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস হ্রাস পাবে। চীন কেবল ৩০ বছরের মধ্যে কার্বন-নিরপেক্ষতায় অর্জন করবে, যার অর্থ চীনকে অর্জন করতে হবে বিশ্বের সর্বোচ্চ মান। কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করতে এবং স্বল্পতম সময়ের মধ্যে কার্বন-নিরপেক্ষতা অর্জনের জন্য যা করা দরকার, তা হচ্ছে একটি বিস্তৃত এবং গভীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাগত পরিবর্তন।”
চীনের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বিশেষ দূত সিয়ে চেন হুয়া ভিডিও’র মাধ্যমে এবারের প্রেস ব্রিফিংয়ে যোগ দেন। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট সি’র এবারের শীর্ষসম্মেলনের ভাষণটি বিশ্বের কাছে চীনের ধারণা, লক্ষ্য ও কার্যক্রমের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
তিনি বলেন,“সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জাতীয় প্রকৌশল কাজে লাগিয়ে সবুজ বিকাশ এবং স্বল্প-কার্বন রূপান্তরকে উত্সাহ দিয়েছে। এটি প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য একটি ভাল ভিত্তি স্থাপন করেছে। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারী ছড়িয়ে পড়া এবং অর্থনীতির মন্দাবস্থার প্রেক্ষাপটে চীন একটি কার্বন-নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি প্রস্তাব করেছে, যা আন্তর্জাতিক সমাজের আস্থাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এটি মানবজাতির অভিন্ন কমিউনিটি গড়ে তোলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।”